রূপকথার গান, গানের রূপকথা : আতাসরকার
গান শোনা যায় কুয়োর পারে। গান জেগে ওঠে ব্যাঙের ডাকে। পানিতে ভেসে যায় কথার ভেলা। ভেলায় সাপে-কাটা মানুষ। চারপাশে লাল-নীল-শাদা-কালো-সবুজ-হলুদ পতাকা। বাতাসের ছন্দে ছন্দে পতপতায়। আর এসময়ই শোনা যায় গান। এ গান মর্মমূলে এসে বিঁধে। হৃদয় ছিঁড়ে যায়। আবার হৃদপিন্ড তড়পায়। জেগে ওঠে হৃদয়।
: কে তুমি গো? ও গায়ক, আমাকে জাগাও। কাঁদাও। হাসাও।
: আমিই তো তুমি। তোমার সাথে মিলে-মিশে আমি একাকার। আমাকে কি তুমি টের পাও না?
: পাই বোধহয়। যখন মনের ভেতর বেড়ে ওঠা কষ্ট কান্না হয়ে ঝরে, তখন তুমি গান হয়ে বেজে ওঠো অন্তর জুড়ে।
আকাশ জুড়ে মেঘ জমে। বানের পানি পাহাড় গড়িয়ে ধায় না, আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। দিনের আলো লোপাট করে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আনে। অন্তরের ভেতরও জমে ওঠে আঁধারের কালো। মনের পাড় ঝুপ-ঝুপ ভাঙ্গে। তখন বুকে মোচড় দেয়া দুঃখের কলি ঠোঁট ছাড়িয়ে বাতাসে ভাসে। মেঘ-বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে অশ্রু গড়ায়।
আর তখনি ঠোঁট জুড়ে হাসির বান নিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় মায়াবতী। হাসির ¯িœগ্ধতা আর মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে ভরিয়ে তোলে সারাটা মন। শরীরটাকেও করে তোলে ঝরঝরে চনমনে।
গানের কথা যায় পাল্টে। সুরও। নতুন আলোর উদ্ভাস নিয়ে সে গায় প্রাণের গান। তার জানতে ইচ্ছা করে না কে এই মায়াবতী, কোত্থেকে সে এসেছে, কেন এসেছে। সাধ জাগে, তার গান অফুরান হয়ে ছড়িয়ে যাক চারদিক। আর মায়া-কাড়া এই মেয়েটি তার পাশেই থাক অনন্তকাল।
বুঝতে পেরে মেয়েটি ত্রস্ত হয়ে ওঠে: তা হয় কিগো, আমার স্বামী-সন্তানÑসংসার আছে না! আছে আমার ঘর-কন্না, বিষ্টির সাথে নেচে-নেচে খেলে বেড়ানোর নেশা। গানে গানে সময় গড়ানো জীবনের ষোলআনাইতো শেষ।
গায়ক বলে: তাহলে থাকো একটুখানি।
গায়কের মনের প্রশ্ন না থাকতে পারে, অন্যদের থাকবে না কেন? জিজ্ঞেস করে: কে তুমি, কোত্থেকে এসেছ?
মায়াবতী কেমন হাসির আবীর ছড়িয়ে নেয় সারা মুখে। বলে: আমি এসেছি অলকানন্দ থেকে। আমি স্বপ্ন।
গায়ক বলে: স্বপ্ন কি ছোঁয়া যায়? ধরা যায়? করা যায় কি আলিঙ্গন? নাকি মায়া নিয়ে মমতা নিয়ে ভালবাসা নিয়ে স্বপ্ন দাঁড়িয়ে থাকে দূর বলয়ে?
মায়াবতী হাসে। হাসিতে মোমের কোমল আলো ছড়ায়। সব কিছু যেন নরম-নরম তুলতুলে। বলে, নাকি পাল্টা প্রশ্ন করে: তোমার কি মনে হয়?
গায়ক বলে: তোমাকে রঙধনুতে দেখি, উঠোন জুড়ে ছড়ানো জোৎ¯œার আলোয় ভাসতে দেখি, তোমার শরীর থেকে নতুন ধানের মিষ্টি গন্ধে আকুল হই, বাঁকানো কাস্তের ডগায় শিশির-ফোঁটা দেখি। দেখি দূরে দাঁড়িয়ে; কিন্তু ছোঁয়া তো যায় না। ছুঁতে যে বড় সাধ হয়।
মায়াবতী আনমনা হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বলে: অমন করে লোভ দেখিও না। বরং তুমি দরাজ গলায় গান গাও। তোমার গানে আমিও স্বপ্ন দেখি।
কী অবাক করা কান্ড, তাইনা? স্বপ্নও দেখতে চায় স্বপ্ন। বর্তমানের স্বপ্ন। বাস্তবের স্বপ্ন। ভবিষ্যতের স্বপ্নের আকিবুকি। সবাই মিলে এ এক স্বপ্নে লীন হওয়া।
মায়াবতী তাকায় স্বপ্ন-চোখে। তাকায় গায়ক। চোখে চোখে শত বিস্ফোরণ। গায়কের স্বরযন্ত্র কেঁপে ওঠে। সুর মূর্ছা যায়। চারপাশে গানের এক অলৌকিক পরিমন্ডল।
বাজে ভেঁপু। বাজে সাইরেন। মায়াবতীর খবর নেই। গায়কের খবর নেই। সুরে সুরে জীবনের জাগরণ।
হঠাৎ কড়া নাড়া।
তীব্র ঝাকুনি খায় মায়াবতী। গায়কের গানের তাল কেটে যায়।
সচকিত মায়াবতী। চোখে-মুখে শংকা। সে হাত বাড়ায়। আকাশটাকে ছোঁয়।
তার লম্বা হাত দিয়ে মেঘগুলোকে সরায়। দূর-আকাশে মেঘের আড়ালে সে হারিয়ে যায়।
গায়ক বসে পড়ে মাটিতে। নুইয়ে আসে মাথা। দরজায় কড়া নেড়ে কে ডাকে: দরজা খোল হে, তোমার গানের জন্য খাঁচা এনেছি।
১৭.৫.২০০৭