ইছামতির বুক
কালোর ওপর হলুদ ছোপগুলো যেন তুলি থেকে ছিটকে পড়া রঙ, বেশ স্বাস্থ্যবান একটা জলঢোঁড়া অনায়াসেই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো। বিনা পাসপোর্ট, বিনা ভিসায়! জলঢোঁড়াটির অস্তিত্ব টের পেতেই তড়িৎ গতিতে ভারতের দিকে ছুটলো এক ঝাঁক রুপালী পুটিমাছ। মেঘের শার্সি ভেদ করে সবে জলের আয়নায় তাকিয়েছিল সূর্য, জলঢোঁড়ার জলকাটা ঢেউয়ে সূর্যের প্রতিবিম্ব যেন হাত থেকে পড়ে যাওয়া ভাঙা আয়নায় রাগী মানুষের মুখ!
কূলে ভেড়ানো নৌকার গলুইয়ে বসে নদীতে ছিপ ফেলে শালপাতার বিড়ি ফুঁকছিল মধ্য ত্রিশের জহির। লèীট্যারা চোখের দৃষ্টি জলঢোঁড়ার ওপর পড়তেই ডানে কাত হয়ে জল ছিটালো সে। অপ্রত্যাশিত বাধা পেয়ে জলঢোঁড়াটি অবশ্য ভারতে ফিরে গেল না। কিছুটা বা দিকে সরে গিয়ে কলমীলতার ঝোপ, জলজ উদ্ভিদের ভেতর হারিয়ে গেল।
এখানে ীণকায়া ইছামতি উত্তর থেকে এসে কিঞ্চিৎ কোমর বেঁকিয়ে চলে গেছে দেিণ। পুবে যশোরের পুটখালি, পশ্চিমে উত্তর চব্বিশ পরগণার আংরাডাঙা। এখানে কাঁটাতারের বিভেদ গড়ে ওঠেনি। অরতি সীমান্ত। তবে দু-পাড়ের মানুষ জানে এক অদৃশ্য কাঁটাতারের বিভেদ গড়ে দেওয়া হয়েছে ইছামতির বুকে। ইছামতির বুকের একপাশ বাংলাদেশ, আরেক পাশ ভারত। এক স্তন লাল-সবুজ, আরেক স্তন আকাশী-সাদা! মানুষ জানে, কিন্তু ইছামতি কি জানে!
পাতার বিড়ির শেষাংশ ইছামতির বুকে ছুঁড়ে দিল জহির। কানটুপিটা টেনে কান ঢেকে নিল ভাল মতো। উত্তরে হাওয়া বইছে। বিদায়বেলায় পিতৃগৃহ ত্যাগ করার সময় কনের তীব্র আহাজারি-কাঁন্নাকাটির মতো শীত এখন।
সেই ভোরবেলা একটা দল পার করেছে জহির। তারপর থেকে নদীতে ছিপ ফেলে বসে আছে। পেয়েছে গোটা সাতেক পুটি আর একটা পোনামাছ। অর্ধেক জলে ডুবিয়ে রাখা খালুইয়ের মধ্যে শঙ্কায় ছুটোছুটি করছে মাছগুলো। বেলা বাড়লে জহিরের নয় বছরের ছেলে জামাল ভাত দিয়ে গেছে। ভাত খেয়ে সে আবার বসেছে ছিপ নিয়ে। এখন দুপুর হতে চললো।
নদীতে ছিপ ফেলে মাছ ধরাটা আসলে অজুহাত মাত্র। তার আসল কাজ মানুষ পারাপার করা। এই পয়েন্টে রোজ তিন-চারশ মানুষ পারাপার হয়। আজ সকাল থেকেই লাইন খারাপ। লাইন ভাল হলে তার কাছে ফোন আসবে দু-পাড় থেকেই। তখন একটা ধকল যাবে। এ কাজের ধরণই এমন। দিন নেই, রাত নেই যখন তখন মানুষ আর মালামাল পারাপার করতে হয়। ভোর থেকে রাত অব্দি ঘাটেই থাকে সে। আবার কখনও কখনও কাঁচা ঘুম থেকে উঠে এসেও শক্ত হাতে ধরতে হয় বৈঠা।
আরেকটা শালপাতার বিড়ি ধরালো জহির। শালপাতার বিড়ি খেতে তার দারুণ লাগে। আবার দামেও সস্তা। তবে এপাড়ে পাওয়া যায় না। ওপাড় থেকে আনতে হয়। সে অবশ্য মাসে একবার বনগাঁ যায়। তখন প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র কিনে নিয়ে আসে। সঙ্গে শালপাতার বিড়ি আর দু-চারটে বোতল। প্রায়ই সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সাথে নৌকায় বসে সেই বোতলগুলো ভারমুক্ত করে। বন্ধু বলতে চোরাকারবারি আনিস, মোটর সাইকেল চালক রুবেল, দালালের প্রতিনিধি আক্কাস আর নারী পাচারকারী হাবিবুল। লোকে বলে জালি হাবিব। বোতল ফুরিয়ে গেলে আক্কাস দেশভাগের জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তাদের বাপ-দাদাদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে। তখন রুবেল বলে, ‘দেশটা ভাগ হলো বলেই না আমরা পেটে দুটো খেতে পাচ্ছি। নইলে এই আকালের দিনে কি খায়ে বাঁচতাম!’
‘এখন এই রাত্তিরে মদ পাব কনে! দেশ ভাগ না হলি মতিনের মুদি দোকানে সয়াবিন তেলের বোতলের পাশে মদের বোতলও থাকতো। খাও ইচ্ছে মতো! আর শালা এখন মদ আনতে বনগাঁ ছোটো। একানকার বালের কেরুর যা দাম, এক বোতল মানষির রক্তের দামও অতো না’ আক্কাসের গলা থেকে আফসোস ঝরে পড়ে।
চোরাকারবারী আনিস বলে, ‘হ্যারে হাবিব, তাজুল চাচার ছোট মাইয়েডারে কোন বনবাসে রাইখে আসলি ক দিনি? একনও ডাঁটো হয়নি। কচি। চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াতো। ফাইন লাগতো।’
‘হু…ফাইন লাগতো! এই তোর ফাইন লাগায় কি ওর পেট ভরে! খালি তো চোখ দিয়ে চাটে চাটে দেখতি, হাতে কোনদিন পাঁচটা টাকা গুঁজে দিছিস? আমি রুটি রুজির ব্যবস্থা করে দিলাম। এহন একজনের কামাইতে পুরো সংসার ভাল মতো চলবিনি।’
‘এহন আছে কনে?’
‘সোনাগাছিতে। জমায়ে সংসার করতিছে। এহন ওরে দেকলি তোরা চিনতি-ই পারবিনে। ওকানে তো কি সব ওষুধ-ফষুধ খাওয়ায় ওগের। দুই দিনেই ফুলে-ফেঁপে সার দেওয়া ডাঁটার মতোন হয়ে যায়। আমি তো আবার দুডে মুরগি নিয়ে গিছিলাম। ওরে দেকে তো চু চড়ক গাছ। ছিল ছেঁড়া ন্যাতা, হয়ে গেছে জামদানী! আমারে দেকে এট্টু চোখের জল ফেললো। তারপর সাত হাজার টাকা দিয়ে কোলো, আব্বাকে দিও। এক হাজার কমিশন কেটে নিয়েছি।’
‘তুই শালা সত্যিই জালি!’ জহির বলে।
সেদিন গল্পে গল্পে ওদের মাঝরাত পেরিয়ে যায়।
ফাতনাটা হাবুডুবু খাচ্ছে। লèীট্যারা চোখের দৃষ্টি আঁকড়ে ধরেছে ফাতনাটাকে। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো।
লুকোচুরির গল্প, শূন্যতা অল্প
বনগাঁর সেভেন্টি এইট বাসস্ট্যান্ডের টিকেট কাউন্টারের পিছনের ঘরটিতে যাত্রীরা অধীর অপোয় কেউ পায়চারী করছে, কেউ সিগারেট ফুঁকছে, কেউ বসে আছে, কেউবা পাশের দোকান থেকে শেষবারের মতো টুকিটাকি কিছু কিনে ব্যাগের খালি জায়গাটুকু ঠেসেঠুসে ভরাট করছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা মতে এদের ভারতের মাটিতে থাকার বৈধতা নেই। অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল, এখন বাংলাদেশে ফিরবে। আবার কেউ কেউ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করবে। বাংলাদেশে ফেলে আসা স্বজনদের কাছে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার ভারতে ফিরবে।
দালালরা যাত্রীদের হাতে এক টুকরো করে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে, তাতে ওপাড়ের দালালের নাম এবং ফোন নম্বর লেখা। দালালরা বাইরে যায় আবার কিছুণ পর পর এসে খোঁজ নেয় নতুন কেউ এলো কিনা! কালো বেটে মতো প্রদীপ নামে এক দালালকে একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কতণ বসায়া রাখবা?’
বৃদ্ধ অসুস্থ। ডাক্তার দেখাতে এসেছেন নাতির সাথে। প্রদীপ দালাল বিরক্ত চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আরে কাকা, বলেছি তো লাইন খারাপ আছে।’
‘সেই বিয়ানবেলা থেইকে কতেছো লাইন খারাপ। কতণে লাইন ভাল হবি?’
উত্তর না দিয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে চলে গেল প্রদীপ।
ত্রিশের যুবক অনিন্দ্য ঘর থেকে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ডের খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই আধো আলো-ছায়াময় ঘরে আর কতণ থাকা যায়! বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বাজার। চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখছে সে। এই বর্ডারকে কেন্দ্র করে কত রকম মানুষের কত রকম পেশাই না গড়ে উঠেছে! বছর পুঁচিশের এক যুবক এসে অনিন্দ্যকে বললো, ‘দাদা, আপনি কি বরিশাল যাবেন?’
অনিন্দ্য ভাল করে দেখলো যুবককে। যুবকের হাতে ছোট্ট একটা প্যাকেট। বললো, ‘কেন বলুন তো?’
‘বরিশালের কাউকে পেলে আমার বাবার জন্য এই ওষুধের প্যাকেটটা পাঠাবো।’ যুবকের সরল উত্তর।
‘না ভাই, আমি বরিশাল যাব না।’
বরিশালের লোকের খোঁজে চলে গেল যুবকটি। একটি মোটর সাইকেল এসে থামলো। চালকের পিছনে দুজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। একজনের পরনে জিন্স-শার্ট, অন্যজনের শাড়ী। জিন্স-শার্ট পরা জনের কাঁধে বেশ ভারী ব্যাগ। ব্যাগটি বেঞ্চের ওপর নামিয়ে পকেট খুলে কিছু বের করলো। হাতের তালুতে রেখে প্রক্রিয়া সম্পাদনের সময় বোঝা গেল-খৈনি! তখনই দালাল এসে তাড়া দিল অপেমান একটি বাসে ওঠার জন্য।
বাস চলছে। যেন কোন অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা! অনিন্দ্য’র ঝিমুনি এসে গেল। কান্ত শরীর! ঝিমুনি ছুটে গেল বাসটি এক জায়গায় এসে দাঁড়ালে। জায়গাটা চেক পোস্ট। একজন বি এস এফ জওয়ান বাসে উঠে জেরা শুরু করলো বাসের পিছনের যাত্রীদের। অনিন্দ্য বসেছে বাসের মাঝামাঝি জায়গায়। জওয়ানটি একটু একটু করে এগোচ্ছে আর অনিন্দ্য’র বুক দুরু দুরু করছে। দালাল তো একবারও বললো না যে বাসে বি এস এফ চেক করবে! সে ভেবেছিল বাস থেকে নামার পর হয়তো চেক করবে। এখন জিজ্ঞেস করলে কি উত্তর দেবে! পিছনে জেরা চলছে –
‘বাড়ি কোথায়?’
‘বিরাটী।’
‘কোথায় যাবি?’
‘ঝাওডাঙা।’
‘আইডি কার্ড দেখা।’
‘আই ডি কার্ড সাথে নাই।’
‘ঝাওডাঙা কি করতে যাচ্ছিস?’
‘আমার বোনের বাড়ি যাতেছি।’
‘যাতেছি’ বলার পর আর কিছু বলার সুযোগ দিল না জওয়ানটি। বললো, ‘ ওঠ, নিচে নাম।’
‘নামবো ক্যা?’
‘ওঠ, নিচে নাম।’
‘স্যার, আমি সত্যি কতেছি ঝাওডাঙা বোনের বাড়ি যাব।’
‘ওঠ।’ এবার ধমকালো জওয়ান। ছেলেটি কাঁদো কাঁদো হয়ে নিচে নামলো।
এই শীতেও অনিন্দ্য যেন ঘামছে। তবু ভাল একটা নাম জেনেছে, ঝাওডাঙা। কিছু জিজ্ঞাসা করলে সেও ঝাওডাঙা যাবার কথা বলবে। তবে ভাগ্য ভাল বি এস এফ জওয়াটিও নেমে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো অনিন্দ্য এবং আরো অনেকেই।
রাস্তার দু-পাশে ঘন বাঁশ ঝাড়। জঙ্গুলে একটা জায়গায় এসে বাস থামলো। হেলপার বললো, ‘যারা বাংলাদেশে যাবেন তারা নামেন। নেমে দৌড় দিন।’
বাস থেকে প্রায় অর্ধেক যাত্রীই নেমে পড়লো। নেমেই যে যার মতো দৌড়তে লাগলো বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে। অনিন্দ্য, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দুজন, দুজন মাঝ বয়সী মহিলা, একজন বিবাহিত তরুণী, একজন যুবক, একজন প্রৌঢ়, তিনজন যুবতী, একটি বালক। সবাই দৌড়চ্ছে। কেবল অসুস্থ বৃদ্ধকে নিয়ে অসহায় নাতিটি পিছে তাকাতে তাকাতে যতটা দ্রুত সম্ভব হাঁটার চেষ্টা করছে।
ঘাটে নৌকা নিয়ে প্রস্তুতই ছিল জহির। সবার উঠতে যতণ। দাদু আর নাতি বাদে সবাই উঠলো। তারা দুজন এখনও অনেক দূরে! নৌকা ছেড়ে দিল জহির। কারো মুখে কোন কথা নেই। কেবল ঘন নিশ্বাসের শব্দ!
নৌকা থেকে নেমেই জহিরের কথা মতো আবার দৌড়! মাঠটা পার হতেই বটগাছের নিচ থেকে দরবেশের মতো একজন দালালদের প্রতিনিধি বেরিয়ে এলো। তার মুখেও একই বোল, ‘দৌড়ান, দৌড়ান…।’
দৌড়তে দৌড়তে একটা বাড়ির পাশের মেহগনি বাগানে এসে থামলো সবাই। সেখানে এই যাত্রীদের জন্য অপেমান দশ-বারোটি মোটর সাইকেল। যাক, আর তবে দৌড়তে হবে না! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সাবাই। তখনই আরেক বাইক চালক এসে নির্দেশ দিল, ‘লুকান সবাই, লুুকান। ঐ ঘরে যান।’ অগত্যা ঐ ঘরের উদ্দেশ্যে আবার দৌড়! একে একে সবাই ঘরে ঢুকে দরজাটি আটকে দিল। ঘরটি গোয়াল ঘর! গবাদী-পশুর মল-মূত্রের ঝাঁঝালো গন্ধ পেটে পাঁক দিচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। নিঃশব্দে ঘামটি মেরে রইলো সবাই। প্রৌঢ় লোকটি উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখতে যেতেই একজন মাঝ বয়সী মহিলা তাকে মুখ ঝামটা দিল। এতণে বোঝা গেল তারা স্বামী-স্ত্রী। অথচ দৌড়নোর সময় মনে হচ্ছিল কেউ কাউকে চেনেই না!
প্রায় মিনিট বিশেক গোয়ালবাস শেষে দালালদের ডাকে বেরিয়ে এলো সবাই। যে যার আপনজনের সাথে বাইকে উঠে পড়তে লাগলো। কেবল একা হয়ে পড়লো অনিন্দ্য আর বিবাহিত তরুণী। ছিপছিপে এক বাইকচালক তাদের দুজনকে বাইকে উঠতে বলতেই অনিন্দ্য বললো, ‘আমার সঙ্গে একজন পুরুষ দিলে ভাল হয়। কাঁধের ব্যাগ নিয়ে আমাকে পিছনে বসতে হবে। ততণে পুরুষের ঘাটতি পড়ে গেছে। তরুণীটি চটজলদি বললো, ‘সমস্যা নেই, আপনার ব্যাগ আমার কাছে দিয়েন।’
অনিন্দ্য জানালো, ‘ব্যাগটা অনেক ভারী।’
পূণর্বার জানালো তরুণী, ‘সমস্যা নেই। আপনি দিল আমাকে।’
সমস্যা যে নেই তা তরুণীর মজবুত শারীরিক গঠন দেখেই বুঝতে পেরেছে অনিন্দ্য। তবু নিছকই ভদ্রতা করে বলা।
অতঃপর বাইক চলতে শুরু করলো এ বাড়ির উঠোন, ও বাড়ির আনাচ-কানাচ দিয়ে। একসময় উঠলো মাটির রাস্তায়। উচু-নিচু গর্ত আর ধুলোময় রাস্তা। তরুণীর কাঁধে অনিন্দ্য’র ব্যাগ। ডান হাতে অনিন্দ্য’র কাঁধ আর বা হাতে পেট জাপটে ধরেছে। কিছুণ পরপরই অনিন্দ্য’র পিঠের ওপর ঝুঁকে পড়ছে সে। এই প্রথম অনিন্দ্যকে কেউ এভাবে জাপটে ধরেছে, এই প্রথম অনিন্দ্য’র পিঠে এমন কোমল মাংস পিন্ডের চাপ লাগছে!
অসমতল রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে প্রি গতিতে বাইক চলছে। না, অনিন্দ্য’র মনে কোন কাম ভাব জাগছে না। এতণ গোল্লাছুট আর লুকোচুরি খেলার পর এখন তার বুকের ভেতরটা ধূ ধূ মাঠের মতো খা খা করছে। বুকের ভেতর শূন্যতা, চোখ দুটোতেও শূন্যতা! আহা, তার নিজের যদি এমন কেউ থাকতো!
ইছামতির জলে বিষন্ন নক্ষত্র
বটগাছের নিবিড়, গম্ভীর অন্ধকার ছায়া থেকে একে একে চৌদ্দজন মানুষ বেড়িয়ে এলো নীল দেওয়া সাদা কাপড়ের মতো জোছনা মোড়ানো মাঠটিতে। চতুর্দিকে কানে তালা লাগানো ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। পিছন পিছন আসা একটি কুকুরের নিচুস্বরে ঘেউ ঘেউ, কিংবা সামান্য দূরের গৃহস্থবাড়ির নারিকেল গাছ থেকে ইঁদুরে কাটা কচি ডাব ভূ-পাতিত হবার শব্দেও বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠছে কারো কারো। এমনকি মানুষের পায়ের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত পলায়নপর চিকার চিক চিক শব্দেও আঁৎকে উঠছে কেউ কেউ!
দালালদের প্রতিনিধি ছেলেটি তাড়া দিল, ‘দৌড় লাগান, দৌড় লাগান। জোছনা রাত তো, অনেক দূরের থেকেও দেখা যায়।’
কেউ কেউ হাঁটার গতি বাড়ালো, ছেলে ছোকরারা দৌড়তে শুরু করলো। প্রত্যেকেরই হাতে, কাঁধে, মাথায় ভারী ব্যাগ। দলটির মধ্যে একই পরিবারের সদস্য আছে নয় জন। বিমল-শ্যামল দুই ভাই, তাদের স্ত্রী, বৃদ্ধা মা, বিমলের দুই ছেলে-এক মেয়ে আর শ্যামলের এক ছেলে।
পরিবারটির বাড়ী ছিল যশোরের অভয়নগর, ভৈরব নদের পারে চাঁপাডাঙা গ্রামের মালোপাড়ায়। পরিশ্রমী দু-ভাইয়ের দু-খানা টিনের ঘর ছিল। নিজস্ব জাল-নৌকা ছিল। ছিল দুধেল গাই আর ছোট্ট একটা হাঁসের খামার। হয়তো বনেদীয়ানা ছিল না, কিন্তু দুই ভাই আর তাদের স্ত্রীদের অকান্ত পরিশ্রমে অভাব নামক কুৎসিত বাতাস পরিবারটিতে ঢুকতে পারেনি কখনও।
এই সুখ-স্বচ্ছন্দে চলমান পরিবারটি এক রাতেই পথে বসে গেল! টিনের ঘর-গোয়াল পুড়ে ছাই হয়ে গেল। জাল পুড়লো, হাঁসের খামার পুড়লো। হাঁস পোড়া গন্ধে মালোপাড়ার বাতাসও হাঁফিয়ে উঠেছিল। নৌকাখানা কুপিয়ে ফালা ফালা করে রেখে গেল ভৈরব নদের পারে। কেউ-ই কিচ্ছুটি করতে পারলো না। পরিবার-পরিজন নিয়ে কোন মতে সাঁতরে আশ্রয় নিয়েছিল ভৈরবের নদের অপর পারে। মানুষের আকৃতিতে কয়েকশো হিংস্র পশুর তান্ডবে শেষ হয়ে গেল গোটা মালোপাড়া!
সকালে যখন ভয়ে ভয়ে অন্য সকলের সঙ্গে বিমল-শ্যামল মালোপাড়ায় ফিরলো, তখন মালোপাড়া শ্মশান! গোয়ালের চালের ফাঁকে যে চড়–ইয়েরা বাসা বানিয়েছিল তারাও ঘর ছাড়া। ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে আমগাছের ডালে লাফাচ্ছে! পোড়া বুক বের করে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের খুঁটিগুলো। খামারে হাঁস পুড়ে মরে আছে। আধপোড়া জীবন্ত হাঁসগুলোর গলায় যন্ত্রনার কাতরতা। গত ভাদ্র মাসে বিমলের বাবা মারা গেছেন। তার দেহ ভষ্ম পুটলিতে করে রেখে দিয়েছিল গঙ্গায় বিসর্জন দেবার জন্য। ভেবেছিল আসছে চৈত্রে ভারতে গিয়ে বাবার দেহভষ্ম গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে আসবে। সেই দেহভষ্ম, ঘর পোড়া রাশি রাশি ভষ্মের মধ্যে হারিয়ে গেছে! বিমলের মা পাগলের মতো খুঁজেছিল স্বামীর দেহভষ্মের পুটলিটা। পায়নি, বৃদ্ধা হাজার চেষ্টা করেও কোথাও খুঁজে পায়নি প্রিয়তম স্বামীর দেহভষ্ম!
এখন সেই পোড়া ভিটেটাও বেচে দিয়ে জন্মের মতো চলে যাচ্ছে ভারতে। কি দোষ ছিল তাদের? জন্মগতভাবে তারা হিন্দু! তারা এদেশে সংখ্যালঘু! তাই মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাতের রোষ আর ত্রাসের শিকার হয়ে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে এই দেশান্তর হওয়া!
দলটিতে আছে এক মুসলমান দম্পতি। এরা কলকাতা যাবে ডাক্তার দেখাতে। বাড়ি ঝিনাইদহ। তাই আর উল্টে ঢাকা যায়নি পাসপোর্ট-ভিসার জন্য। প্রৌঢ় লোকটির অকাট্য যুক্তি,‘ঘরের কাছে কলকাতা। কুড়ি টাকার টিকিট কাটে বনগাঁ লোকাল এ উঠলি-ই চলে গেলাম। কিডা আবার পয়সা খরচ করে ঢাকা যায় পাসপোর্ট-ভিসার জন্যে!’
দলটির বাকী সদস্য একজন বাউল আর তার সাধন সঙ্গীনি। বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে শ্যামল জিজ্ঞেস করেছিল বাউলকে, ‘আপনাগের বাড়ি কনে?’
বাউল উত্তর দিয়েছিল, ‘আমাদের বাড়ি-ঘর নাইরে বাবা! পথই আমাদের বাড়ি, পথেই আমাদের সংসার! আজ কুষ্টিয়া, নড়াইল, যশোর তো কাল নদীয়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া।’
একে একে সবাই নৌকায় উঠলে নৌকা ছাড়লো জহির। বিমলের বউ মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে। বাউল সঙ্গীনি সান্ত্বনা দিল,‘কিসের জন্যে কাঁদিস রে মা! কিছুই তো সঙ্গে করে আনিস নাই, কিছুই সঙ্গে যাবে না।’
নৌকা চলছে। বৈঠার ছপ ছপ শব্দ, দু-পারে ঝিঁ ঝিঁ পোকার খঞ্জনি। তবু যেন সব শব্দ ছাপিয়ে উঠছে এই মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস আর নিশ্বাসের শব্দ! বাউল সঙ্গীনি গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো –
শূূন্য থেকে এসেছ মন
শূন্যতেই মিলাবা
মাঝখানে তে মায়ার জলে
মায়ার সাতার খেলা!
মায়ার ঘোরে, দেহের জোরে
মিছে মোহের খোয়াব দেখা….
নৌকা কূলে ভিড়তেই বাউল সঙ্গীনির সুর ছাপিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো বিমলের বৃদ্ধা মা! তার আকর্ষিক কাঁন্নায় সবাই হতভম্ব হয়ে গেল!
মানুষগুলো জোছনার সীমানা ছাড়িয়ে গাছের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। জহির ইছামতির মাঝখানে এসে বৈঠা তুলে রেখে পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। চাঁদটা এখন চোখ বরাবর। সে একটার পর একটা নত্রে চোখ বোলাতে লাগলো অতিশয় আদরে। আজ অব্দি অনেক মানুষ পার করেছে জহির। অনেককে চোখের জল ফেলতে দেখেছে, অনেক অন্যায় দেখেছে, হাবিবুল কত মেয়েকে পাচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে এসে পার হয়েছে তার নৌকায়! কিন্তু কিছুতেই কিছু আসে যায়নি তার। সে মানুষ পার করেছে, বিনিময়ে পেয়েছে টাকা। স্ত্রী-সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিতে পেরেই সে খুশি থেকেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ ঐ বাউল সঙ্গীনির গান আর ঐ বৃদ্ধার কাঁন্না কেমন যেন করে দিল তাকে। জীবনে কোনদিন দু-মুঠো ভাতের বেশি চিন্তা করেনি। অথচ আজ তার মনে প্রশ্ন জাগছে, সে কোথা খেকে এসছে? কেন এসেছে? আবার কোথায় চলে যাবে? মানুষ কত দিন বাঁচে? ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই বা একশো! তবে কেন এই হানাহানি! কেন এই দেশান্তর হওয়া! ঐ গান আর কাঁন্নার সুর যেন তাকে ভাবতে শিখিয়ে গেল! আকাশের নত্র গুনতে শিখিয়ে গেল। একটা, দুইটা, তিনটা….। ইছামতির জলেও কত নক্ষত্র! বিষন্ন নক্ষত্র!