ভূমিকার বদলে
২০০০ সালের সূচনা লগ্নে, মার্চের এক বিকালে দৈনিক ভোরের কাগজের মহিলা বিষয়ক পাতা নারীপক্ষের একটি লেখার জন্য আমাকে ডেকে পাঠালেন সম্পাদক বেনজীর আহমেদ। বিষয় ছিলো বরিশাল বিভাগের প্রথম শিক্ষিত নারীকে খুঁজে বের করে তাঁর বর্তমান অবস্থান তুলে ধরা।
একইসময় বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ অভিনেতা এবং বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী (সাবেক) আসাদুজ্জামান নূর এমপি ডেকে পাঠালেন “তাঁর মায়ের পাশে বসে, তিনি (মা) যা বলবেন, তা লিখে দেবার জন্য”। মূলত এটা একটি আত্মজীবনী মূলক রচনা হবে।
একদিকে আমি খুঁজছি বৃহত্তর বরিশালের প্রথম শিক্ষিত নারীটিকে, অন্যদিকে নূর ভাইয়ের মায়ের কথা শুনে শুনে তৈরি করছি তাঁর আত্মজীবনী। নূর ভাইয়ের মা খুব চমৎকার গুছিয়ে বলতে পারতেন, তবে হাতের আঙ্গুলে সমস্যা থাকার কারণে তিনি লিখতে পারতেন না। তাঁর স্মরণ শক্তিও খুব প্রখর ছিলো, তারপরও তিনি বলতেন, এই যে তুমি যা লিখছো, তা কতটা সত্য লিখছো, সেটা তোমার যাচাই করা উচিৎ। এজন্য তোমাকে আমার গ্রামের বাড়িতে, আমি যেসব স্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করেছি, সেসব স্থানের আমার পরিচিতজনদের সাথেও কথা বলা উচিৎ। তাহলে তোমার এই রচনা সার্থক হবে। কখনো কারো আত্মজীবনী লিখলে, এ কাজটি সবসময় করবে, এটা স্মরণ রেখ। খালাম্মার (আমিনা বেগম)এর বলা এ কথা আমি স্মরণ রেখেছি, যারফলেই প্রফেসর ডাক্তার এম আর খানের জীবনী করতে যেয়ে সেখানেও আমি হেঁটে এসেছিলাম এম আর খানের ছেলেবেলার পথে।
নূর ভাইয়ের মায়ের বক্তব্যের সুত্র ধরে, তাঁরই দেখানো পথে আমি হেঁটে এলাম তাঁর জন্মস্থান বরিশালের পিরোজপুর জেলাধীন স্বরূপকাঠীর সুঠিয়াকাঠী গ্রামে। কলকাতার জলপাইগুড়িতে যেতে না পারলেও হেঁটে এলাম রংপুর হয়ে নীলফামারী জেলায়। কথা বললাম ও তথ্য মিলিয়ে নিলাম তাঁর পরিচিত অনেকের কাছ থেকে। শুধু তাই নয় একইসাথে আমার হাঁটা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। আর এই স্বরূপকাঠীতে বসেই আমি আবিস্কার করলাম- বৃহত্তর বরিশালের প্রথম শিক্ষিত মুসলিম গ্রাজুয়েট নারীটি অন্য কেউ নয়, তিনি আসাদুজ্জামান নূর সাহেবেরই মা আমিনা বেগম স্বয়ং। শুধু তাই নয়, তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার লেডি ব্রেবোন কলেজেরও প্রথম মুসলিম ছাত্রী।
ব্যস আমাকে আর পায় কে? ভোরের কাগজে অচিরেই ছাপা হলো – কল্পকথার নক্সীকাঁথা (আমার জীবন আমার কথা) – শিরোনামে আমেনা বেগমের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত।
আমেনা বেগমের জীবদ্দশাতেই অতি ধীরে ধীরে তৈরি হলো এই আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থটি। ২০০৫ সালের ১৮ জনিুয়ারীতে হঠাৎ তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন পুথিবীর মায়া ছেড়ে। তাঁর চলে যাওয়ার সাথে সাথে এই আত্মজীবনীটিও যেন হারিয়ে গিয়েছিলো। নূর ভাইয়ের বাসায় কম্পোজ কপিটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি তাই আমাকেই পুনরায় লেখাটি গোছাতে বললেন। এরপর দীর্ঘসময়, ব্যস্ততায় এ বিষয়টিকে সবাই ভুলেই গিয়েছিলাম।
সম্প্রতী রাজনীতিবিদ ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর ঐ আত্মজীবনীটা বিষয়ে পুনরায় খোঁজ করলেন। আমিও তৈরি ছিলাম। হাতে লেখা পা-ুলিপিটা পুনরায় কম্পোজ করিয়ে তৈরি রেখেছি, যাতে তিনি ডাকলেই ছুটে যেতে পারি।
বি:দ্র:- এই আত্মলিখনি কোনো দলিল নয়। এভানের সব কথা স্মৃতি হাতড়ানো আবেগগাঁথা। তথ্যগত কোনো ভুল ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ হবো।
আলাপে
আরিফ আহমেদ
অনুলেখক ও সম্পাদক
এক
হে ¯স্রষ্টা তুমি, পথ ভ্রষ্টা
আমাদের ক্ষমা করো
জ্বালো মঙ্গোল শিখা জ্বালো
জ্বালো সত্য পিদীম জ্বালো।
আমাদের মনের গহীনে লুকানো – সুপ্ত কণায়
পাপেরা সেখানে সাঁতার কাটে আর বড় হয়।
তুমি ¯্রষ্টা সব দ্রষ্টা
পাপীদের ক্ষমা করো।।
একা হলেই গুন গুন করে এভাবেই কখনো প্রার্থনা সংগীত কখনো পবিত্র কোরআনের আয়াত গেয়ে যাই আপন মনে ।মনে বেশ বল পাই তখন, এখনো বেঁচে আছি সেতো এই মনেরই জোরে। নারীর প্রধান ভরসা হচ্ছে স্বামী, স্বামী যদি না থাকে তবে আল্লাহ ছাড়া আর ভরসা কোথায়?
নারী হয়ে জন্ম নিয়ে এই দেশে – এটুকু শিখেছি। দেখেই খুব জোড় গলায় বলতে পারি যে, কৈশরে বাবা মা আর যৌবনে স্বামী নারীর সবচেয়ে আপনজন। এরপরের সময়টা ছেলেমেয়ের জন্য। কিন্তু ছেলেমেয়ে বড় ও স্বাবলম্বী হয়ে গেলে নারীকে পুনরায় স্বামী নির্ভর হতেই হয়। আমরা বাঙালী মেয়েরা যে বয়সে শাড়ী পড়তে শিখি, সে বয়সে ঘর-সংসারের স্বপ্ন বাঁধতে শিখি। এ নিয়মের একটু অন্যথা হলেই সে নারীটিকে হতে হয়েছে সমাজ ত্যাগী কিম্বা বিপথগামী।
আজকের সমাজের কথাই যদি ধরি, নারী এখন যত স্বাধীন হয়েছে, যত বেশি আধুনিক হতে শিখেছে ততোই বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। আগেও যে এমনটি ছিলোনা তা নয়, তবে আগে নারীরা শুধু স্বামীর দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হতো, আর এখন চারিদিকে – চতুর্মূখী নির্যাতনের শিকার নারী।
ছোটবেলা দাদীমার কোলো শুয়ে গল্প শুনতে চাইলে, দাদীমা প্রায়ই একটা ভিন্ন গল্প শোনাতেন। – এখন আর গল্পটা মনে পড়ে না, তবে অর্থটা এখনো খুব স্পষ্ট মনে আছে – একটা সময় ছিলো যখন মেয়ে পক্ষকে যৌতুক দিয়ে ছেলেপক্ষের লোকেরা মেয়েকে নিয়ে যেত। আজ দিন বদলে গেছে, উল্টো ছেলেপক্ষকেই যৌতুক দিয়ে মেয়েকে তুলে দিতে হয়। দাদীমার বলা গল্পটিতে এই দিনের পরিণতি স্পষ্ট হয়েছিল। ইস্ আজ যদি দাদীমা বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়ত গল্পটাকে আবার ছড়িয়ে দেয়া যেত। দাদীমা আজ নেই, তার গল্পটিও নেই কিন্তু রাজকুমার ও রাক্ষস-খোক্ষসের গল্পটাতো তোমরা অনেকেই পড়েছ। রাজকুমারীকে রাক্ষসের গুহা থেকে উদ্ধার করতে একজন রাজকুমার কি কষ্টটাই না স্বীকার করে। এ গল্পটিতেও কিন্তু নারীকে বসানো হয়েছিল বিশেষ সম্মানিত এক স্থানে। যে স্থানটিতে পৌঁছে তবেই নারীর মন জয় করা সম্ভব ছিল পুরুষের পক্ষে। আজকের আধুনিক গল্পের রূপরেখা-বক্তব্য ভিন্ন। এখনকার গল্পকাররা নারীকে পণ্য করছে আর ঠেলে দিচ্ছে নির্যাতীত সেই সব পথে যেখানে রয়েছে পণ্য হবার অবাধ স্বাধীনতা। দাদীমার গল্পটি যদি মনে থাকত তবে নারীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যেত – এটাই তোমাদের ভবিষ্যত।
কারো সাথে কথা বলতেই এখন আর তেমন উৎসাহ পাই না। পাব কি করে অল্পতেই যে এখন হাঁপিয়ে উঠি। মাঝে মধ্যে নিজেই নিজেকে ব্যঙ্গ করি – কি হে আমিনা বেগম, সারা জীবন কথা বলার চাকুরী করে এখন এই বৃদ্ধ বয়সে এ কী ভীমরতি?
মনে মনে অবশ্য নিজের সাথে নিজে বেশ কথা বলি, বেশীর ভাগ কথাই হয় যুগের পরিবর্তন নিয়ে- জানি মানুষ পরিবর্তনশীল, কিন্তু এ সমাজের এত দ্রুত পরিবর্তনটা বড্ড চোখে পড়ে। আমরা যখন স্কুলে গিয়েছি তখনকার সমাজ ব্যবস্থা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক কী মধুর সে দিন, আর আজ? আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন ছাত্র-ছাত্রী সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। আজকের শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের বিস্তর ব্যবধান – অনেক ক্রোশ ব্যবধান আজ। শুধু ভাল লাগে সমাজে এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিটুকু। আমরা যখন মাইলের পর মাইল কষ্ট করে পায়ে হেঁটে, কাঁদা পানি মারিয়ে পড়তে গেছি, আজ ওরা কী সহজে গাড়ি – রিক্সা ব্যবহার করে পড়তে যায়। কী আরাম! বড় লোভ হয় আবার যৌবনে ফিরে যেতে।
শাহিনা আর সেতারাকে দেখে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার। শাহিনা হচ্ছে আমার বড় ছেলে নূরের স্ত্রী, একজন সফল ডাক্তার। আর সেতারা আমার ছোট ছেলে মিজানের বউ। কি একটি বিষয়ে যেন গবেষণা করছে। বেশীর ভাগ সময়েই গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হয়। কি নিঃসঙ্কোচে আজ ওরা কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করছে, অথচ ওদের বয়সে আমি যখন প্রথম কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করি তখনকার সমাজ ব্যবস্থাই এমন যে একমাত্র শিক্ষকতা পেশাটাই মেয়েদের জন্যে সম্মানের ছিল। অন্য পেশায় মেয়েদের আশাই করা যেত না। শাহিনাদের আজকের এই সময়টাকে পেতে আমরা পারি দিয়েছি অনেকগুলো ভাংগা গড়া সাগর, যার অস্তিত্ব শাহিনা, সেতারা কিম্বা ওর মেয়ে এগার বছরের সুপ্রভা কল্পনাই করতে পারবে না। আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আটপৌড়ে এক বৃদ্ধের একাকীত্বের সময় কাটানোর জন্যে এই যে কলম তুলে নেয়া সেও ওদের জন্যেই। ওদেরকে ঐ সময়টায় একটু মানসিক হাঁটানোর জন্যে আমার চেষ্টা কতটা সফল হবে জানি না। তবে নিজের দেখা সময়টার গল্প করার এ সুযোগটুকু কে-ই বা হাত ছাড়া করতে চায়?
বারবার একাকীত্ব বলছি বলে কেউ যেন ভেব না আমার কেউ নেই, তা নয়, আসলে বয়স বাড়লেই বোধ-বুদ্ধি কিছু কিছু পরিবর্তন শুরু হয় যেখানে নিজেকে ছাড়া আর কিছুই ভাবনায় আসে না, বেইলী রোডে নূরের এই বিশাল বাড়িটায় দু’জন বুয়া ওর ছেলে সুদীপ্ত – মেয়ে সুপ্রভা সবাই আছে, সবার মাঝে আমিও আছি, কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা শূন্যতা, নাজেম চলে যাবার পর থেকেই এ শূন্যতা দিনকে দিন আমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, এখনো খায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি কথা খুব কম বলতাম, আমার শিক্ষকতা জীবনেও ছাত্রীদের সাথে প্রয়োজনীয় কথাটুকু ছাড়া তেমন কথা হয়নি। স্বামী সংসার ছেলে মেয়ে এ সবকিছু নিয়েই আমার সুখের সংসারে কথোপকথনটা ছিল নেহাত প্রয়োজনে। নাজেম অবশ্য খুব আড্ডা প্রিয় ছিল। সবসময় একটা না একটা কাজ নিয়ে ও ব্যস্ত থাকতো। নূর ঠিক ওর বাবার ধারা পেয়েছে। বড় ব্যস্ত মানুষ ও। সকালে বের হয় ফেরে অনেক রাত্রে। বউমা ডাক্তার, পিজি হাসপাতালে চাকুরী ওর। সুদীপ্ত – সুপ্রভাদের স্কুলে যেতে হয়। ওদের বইয়ের রাজ্য দেখে আমি নিজেই ভিমরী খেয়ে যাই। ওরা যখন খুব ছোট ছিল তখন ওদের নিয়েই বেশ সময় কেটে যেত। এখন ওরাও বড় হয়েছে, ওরা যত বড় হচ্ছে ততোই কেমন একটা দুরত্বের দেয়াল। আমরা এ বয়সেও দাদীমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতাম, ওরা বইয়ের পাহাড়ে ডুবে থাকে। প্রয়োজন ছাড়া দাদীমার কাছে খুব একটা ঘেঁষে না।
আমার ছেলে-মেয়েরা, নূর, মিজান ও ফোয়ারা কিন্তু ওদের দাদীমার কাছে বেশী থেকেছে। আমরা স্বামী-স্ত্রী যখন চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত তখন বাচ্চাদের দেখবার দায়িত্বটা আমার শ্বাশুড়ী নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
১৯৮২ সনের ১৮ই জুলাই আমার শ্বাশুরী মারা যান। তাঁর সম্পর্কে আরো পরে বলছি। আগে তাঁদের সাথে আমাদের আলাপের পথে হাঁটি।
নূরের মেয়ে সু-প্রভা কিন্তু ঠিক আমার ছোটবেলার আদল পেয়েছে।মাঝে মধ্যে ওকে দেখি আর নিজের ছোটবেলাটা স্মরণ করি, ওর ছেলেবেলার সাথে আমার ছেলেবেলার কি বিস্তর ব্যবধান?
পাড়া গাঁয়ের এদোঁ কাঁদা গায়ে মেখে বেড়ে ওঠা জীবন আমার। সভ্যতার আলো তখনো পড়েনি, তবে বেগম রোকেয়ার প্রভাব কিছুটা পরেছিল ঐ সুঠিয়াকাঠী নামের গ্রামটিতে। আমাদের গ্রামটি তেমন পরিচিত না হলেও তখনকারদিনে বাকেরগঞ্জ জেলাধীন পিরোজপুর মহকুমার স্বরূপকাঠী ছিল ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তখনকার সময়েই পেয়ারা চাষ ও কাঠ ব্যবসার জন্যে এ অঞ্চলের খ্যাতি ছড়িয়ে পরেছিল। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেব ছিলেন আমাদের গ্রাম প্রতিবেশী। বাবা চাচাদের সাথে তাঁর ছিল গভীর বন্ধুত্ব। আমাদের গ্রামটিতে তাঁর যাতায়াত ছিল। বলা যায় বিদ্যানূরাগী এ মানুষটির উৎসাহ উদ্দীপনাই স্বরূপকাঠীর মানুষের মাঝে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে ছিল।
আমার জন্মের পরপরই আমরা দু’জন লোকের নাম খুব শুনতে পেতাম – একজন শেরে বাংলা, অন্যজন শরশীনার পীর সাহেব নেছারউদ্দীন আহমেদ। ইংরাজী ১৯২০ সালের ১৫ মার্চ বাংলা ১৩২৬ সনের পয়লা চৈত্র আমার জন্ম হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। মা-বাবার চতুর্থ সন্তান হিসেবে আমার জন্ম হলেও আদতে আমিই ছিলাম দ্বিতীয় সন্তান। কেননা খুব অল্প বয়সেই আমার মাঝখানের এক ভাই ও এক বোন মারা গিয়েছিল। আমার ভাইবোনদের মধ্যে সকলের বড় ছিল বোন নূরজাহান বেগম টুলু। আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা ছিল ওর প্রধান দায়িত্ব। চাচীদের কোলেও ছিলাম তবে ছোট চাচা ও দাদীমার আদরেই কেটেছে শিশুকাল। ধর্মীয় অনুশাসনে বন্দী একটি পরিবারের আচার ব্যবহারের সাথে তাল মিলাতে হয়তো বেশ সময় নিয়েছিলাম। তবে হাঁটি হাঁটি পা পা থেকেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের যাবতীয় সভ্যতার বুলিগুলো শিখে নিচ্ছিলাম খুব দ্রুত।
নদী বেষ্টিত একটি গ্রাম সুঠিয়াকাঠী। চারিদিকে থৈ থৈ পানির ভিতর আমাদের বেড়ে ওঠা। নদীর নাম সন্ধ্যা। কে কখন এ নামটি রেখেছিলেন তা জানি না, তবে নামের সাথে সন্ধ্যার মিল ছিল দারুন। বিশেষ করে বর্ষা কালটায় থৈ থৈ পানি আর মেঘের গর্জনের সাথে ছই (ছাওনী) নৌকোর দুলে চলা দৃশ্য এখনো চোখ বন্ধ করলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। ইচ্ছে হয় ছুটে যাই ঐ ফেলে আসা গায়ে। নৌকো ছাড়া তো আমাদের তখন আর কোন বাহন ছিল না। বাড়ির বাগানে প্রচুর পেয়ারা গাছ ছিল, পেয়ারা কিম্বা আম খেতে হলে নৌকো নিয়ে বাগানে যেতে হত। শুধু বর্ষাকালে নয়, অন্যান্য সময়েও জোয়ারের পানি বাড়ির ভেতর উঠোনে চলে আসতো। তার উপর বাড়িতে ছিল বড় বড় চারটি পুকুর। পানিতে পরে শিশুরা যাতে ডুবে না যায়, সে জন্য সতর্কতার কমতি ছিল না। এমনি সতর্কতার চিহ্নস্বরূপ আমার পায়ে ঘুঙুর বেধে দেয়া হয়েছিল। পুকুরের দিক থেকে ঘুঙুরের শব্দ শোনা গেলেই বড়রা ছুটে এসে আমাকে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। শব্দটি ছিল অদ্ভুত ঢং ঢং থং থং রকমের, যার জন্য আঢ়ালে আবডালে আনেকেই আমার নাম দিয়েছিল ঢনঢনি।
আমাদের বাড়িটা যে খুব বড় ছিল তা কিন্তু নয়। দুটি মাত্র ঘর ছিল বাড়িতে, একটি ঘর আমার দাদা আনিসউদ্দীন আহমেদ তৈরি করেছিলেন। অন্যটি চাচাত দাদা নাজেমউদ্দীন আকনের তৈরি। তাঁর ঘরটি ভেঙ্গে ওখানে দালান তৈরি হয়েছে। শুধু আমাদের দাদার তৈরি ঘরটি এখনো টিনেরই আছে, তবে কাঠের দোতলা গড়া হয়েছে। একটি ঘর থেকে এখন দু’টি বড় ঘর হয়েছে। ঘরের আসবাবপত্রের কোন পরিবর্তন করা হয়নি। শুনেছি দাদার ব্যবহৃত খাট ও আলমারী এখনো আছে। সুঠিয়াকাঠী গ্রামের আদি বাসিন্দা হিসেবে মাত্র চার কি পাঁচটি পরিবার ছিল। এদের মধ্যে আমাদের পর পিতামহরাও ছিলেন।
শুনেছি ফেলাই ও নব্দি নামের দু’ভাই থেকেই আমাদের বংশের উৎপত্তি। এই দু’ভাই বাবুগঞ্জের জয়পুর থেকে ব্যবসা উপলক্ষে স্বরূপকাঠীতে এসে এই সুঠিয়াকাঠী গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাদের দু’ ভাইয়ের এক জনের ছয় ছেলে দুই মেয়ে, অন্য জনের তিন ছেলে তিন মেয়ে ছিল। যদিও নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি ছয় ছেলের জনক ফেলাই না নবদি তবে ঐ ছয় ছেলের সবচেয়ে ছোট ইজ্জতউল্লাহ আকন্ থেকেই আমাদের বংশের উৎপত্তি।
ফেলাই ও নব্দি
(নবদি এর তিন ছেলে তিন মেয়ে, তবে তাদের নাম সংগ্রহ করা যায়নি।)
ছয় ছেলে দুই মেয়ে
১। মদনউদ্দীন আক্ন
২। ছফেরউদ্দীন আক্ন
৩। ছমেরউদ্দীন আক্ন
৪। আজিমউদ্দীন আক্ন Ñ নামেজউদ্দীন ব্যাপারি Ñ মৌলভী ইসরাইল Ñ আজমল হক
৫। কমরউদ্দীন আক্ন Ñ তোসনউদ্দীন Ñ আব্দুল হামিদ Ñ সাইদুল রহমান খোকা
৬। ইজ্জতউল্লা আক্ন Ñ আনিসউদ্দীন আহমেদ ও ইয়াকুবউদ্দীন
ইজ্জতউল্লাহ আকনের দুই ছেলে আনিসউদ্দীন আহমেদ ও ইয়াকুবউদ্দীন। এই আনিসউদ্দীন আহমেদই আমাদের দাদা ছিলেন। তিনি বিয়ে করে ছিলেন কৌড়িখাড়া মুন্সি বাড়ির মেয়ে ছোটি বিবিকে। প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই মহিলার গর্ভেই আমার বাবা-চাচাদের জন্ম হয়েছিল। বাবা-চাচারা ছিলেন ছয় ভাই। সবার বড় আদিলউদ্দিন আহমেদ বিয়ে করেছিলেন কৌড়িখাড়ার মিয়া বাড়িতে। মা বাবার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন আমার বাবা হেলালউদ্দিন আহমেদ। সেজচাচা আজহারউদ্দীন আহমেদ বাবার তুলনায় দু’বছরের ছোট হলেও সফিউদ্দীন আহমেদ, কফিলউদ্দীন আহমেদ ও ছোট চাচা আতাহারউদ্দীন আহমেদের বয়সের ব্যবধান ছিল এক বছর।
আনিসউদ্দীন আহমেদ এর ছয় ছেলে দুই মেয়ে (বক্স হবে)
(দুই মেয়ে জন্মের সাথে সাথেই মারা যায়)
১। আলহ্বাজ আদিলউদ্দীন আহমেদ Ñ আবু বড় মিঞা, কিসলু, মালেক, চারু এবং আমিরন ও মজিরন
২। হেলালউদ্দীন আহমেদ Ñ আমেনা বেগম সহ মোট পনের ভাই বোন
৩। আলহ্বাজ আজহারউদ্দীন আহমেদ Ñ এক ছেলে দুই মেয়ে
৪। আলহ্বাজ আহমেদ Ñ ডাঃ হাবিবুর রহমান ও মেরী
৫। আলহ্বাজ কফিলউদ্দীন আহমেদ Ñ সাত ছেলে পাঁচ মেয়ে
৬। আতাহারউদ্দীন আহমেদ Ñ ছয় ছেলে ও চার মেয়ে
কাঠের ব্যবসায় আমার দাদা তেমন প্রসার জমাতে পারেন নি, যার ফলে দরিদ্রতার কষাঘাত সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। ছয় ছেলে নিয়ে একটি মাত্র ঘরেই একান্নবর্তী হয়ে বসবাস তাঁর। তিনি যখন হঠাৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন আমার বাবা চাচারা পরলেন অথই সাগরে। বাবা তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, বড় চাচা তখন তারই চাচাত চাচা নাজেমউদ্দীন আক্ন এর কাঠ ব্যবসায় কাজ করতেন। অন্য চাচারা সবাই খুবই ছোট। বাবার পড়াশুনা আর হল না। বড় ভাইয়ের সাথে তিনিও লেগে পড়লেন ব্যবসায়ের দেখাশুনায়। নাজেমউদ্দীন আক্নের সাহায্য সহযোগিতায় বাবার সাফল্য ক্রমশঃ বেড়ে চলল। নাজেমউদ্দীন আক্ন কিন্তু, ইজ্জতুল্লাহ আক্ন অর্থাৎ আমাদের বংশিয় প্রধানের ভাইয়ের ছেলে। সম্পর্কে আমাদের দাদা ছিলেন। নাজেমউদ্দিন আকনের তিন ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে সবার বড় ইসরাইল মৌলভীর ছেলে আজমল হক এখনও ঐ বাড়িতেই বসবাস করছেন।
ইজ্জতুল্লাহ আক্ন ছিলেন গ্রাম্য পঞ্চায়েত প্রধান। সেখান থেকে এই পঞ্চায়েতের দায়িত্ব পেয়েছিলেন নাজেমউদ্দীন আক্ন। বড় চাচা ও বাবার বিয়ের বিষয়ে তারই অবদান ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। আমার মা আজিমুন্নেছো ছিলেন নামকরা বংশের মেয়ে, নানা দলিলউদ্দীন আকন ছিলেন কাঠের বড় ব্যবসায়ী। যার দরুন মা’কে বিয়ে করে বাবার ব্যবসায়ের প্রসার ঘটেছিল আসাম ও বার্মা পর্যন্ত।
মোট পনের ভাই বোন ছিলাম আমরা। আমার বড় ছিল তিন জন, বাকীরা সবাই ছোট। অল্প বয়সেই তিন ভাই ও তিন বোন মারা যাওয়ায়, নয় ভাই বোন জীবীত ছিলাম। আজকের যুগে পরিবার পরিকল্পনার প্রভাবে সংসার ছোট রাখা যায় – তখনকার দিনে তো এটা কেউ কল্পনাই করেনি। সন্তান “আল্লাহর দান” বলে তখনকার বাবা মায়েরা নির্দ্বিধায় একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়ে যেতেন। জনসংখ্যার বিস্তার ঘটেছিল এভাবেই। খাওয়া পরার তেমন চিন্তা ছিল না। গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ তো আমরাই দেখেছি। আমার বয়স যখন সাত বছর তখন থেকেই বড়শি পেতে মাছ ধরা আমার সখ ছিল। পুকুরে পা ধুতে গেলেই মাছেরা এসে পায়ের উপড় আঁছড়ে পড়তো, সরপুটি, টিট পুটি। বোয়াল মাছটা খুব ভয় পেতাম। ওটাকে বলতাম রাক্ষুসে মাছ। সুযোগ পেলেই বিশাল হাঁ করে তেড়ে আসতো। সাত বছর বয়স পর্যন্ত বেশ ভালই ছিলাম। গাছে চড়া, লুকোচুরী খেলা এ সব কিছুতেই বেশ পারদর্শি ছিলাম। কেউ কখনো বাঁধাও দিত না।
কিন্তু এরপরই শুরু হল নিয়ম নীতির ভার, মেয়ে হবার সুবাদেই হয়ত বাইরে মেলা মেশা কমিয়ে দিতে হল। এ জনমে দু’বার মার খেয়েছিলাম, একবার বাবার হুক্কায় ফুঁ দিয়ে। আরেকবার গাছে চড়ার অপরাধে। মারের ভয়ে বাধ্য হয়েই নিয়ম নীতি মেনে চলার চেষ্টা করতাম। মক্তোবে ভর্তি করে দেয়া হলে, বড় বোন টুলু আমায় নামাজ পড়া শিখাতে শুরু করলেন। আমিই সবার চেয়ে বেশী পড়াশুনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এদিকে আবার আমার ছোটদের সেবা যতেœর কমতি হলে মা রাগারাগি করতেন।
বাবা-মা-চাচারা আদর করে আমায় ডাকতেন খুকী বলে। আমার মামারা ডাকতেন আমেনা। মামাবাড়ি আর দাদা বাড়ি খুব কাছাকাছি হওয়ায় সুবিধেটা পুরোদমে ভোগ করতাম, বাড়ি থেকে কেউ একটু মন্দ বললেই রাগ করে যেয়ে মামা বাড়িতে উঠতাম। ছোট চাচা আর দাদী এসে আমায় নিয়ে যেতো তখন। আমার দাদী ছোটি বিবির ব্যক্তিত্ব এমন ছিল যে, তার ছেলেরা কখনোই তাকে জিজ্ঞাসা না করে কিছু করতেন না। এমনকি পঞ্চায়েতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরও বাবাকে দেখেছি দাদিমার পরামর্শ গ্রহণ করতে। বাবা বিদ্যানূরাগী ছিলেন। ছোট চাচাদের পড়াশুনার জন্য বেশ উৎসাহ যোগতেন। বাড়ির ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার সুবিধার জন্য বাবা একটা মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। দুর দুরান্তের পাঠানূরাগী ছাত্ররা এসে যেন পড়াশুনা করতে পারে, সে জন্য মাদ্রাসার সাথে থাকার জন্য ঘর করে দেয়া হয়েছিল। আমাদের বাড়ির দরজায় যে পুকুরটি কাটা হয়েছে ওখানেই ছিল মাদ্রাসা ঘর। বাড়ির ছেলেরা ওখানেই পড়াশুনা করত, মেয়েদের পাঠ দানের জন্য মাদ্রাসার একজন মৌলভী ও একজন হিন্দু ব্রাহ্মণকে বাড়ির ভিতর কাচারী ঘরে এসে পাঠদানের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। ব্রাহ্মণকে নারায়ণ পন্ডীত বলে ডাকতো সবাই। মৌলভীর মশাইয়ের নামটা অবশ্য এখন আর মনে পড়ে না।
আগেই বলেছি, চারিদিকে নদী বেষ্টিত একটি গ্রাম সুঠিয়াকাঠী। গ্রামের মধ্যে দিয়েও ছোট ছোট শাখা নদী বা খাল সরু ফিতার ন্যায় এঁকে বেঁকে গেছে। আগাখাল থেকে গোড়াখাল, জোয়ার-ভাটায় গ্রামের সব ময়লা আবর্জনা ধুয়ে যেত এ খাল পথে। গাছ-পালা দিয়ে এমনভাবে ঢাকা যে দুপুর বেলাতেও সূর্যের আলোটা ছিল বিছানো জালের মতো, তেজহীন। লোকবসতী কম হওয়ায় দিন দুপুরে ভয়ে গাঁ ছম ছম করতো। শিয়ালের ভয় ছিলো খুব। সন্ধ্যার পর ঘরের বাহিরে যাওয়া তাই নিষিদ্ধ ছিলো। সেই সময়, আমার বয়সী প্রায় সব ছেলে-মেয়েকেই এরকম জীবন উপভোগ করতে হয়েছে। আসলে তখনকার গ্রাম বাংলার প্রকৃতির সাথে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো বাঘ-শিয়াল আর সাপের ভয়। নৌকা ছিলো প্রধান বাহন। প্রতিটা গৃহস্থের ঘরেই নৌকা ছিলো। বাজার থেকে নৌকা বোঝাই করে বাজার আসতো বাড়িতে। মা-চাচীরা সেই বাজার নিয়ে যখন ব্যস্ত, আমরা দু’বোন তখন ছোটদের নিয়ে কাচারী ঘরে কিম্বা উঠোনে জড়ো হয়ে খেলা করতাম। রাতে ব্রাহ্মণ প-িতের কাছে পড়তে যেতাম, আমার ছোটভাই হেমায়েতউদ্দিন আহমেদ, ডাকনাম কাঞ্চন মিয়া এবং ছোটবোন রওশনজাহান কুসুম আমার সাথে পড়তে যেত। তখনই একটা বিষয় আমার চোখে পড়ে, আমি দেখতাম মেয়েদের পড়াশুনার প্রতি মৌলভী বা প-িতরা মোটেও গুরুত্ব দিতেন না। এমনকি পরিবার থেকেও তেমন চাঁপ ছিলোনা। একমাত্র ছোট চাচা আতাহারউদ্দিন আহমেদ এবং বড় মামা মোজাফফর আলী মেয়েদের পড়াশুনার বিষয়ে সচেতন ছিলেন। বাবার সম্পর্কের ফুফাতো ভাই মোদাচ্ছের আলী চাচা এসে এ সচেতনাকে আরো বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর মুখেই প্রথম বেগম রোকেয়ার গল্প শুনলাম আমরা। তিনি যে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটা স্কুল করেছেন, তা-ও ঐ প্রথম জানতে পারলাম। ছোট চাচা ও মোদাচ্ছের আলী চাচার উৎসাহে বাবা মাদ্রাসা বন্ধ করে জুনিয়র গার্লস স্কুল তৈরি করলেন। এটা ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলেই পড়াশুনা আমার। ইতিপূর্বে ১৯০৯ সালেই বাবার উদ্যোগে জুনিয়র বয়েজ ইংলিশ স্কুল চালু হয়েছিল। আমার বাবা বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেদের পড়াশুনার জন্যে হাইস্কুল দরকার। তাছাড়া একটি হাইস্কুল না হলে গ্রামের ছেলেরাও মানুষ হয়ে উঠবে না। এই চিন্তাধারায় বাবা হাইস্কুল তৈরি করলেন। শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক এসে এই স্কুলের উদ্বোধন করেছিলেন। আমার ভাই কাঞ্চন, কিসলু ও হাবিব প্রথম ঐ স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ঐ স্কুলের সেক্রেটারীর দায়িত্ব তিনিই পালন করেছিলেন। চাচাত-মামাত ভাইয়েরা এই বয়েজ স্কুলেই পড়াশুনা করত। বংশিয়ভাবে আমাদের ভাই বোনদের মধ্যে বড় চাচার ছেলে আবু ছিল সবচেয়ে বড়। তাই তার নামের সাথে আবু বড় মিয়া যোগ করা হয়েছিল।
আমাদের পনের ভাই-বোনের নামের তালিকা (বক্স হবে)
১। নূরজাহান বেগম টুলু
২। পাঁচ মাস বয়সের মৃত এক ভাই
৩। ফিরোজা বেগম
৪। ফরিদা বেগম
৫। আমেনা বেগম
৬। হেমায়েতউদ্দীন আহমেদ কাঞ্চন
৭। রওশন জাহান বেগম কুসুম
৮। শওকত আরা বেগম রেণু
৯। আটমাস বয়সের মৃত এক ভাই
১০। মহিউদ্দীন আহমেদ রাজা
১১। সুজন
১২। ফেরদৌস্ আরা বেগম শেফালী
১৩। কবিরউদ্দীন আহমেদ মনু
১৪। তিন মাস বয়সে মারা যাওয়া বোন
১৫। রওশন আক্তার বেগম বড়ি
একান্নবর্তী পরিবারের প্রথম শর্তই ছিল দাদীমা সংসারে প্রধান, তার জীবীতকালে আমার বাবা চাচারা কখনোই পৃথক হননি। এমনকি খাবার পরিবেশনটাও ছিল সকলে এক সংগে বসে, সে এক দেখার মতন বিষয়, বড় ঘরের বারান্দায় চাটি পেতে দীর্ঘ লাইন। মেয়েরা খাবার পরিবেশন করত। পুরুষরা; বাবা-চাচা-চাচাত ভাইয়েরা সবাই খেয়ে গেলে মেয়েরা বসত খেতে। এ নিয়ম দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পরবর্তিতে সব চাচাদের ছেলে পুলেতে সংসার ভরে ওঠায় বাধ্য হয়েই চাচারা পৃথক ঘর তোলেন। তবে সেক্ষেত্রেও বাজারটা কিন্তু একই নৌকায় করে সব ঘরের জন্য সমান বিতরণ ব্যবস্থা ছিল। একজনের জন্যে মাছ-অন্যজন মাংস এটা কখনোই হত না। আমাদের বাড়ির অবস্থাটা এমন যে, নদীতে জোয়ার এলে বাড়ির ভিতর হাটু জল জমা হতো, ফলে নৌকো একেবারে রান্না ঘরে যেয়ে বাজার তুলে দিতে পারতো। কাঠের ব্যবসায়ী হবার সুবাধেই হয়ত আমাদের ঘরগুলো তৈরি হয়েছিল কাঠ দিয়ে। সেগুন কাঠের ব্যবহার হয়েছিল দাদার তৈরি ঘরটিতে।
সে যাকগে আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। পঞ্চম শ্রেণীতে হাজী মোহাম্মদ মহসীন বৃত্তি লাভ করেছিলাম, আর এই সুবাদেই আমাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছিলেন বাবা-চাচারা। বড় মামা তো এ সংবাদে মহাউৎফুল্ল। কেন না আমার লেখা পড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল তাঁর হাতে। বড় মামাই আমাকে অ, আ, ক, খ, লেখা শিখিয়ে ছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সুঠিয়াকাঠী জুনিয়র গার্লস্ স্কুলে পড়াশুনা করেছি। তারপর হঠাৎ করেই বড় মামা মোজাফফর আলী এসে বাবাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাকে রংপুরে তার কাছে নিয়ে রাখতে চাইলেন। প্রথম দিকে বাবা সম্মত না হলেও, ছোট চাচা ও মোদাচ্ছের আলী চাচার উৎসাহে অবশেষে রাজী হলেন বাবা। এই প্রথম নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে অনেক দূরে পড়তে যাবার উত্তেজনা গ্রামের সব খেলার সাথীকে রসিয়ে রসিয়ে বললাম। খেলার সাথী মেয়েদের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে, কিন্তু ওদের কারো নামই এখন স্বরণ নেই। কেউ বেঁচে আছে কিনা তাও জানিনা। থাকলেও কাউকে চিনবো না এখন। তবে নাজমা নামের একজন ঐ সময় আমার খুব ঘনিষ্ট ছিল।
ইতিপূর্বে দাদীমার সাথে তাঁর বাপের বাড়ি কিম্বা বোনের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। নৌকায় করে সে সব যাত্রা, দিন রাত নৌকায় কাটানোর অভিজ্ঞতা ঐ কিশোর রয়সেই ছিল। ষ্টীমার, ট্রেন নাম শুনেই তো আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল। যদিও গ্রামের সীমানায় নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বহুবার স্টীমারের দুলে চলা দেখে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকেছি। কিন্তু চড়ার সুযোগ কখনো হয়নি। চড়বোই বা কি করে নদী পথে কাছাকাছি গ্রাম ছাড়া দূরে তো কোথাও যাইনি। তবে হ্যাঃ, একবার সোহাগদলের ইন্দের হাটে হিন্দুদের মেলায় গিয়েছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে চড়কায় চড়েছিলাম। বাবা জানতে পেরে খুব রাগ করলেও ছোট চাচার জন্যে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম।
আমাদের বংশীয় লোকেরা গোড়া মুসলিম হলেও পর্দা প্রথায় তেমন গুরুত্ব দিতেন না, যারফলে পর্দাটা কখনোই বিষয় হয়ে ওঠেনি। যদিও এ নিয়ে গ্রামে বেশ কানাঘুষা চলতো। তবে বাবা চাচারা কখনো আমল দিতেন না। আমার বুঝতে শেখার বয়স থেকেই দেখেছি বাবাকে গ্রামের সকলে সমীহ করে চলত। তিনি যে পথে হাঁটতেন সে পথে গ্রামবাসীরা দাঁড়িয়ে আগে তাকে যেতে দিতেন। বাড়ির ভিতরে বাহিরের পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কারো বেশী প্রয়োজন হলে কাচারী ঘরে অপেক্ষা করতেন। কাচারী ঘরটি মূলত বিচার কার্য পরিচালনার জন্যেই ব্যবহার হতো। নাজেমউদ্দীন আকন্ পঞ্চায়েত প্রধানের দায়িত্ব বাবার হাতে সঁপে ছিলেন বলে গ্রামের বিচার কার্য বাবাই পরিচালনা করতেন।
বাবার হাতে এ দায়িত্ব তুলে দেয়ার নেপথ্যে একটি ঘটনা ছিল। একবার কোনো এক মামলার বাদী এসে নাজেমউদ্দীন আক্নের ঘরে কিছু আম দিয়ে গিয়েছিল। সব সময় আমাদের বাজার এভাবেই নৌকা করে অন্য লোকে দিয়ে যেতো বলে বাড়ির মহিলারা তা নিয়ে ভাবতো না। খেতে বসে নাজেম ব্যাপারী আম দেখে খুব অবাক হলেন, জিজ্ঞেসাবাদ করে যখন বুঝতে পারলেন এটা বাদীপক্ষ দিয়ে গেছে এবং ইতিমধ্যে এই বাড়ির ছেলেরা তা খেয়েছে শুনে তিনি খুব রেগে গেলেন এবং বাড়ির সব ছেলেদের ডেকে তখনই তিনি ছেলেদের মুখে আঙ্গুল পুরে বমি করিয়ে আম বের করে আনলেন। সেদিনই নিজে পিরোজপুর চলে যেয়ে পঞ্চায়েত প্রধান হতে ইস্তফা দিয়ে আসেন। এরপর বাবাকে ডেকে দায়িত্ব তুলে দেয়া হলো বাবার হাতে। দীর্ঘ ৫২ বছর এভাবে আমাদের বংশের লোকেরাই এ থানার পঞ্চায়েত ও প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব পালন করে।
দুই
১৯৩১ সালের বর্ষাকালে মামার হাত ধরে নৌকায় চড়লাম, গন্তব্য রংপুর। মামা তখন রংপুরের ডেপুটি কালেক্টর। নৌকাযোগে আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় তিন ঘন্টার পথ কাউখালী স্টীমার ঘাটে যখন পৌঁছলাম স্টীমারটি তখন ভো ভো হুইসেল দিয়ে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হলুদ রংয়ের বিশাল সে জলযানটি আমার কিশোরী মনে আতংকের জন্ম দিয়েছিল। মামার হাত জড়িয়ে ধরে চড়ে বসেছিলাম যানটিতে। মামা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্টীমারের সব কিছু দেখিয়ে আমার ভয় কাটানোর চেষ্টা করেছিলেন। বিশাল বিশাল সব ইঞ্জিন দেখে আমি খুব অবাক হলাম। কথা কম বলা আমার স্বভাব ছিল বলেই মামাকে কোন প্রশ্ন করতাম না। নিশ্চুপ দেখে যেতাম, পড়ে শুনেছি সে যাত্রা নাকি আমি খুব উপভোগ করেছিলাম। মামার ধারণা ছিল আমি খুব কান্নাকাটি করবো, পরিচিত গ-ি বাবা-মা ভাই-বোন ছেড়ে অনেক দূরে যাচ্ছি, কান্নাকাটি করাটাই স্বাভাবিক কিন্তু স্টীমারের সাথে সাথে আমিও সব কিছুকেই নিজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শিখেছিলাম ঐ টুকু বয়সেই।
আমি যে বছর বৃত্তি পেলাম, সে বছর বরিশালে লবন আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। মহত্মাগান্ধি তখন বরিশালে এসে কর্মিদের উৎসাহিত করেছেন, বাবা-চাচাদের মাঝেও সে ব্যস্ততা দেখেছি, সে সময় শেরে বাংলা ঘনঘন আমাদের গ্রামে এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে যেতেন। এসব কিছুই আমি স্বাভাবিক বলেই ভাবতে শিখেছিলাম। লবন আন্দোলনের ফলে বাড়ির রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় লবন নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে নারিকেলের ডগাপুড়ে ছাই করে সে ছাই পানিতে ভিজিয়ে লবন উৎপাদন করতাম আমরা। বিদেশী কাপড় বর্জন, ভারত ছাড় শ্লোগান- এ সব ছোটবেলা থেকেই দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুই বুঝতাম না তখন, জানতাম না মহত্মাগান্ধি কি, জিন্নাহ, বা শেরে বাংলা কেন? তবে আমাদের গ্রামের লোকের কাছে হক ভাই বা শেরে বাংলার নামটা ছিল যাদুমন্ত্রের মতই সমস্যা সমাধানের অবলম্বন। বলাবাহুল্য যে, এই লবন আন্দোলনের সুত্র ধরেই বাকেরগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে বরিশাল জেলা করা হয়েছিল, বরিশল্ট থেকে বরিশাল হয়েছে বলে শুনেছিলাম।
স্টীমারে করে মহাত্মগান্ধী এসেছেন, শেরে বাংলা আসছেন, ইত্যাদি শুনে শুনে আমিও বুঝি স্টীমার প্রেমিক হয়ে উঠেছিলাম, যার জন্যেই হয়ত বড় মামা স্টীমারে কাটানো দু’দিন-দু’রাতের মধ্যে আমাকে একবারও মনক্ষুন্ন দেখেন নি, কিন্তু খুলনা পৌঁছে রানাঘাট থেকে যখন সাপের পেটের মধ্যে ঢুকতে বলা হল তখন আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। অবিকল সাপের মতই হুইস হুইস শব্দে দাঁড়িয়ে থাকা এ যানটি যে ট্রেন তা মেনে নিতে বেশ সময় লেগেছিল। ট্রেনের পেটের ভিতর শুয়ে থাকার ব্যবস্থা, টয়লেট ইত্যাদি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। তখনকার দিনের কয়লা চালিত ইঞ্জিন ট্রেনের বগিগুলো টেনে নিয়ে যেত। দু’পাশে বাড়ি ঘর ফেলে রেখে লোহার চিকন পাতের উপর ছুটে চলা ট্রেনের সাথে আমার মনটাও বুঝি বারবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল। সারাটা পথ বুঝি খুব কেঁদেছিলাম। তবে প্রতিটা ষ্টেশনেই অবাক হয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকতাম। নতুন নতুন শহরের মুখ ঐ প্রথম দেখতে শিখেছিলাম। বড় মামা ষ্টেশন এলেই নেমে যেয়ে আমার জন্যে একটা না একটা খাবার কিনে আনতেন। বললে হয়তো হাসি পাবে, আমার ধারণা ছিল এক একটি শহরের মানুষের মাঝে দৃশ্যপটের মাঝে অনেক পরিবর্তন দেখা যাবে কিন্তু সবগুলো ষ্টেশনই আমার কাছে একই রকম মনে হয়েছিল। কখনো নদীর পাড় ধরে, কখনো নদীর উপর দিয়ে ছুটে চলা ট্রেনটি যেন ঘুরে ফিরে একই ষ্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল, আমার সেটাই মনে হচ্ছিল। খুব সম্ভব দশ বারোটি ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেন। দু-দিন লেগেছিল পার্বতীপুর নামের ষ্টেশনে পৌঁছতে। পার্বতীপুর থেকে আবার ট্রেনে চড়ে রংপুর পৌঁছে ছিলাম দুপুরের দিকে।
তিন
কালি ঘুটি কালি ঘুটি
আল্লাহর নাম টান
যার দোয়াতে ভাল কালি
আমর দোয়াতে আন”
হাতের লেখা একটু খারাপ হলেই আমরা বাচ্চারা এ ধরণের শ্লোক আউড়াতাম। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি কলম কালি পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লিখতে হতো। কালি পানি রাখা বোতলটিকেই দোয়াত বলা হতো। রংপুরে বড় মামার ছেলে মেয়েদের সাথে একত্রে পড়াশুনার ফাঁকে এ ধরনের শ্লোকের ব্যবহার ছিল অজ¯্রবার। আজকের মতো তখনকার সময়ে কোনো বলপেন, ফাউন্টেনপেন ছিলো না। নিজেদেরকেই বিভিন্ন উপায়ে কালি বানিয়ে নিতে হতো। বড় মামার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে মেয়েরা পড়ত রংপুর গভর্মেন্ট গার্লস্ স্কুলে, ঐ স্কুলেই সপ্তম শ্রেণীতে আমাকে ভর্তি করে দেয়া হলো।
রংপুর শহরটি বেশ বড়। শ্যামাসুন্দরী নামের একটি খাল শহরটিকে ঠিক মাঝখান দিয়ে বিভক্ত করেছে। একদিকের নদী থেকে খালটির উৎপত্তি হয়ে বিপরীত দিকে বহমান তিস্তার সাথে গিয়ে মিশে ছিল। এর ফলে, শহরের ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি জোয়ার ভাটার সাথে শহর থেকে মুছে যেত। শ্যামাসুন্দরী নামকরণের পিছনে ছিলো এ খাল নির্মাতার অবদান। কেননা, তৎকালীন কারজীরহাম পরগুনাধীন ডিমলার রাজবধূ ছিলেন চৌধুরাণী শ্যামাসুন্দরী দেবী। তারই সন্তান ছিলেন রাজা জানকি বল্লব সেন। ১৮৫২ খ্রীঃ হঠাৎ করে ডায়রিয়া জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্যামাসুন্দরী মারা গেলেন। রাজা বল্লব সেন তখন শহরের সমস্ত রোগ জীবাণু দূর করার জন্য এই খাল খনন করান। আমাদের গার্লস স্কুলের ঠিক পিছন দিয়েই চলে গেছে এই শ্যামাসুন্দরী খালের একটি অংশ। এখনকার নিউ ইঞ্জিনিয়ারিং পাড়াতেই সম্ভবত আমার ফেলে আসা স্কুলটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এখানে প্রথমদিকে ছিলাম কেরানী পাড়ায়। পরবর্তীতে মুন্সীপাড়া, পালপাড়া ও সেনপাড়ার ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেছি। কাছাকাছি লাগোয়া এই পাড়াগুলোর শুধু মাত্র মুন্সি পাড়াতেই তখন মুসলিমদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিল। অন্য পাড়াগুলো ছিল হিন্দু প্রধান। গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যে তখন তিন-চার জনের বেশী মুসলীম মেয়ে ছিল না। আমাদের সময় খুব সম্ভবত শেফালী ঘোষ ছিলেন রংপুর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি খুব কড়া টিচার ছিলেন। তার ক্লাশে সব মেয়েকেই পড়া তৈরি করে আসতে হতো। গার্লস স্কুলে আমার সহপাঠী ছিল রেজিনা বেগম নামের একটি মেয়ে। পরে শুনেছি ও ছিল জাহানারা ইমামের স্বামী শফি ইমামের ছোট বোন। টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল রেজিনা। একই সময় আমার ইমিডিয়েট বড় বোন ফরিদা মারা গিয়েছিল বলে ওর কথা আজও মনে আছে।
মামাতো ভাই-বোনদের সাথে খেলা-ধূলা তো করতামই, আবার বাড়ির জন্য মন খারাপ করে বসেও থাকতাম। পুর্বেই বলেছি কথা কম বলা আমার স্বভাবজাত। বিষয়টি মামাতো বোন-ভাইয়েরাও মেনে নিয়েছিল। বাহিরে খুব একটা বেড়াতে যেতাম না। ওদের চাঁপে কখনো-সখনো তিস্তার পাড়ে গিয়েছি। অন্য মুসলীম মেয়েরা তখন বোরখা পরেই আসতো। ওখানে বোরখা পরাটা বাধ্যতামুলক হলেও মামার উৎসাহে আমি এবং মামাতো বোনেরা বোরখার ব্যবহার খুব একটা করতাম না। তবে হ্যাঁ মাথার কাপড়টা আঁট-সাঁট করে বেঁধে রাখতাম। এদিক দিয়ে হিন্দু মেয়েদের খোলা-মেলা পোষাক পরিচ্ছদ আমার দৃষ্টি কাঁড়তো। ওদেরকে খুব ভাগ্যবান মনে হতো। আমরা যেহেতু বেশীর ভাগ সময় হিন্দুপাড়ার ভেতর বসবাস করেছি তাই কীর্তনপালা, ভোজালী, আলকাপ, দূর্গাউৎসব জাতিয় অনুষ্ঠান খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। বড় মামা অবশ্য আমার জন্যে অনেক বড় বড় লেখকের বই নিয়ে আসতেন। উপন্যাস পড়তে আমার খুবই ভাল লাগতো।
চার
কলিংবেল বাজছে। এবার বুঝি নূর এলো। আজ ক’দিন ধরে ওর শরীর আরো খারাপ হয় পড়েছে, ব্যাকবোনের ব্যাথাটা বেড়েছে। নূর যে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে তা ওর মন মানতে পারছে না। আমি বেশ বুঝি, এ বছর ওর বয়স ৫৪ পেরিয়ে ৫৫ তে পরবে। অথচ ওর ব্যস্ততা ছুটোছুটি এখনো সেই তরুণ বেলার মতোই। এতোদিন শুধু অভিনয় আর অফিস নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এখন আবার ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে। ওর বাবাও ছিল এমন ধারার। তার কথা মনে আসতেই একটা চাঁপা ক্ষোভ জেগে ওঠে মনে, কী চমৎকার হাসি-খুশি মানুষটি আমাকে একা রেখে নির্দ্বীধায় চলে গেলেন।
এ যুগে তোমরা যারা এ লেখা পড়ছো, তাদের কাছে হয়তো খুব অবাক লাগছে – স্বামীকে আপনি সম্মানে কথা বলছি বলে। আসলে তখনকার দিনের নিয়মই ছিল এমন। আমর মা, বাবাকে আপনি সম্বোধন করতেন। যারা বলে, আপনি সম্বধোন অনেক দূরের। তারা আসলে ভুল বলেন। বরং আমি দেখেছি, আমার বাবা-মায়ের মধ্যে যে ভালবাসা, একে অপরের প্রতি যে আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিলো তা বর্তমানের অনেক “তুমি” সম্বোধনের পরিবারেই নেই। শুনেছি এটা ছিলো আমাদের পারিবারিক রেওয়াজ। আমার দাদীতো প্রচন্ড দাপটের সাথে তাঁর সংসারকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। দাদা মারা গেছেন আজ ১০০ বছর পার হয়ে গেছে। ১৮০০ শতকের শেষ দিকে খুব সম্বব ১৮৯০ কিংবা ৯৬ এর কোন এক সোমবারে দাদা মারা গেলেন। দাদীমার তীক্ষèবুদ্ধি আর কৌশলে পরিবারটি এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হল যে, আজ পর্যন্ত সম্পত্তির ভাগাভাগি কিম্বা জুদা (ভিন্ন) শব্দটির সাথে আমাদের বংশের কেউ পরিচিত নয়। এমন কি চাচাত-ফুপাত ও সৎ ভাইদেরকেও আলাদা করার কোন উপায় নেই। এটা ছিল আমাদের পারিবারিক রীতি। আমার যখন সাত বছর বয়স হলো, নামাজ পড়া শিখলাম, তখন বড় চাচী এবং মাকে দেখেছি সংসারের কাজ করতেন দাদীর পরামর্শে কিন্তু শতকর্মের মাঝেও স্বামীর জন্যে অপেক্ষা, স্বামীর সেবায় নিজেকে ধন্য করা ছিল তাদের ব্রত। না এ ব্রত বেহেশ্ত পাবার লোভে নয়। এটা ভালবাসা, গভীর ভালবাসা। বাবা আমার মাকে তুমি সম্বোধন করতেন, বাহির থেকে ফিরে সালাম দিতেন। কোন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করতেন। বাড়ির সম্মুখে বিশাল কাচারী ঘরটি চাচাত দাদা নাজিম উদ্দীন তৈরি করে গিয়েছিলেন। ওখানে বসেই পঞ্চায়েত প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন বাবা।
বাবা হেলালউদ্দীন সাহেবকে সবাই ডাকতেন মেজ মিঞা বলে। প্রচন্ড রাশভারি লোক ছিলেন তিনি। পথ দিয়ে যখন চলতেন সম্মুখের লোকেরা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যেতো। যতক্ষণ না বাবা তাদের পার হয়ে কোন আঢ়ালে চলে না যেতেন ততক্ষণ কেউ নড়ত না। না ভয়ে নয়, কারণ ভয় পাবার মত কোন আচরণ বাবা – চাচারা কোন মানুষের সাথে কখনোই করেন নি বরং ব্যক্তিত্ব আর ভালবাসা দিয়ে এমনভাবে জয় করেছেন যে, একটানা ৫২ বছর সুঠিয়াকাঠী ও তার আশে-পাশের গ্রামের বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন আমারই বাবা-চাচারা। ফলে, গ্রাম বাসীদের শ্রদ্ধা-সম্মান ও ভালবাসা তার আদায় করে নিয়েছিলেন। এমনকি বর্তমানেও ওখানকার চেয়ারম্যান হিসেবে ছোট চাচার ছেলে জাহিদের বেশ নাম ডাক রয়েছে।
বাড়ির সাথে আমার যোগাযোগ স্কুল জীবনের পর খুব কমে গিয়েছিল। এমনিতেই একটু অমিশুক টাইপের মানুষ ছিলাম আমি। কথা-বার্তা বলতাম না বলে অনেকে হয়তো দেমাগী ভাবতো কিন্তু এ নিয়ে আমার মধ্যে কোন হেজিট্রেশন ছিল না। আমার সমস্ত চিন্তা ভাবনা ক্রমশ রংপুর শহরকে ঘিরেই বেড়ে উঠছিল। যদিও স্কুল ও বাসা ছাড়া আমার আর কোন গন্তব্য ছিলো না। আমাদের সময়ে স্কুলে নিয়মিত এসেম্বলী হতো। তখনকার সময়ে তো আর সোনার বাংলা জাতীয় সংগীত ছিলো না, আমরা গাইতামÑ
“জনগণ মন
অধিনায়ক মম- জয় হে
ভারত ভাগ্য বিধাতা-
জয় হে- জয় হে”-
আমরা সমবেত কণ্ঠে এ গানটি গাইতাম। কখনো কখনো বাসায় বসে মামাতো ভাই-বোনদের সাথে কণ্ঠ মিলাতাম। একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিলো এ গানটিতে। তখন কিন্তু জানতাম না এটি রবীন্দ্র সংগীত। বড় মামার পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। সকলের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল একই রকম। ওরা সবাই আমাকে সাহায্য করত। আমার ভাই হেমায়েতউদ্দীন কাঞ্চন বিয়ে করেছিল বড় মামারই বড় মেয়ে জোস্নাকে। বড় মামার পাঁচ ছেলেদের মধ্যে সবার বড় সমশের আলী পরবর্তীতে বরিশালের নামকরা এ্যাডভোকেট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ছেলে আশফাক আলী রেলওয়ের প্রকৌশলী। একছেলে পটল, সে ডেটালারী সার্জন, আরেকজন লাল, আর্ট স্কুল থেকে পাশ করে আর্টিস্ট হিসেবে বেশ নাম করেছিল লাল এবং মেয়ে পেয়ারা মাইজদী কলেজের প্রফেসর হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করছিল। বর্তমানে তারা কেউই বেঁচে নেই। আসলে বিয়ের পরে নিজের সংসার চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরার ফলে নিজ জেলা থেকে দূরে নীলফামারীতে বসবাস করাতে আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা কম হতো। তারাও কর্মস্থলে এখানে ওখানে বাস করতো বলে, দেশে তাদের খুব কমই আসা হতো। তবে কে কোথায় আছে সে খবর ঠিকই পেতাম।
রংপুরের স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে যখন পড়ছি ঠিক তখন-ই বড় বোনের বিয়ের সংবাদ পেলাম। রংপুর থেকে নৌকায় করে পার্বতীপুর সেখান থেকে ট্রেনে খুলনা এবং খুলনা থেকে রকেটে কাউখালি তারপর নৌকায় বাড়িতে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে নূরজাহানের বিয়ে হল গোপালপুরের কাজী বাড়ির ছেলে আব্দুর রউফের সঙ্গে। ঐ সময় উর্দূ স্কুল থেকে পঞ্চম ক্লাস পাশ করায় কলকাতা গেজেটে বড় বোনের নাম ছাপা হয়েছিল। যে নাম দেখে ছেলে পক্ষ সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। ছেলে পক্ষ যখন কনে দেখতে এলো, তখন আমাদের বাড়ির মেয়েদের বিশেষ করে আমাকে মুখে মুখে ইংরাজী বলতে দেখে ওদের ধারণাই জন্মে গিয়েছিল যে এ বাড়ির প্রতিটি ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষিত। বিয়ে বাড়ির তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী কনের বাড়িতে ধুম পড়ে গেল, নতুন পুকুর কাটা হলো। ঐ সময়ে কাচারী ঘরের সম্মুখের পুকুরটি বুজিয়ে দেয়া হলো। খুব সম্ভবত ১৯৩১ সনের শেষের দিকের কথা এটি।
পালকী চড়ে নবদম্পতিকে নৌকায় তুলে দেয়া হলো। আমাদের বড় বজড়া নৌকায় করেই পৌঁছে দেয়া হলো জামাই বাবুকে তার বাড়িতে। পরবর্তীতে এই জামাই বাবুর কাছেই ইংরাজী শিখেছিলাম আমি। তখনকার নিয়মে কনের সাথে আত্মীয়-স্বজন কেউ যেত না, শুধু একজন দাসীকে সঙ্গে দেয়া হতো। বিয়ে বাড়ির আনন্দ উৎসব ও ছিল ভিন্ন রকম। ভিতর বাড়িতে মেয়েদের মধ্যে মেহেদী-হলুদ বাটার ধুম পরে যেত। বাহিরে পুরুষরা মাছ ধরার পাল্লা দিতো। সবচেয়ে বড় মাছটি যে ধরতো তাকে পুরস্কার দেয়া হতো। পুরস্কারটি ছিল আরো ভিন্ন রকম, বরের পাশে বসে মাছের মাথাটি ভাঙ্গার সুযোগ তাকেই দেয়া হতো। নাজেম দাদুর তৈরি কাচারী ঘরটি বাবা পুনঃনির্মাণ করলেন ঐ সময়। পুকুর থেকে বড় মাছটি ধরে বিয়ে বাড়িতে রান্নার রেওয়াজ তখন। অনেক বড় বড় রুই, কাতল আর বোয়াল ছিল খাবারের প্রধান আকর্ষণ। সবশেষে বাতাসা আর দধি না হলে গ্রামের মানুষের তৃপ্তি হতো না। ছানার তৈরি দানাদার এবং সন্দেশ লুঙ্গির কোঁচায় কিম্বা শাড়ীর আঁচলে পেঁচিয়ে বিয়ে বাড়ির খাবারের গল্প করতে করতে পথ দিয়ে হেঁটে যেত গ্রামবাসী। মুখে পুড়ত বাতাসা, সন্দেশ। এটাই ছিল তখনকার রীতি। আরেকটা বিষয় খুব উল্ল্যেখযোগ্য যে, আমাদের সময় কিন্তু কনে পক্ষকেই যৌতুক দিয়ে বরের পক্ষ কনেকে নিয়ে যেত। যা এখনকার দিনে তোমরা কল্পনাই করতে পারবেনা।
পাঁচ
রংপুরের স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলাম। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে যখন পড়ছি তখন আমরা মুন্সিপাড়া নামক স্থানে বাড়ি ভাড়া করে থাকতাম। শহরের প্রধান বাহন বলতে অভিজাতদের জন্যে ঘোড়ার গাড়ি আর অন্যরা পায়ে হাঁটা ছাড়া গতি ছিলনা। মাঝে মধ্যে গরুর গাড়ীও চলতো তবে, তা মালামাল বহনের জন্য। আমি এবং মামাতো বোনরা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেতাম। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়টায় আমরা হিন্দুপাড়ায় বাসা ভাড়া করি। গোমস্তা পাড়াতেও ছিলাম কিছুদিন। এই সময়টায় বাড়ির সাথে যোগাযোগ একেবারেই কমে গিয়েছিল। ততদিনে আমার অন্য ভাইবোনরা জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছিলো। গ্রীষ্মের বন্দে গ্রামে যেয়ে ওদের সাথে খেলা করতাম। বাড়িতে আমি হয়ে গেলাম অতিথির মতোন। পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলাম বলেই হয়তো বাড়ির অন্যদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল আমার উপর। ছোট চাচা আতাহারউদ্দীন আহমেদ তখন বিয়ে করেছেন। বরিশালের ফকির বাড়ির মেয়ে হাজেরা বেগম শিক্ষিত মেয়ে ছিলেন। বাড়িতে গেলে তার সাথেই আমার সময় কাটতো বেশী। শিক্ষিত বলতে পাঁচ ক্লাশ পর্যন্ত পড়েছিলেন ছোট চাচী। তখনকার দিনে পাঁচ ক্লাশ মানে মেয়েদের জন্য বিশাল পড়া। ছোট চাচী আমার তুলনায় বছর দু’একের বড় হবেন। বরিশালে তখন আহঞ্জী বা আকন্ বংশ এবং ফকির বংশের বেশ নাম ডাক ছিল। এ দুই বংশ প্রধানরা তাদের সন্তানদের ধর্মীয় শাসনে সুশিক্ষিত করে তুলতে ব্যস্ত ছিলেন বলে আশে পাশের অন্য বংশীয়রা তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ধনী ও সম্ভ্রান্তদের দৃষ্টি ছিল তাদের ছেলে-মেয়েদের উপর। ছোট চাচার সাথে ছোট চাচীর বিয়েটা তাই অতি সহজেই সম্ভব হয়েছিল। কাঞ্চন, আমি এবং রাজা সর্বক্ষণ ছোটচাচীকে ঘীরে থাকতাম। তার আদর – প্রশ্রয়ে আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুটির জন্যে আবদারও ছিল ছোটচাচীর কাছে। আগে আমি যে কাজগুলো করতাম, সে কাজগুলোর দায় চেঁপেছে এখন কুসুম ও রেনুর উপর। রেনুর ছোট আরও চার ভাইবোন ছিল আমার। মহিউদ্দিন আহমেদ রাজার বয়স তখন ৭ বছর হবে। ওর ছোট কবিরউদ্দিন আহমেদ মনু নামের ভাইটি। সবার ছোট রওশন আক্তার বুড়ি যখন জন্মগ্রহণ করেছে আমার তখন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা। পিরোজপুর গার্লস স্কুলে আমার সিট পড়েছিল।
ডেপুটি কালেক্টর বড় মামা হঠাৎ ঠাকুরগাঁও বদলী হয়ে গেলেন। আমার তখন মাত্রই দশম শ্রেণীর ক্লাশ শুরু হয়েছিল। অনেকটা বাধ্য হয়েই গ্রামে ফিরে এলাম। অল্পদিন পরেই ছোট মামা আলতাফ আলী এসে আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তখন কলকাতায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন। ছোট মামা আমাকে আউটার সার্কুলার রোডের কলকাতা ব্রাহ্মণ স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ১৯৩৯ সালে মোট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলাম এই ব্রাহ্মণ গার্লস স্কুল থেকে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তখনকার দিনের নিয়মে বিশেষ ব্যবস্থায় মেয়েরা যার যার এলাকা বা বাড়ির নিকটস্থ স্কুলে সেন্টার চাইতে পারতো। আমার অবিভাবকরাও তাই চেয়েছিলেন। সে জন্যেই আমি পিরোজপুর থেকে মেট্রিক দিতে পেরেছিলাম। ঐ সময় আমাদের বাড়ির চাচাত-মামাত ভাই-বোনরাও পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার বোনেরাও প্রত্যেকেই স্কুলে যেত। বাড়ির লোক সংখ্যা এতো বেড়ে গিয়েছিল যে খেতে বসলে পরিবেশনরত মহিলারা হাঁপিয়ে উঠতেন। কিন্তু কোনো গোলমাল বা ঝগড়া-ঝাটি কখনোই হতো না।
আমার বড় চাচা আদিলউদ্দীন আহমেদের তখন চার ছেলে দুই মেয়ে ছিল। তিনি কৌড়িখারা গ্রামের মিয়া বাড়িতে বিয়ে করেছিলেন। তবে বিয়ের কিছুদিন পর যখন দু’ছেলে আবু ও কিসলু জন্ম গ্রহণ করেছে তখন তার পরিবারের এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। পরিবার বড় হবার সাথে সাথেই আমাদের বাড়িতে ঘরের সংখ্যা বাড়ছিল। বড় চাচা ঘর তুলেছিলেন কাচারী সংলগ্ন পূর্ব পাশে। এখানে পূর্বেও আমার দাদাদের কেউ ঘর তুলেছিলেন। শুনেছি এক রাতে কোন এক বুড়ি নাকি সাত কলসি স্বর্ণ মোহর নিয়ে ঐ দাদার ঘরে এনে তুলেছিলেন আর বাড়ির মহিলাদেরকে তা দিয়ে বলেছিলেন, “নে ধর, মনসার ধন তোদের বংশের জন্যে নিয়ে এলাম। আমাকে এখান থেকে অল্প কিছু দে”। দাদা তখন ঘরে ছিলেন না। কপালে ছিলো না বলেই হয়ত বাড়ির মহিলারা তাদের গাঁয়ের সব স্বর্ণলংকার খুলে বুড়িকে দিতে চাইলো তবু ঐ ঘটি থেকে দিলো না। আর দিলো না বলেই নাকি সব কলসি সাপে পূর্ণ হয়ে গড়িয়ে পাশের-ই একটি ডোবায় পড়ে গেল। ভয়ে আতংকে কেউ আর ঐ ডোবায় নামে না। এদিকে বুড়ির অভিশাপে বংশের একজন করে যুবক-যুবতী আজো পাগলামি রোগে ভুগছে। ঐ দাদার বংশ এভাবেই নির্বংশ হয়ে গিয়েছিলো। আদিলউদ্দীন চাচা এ ঘটনা জেনেও ঐ ঘরটি পুনঃনির্মাণ করেছিলেন এবং ওঘরেই সংসার পেতে ছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই চাচা-চাচীদের মাঝে আতংক দেখা দিল। ঘরের এখানে ওখানে সাপ আর সাপ। রাতে ঘুমাতে গেলে বিছানায় সাপ দেখেন তারা। পর পর দু’টি সন্তান জন্ম নিয়েই মারা গেল। এবার ভয় পেলেন বড় চাচা। নতুন বাড়িটি করার তিন মাসের মধ্যে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে শশুরবাড়ি বরিশালে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। আজ পর্যন্ত তার বংশধররা সেভাবেই বরিশাল শহরে আছে। কিসলু, চারু, মালেক জীবিত আছে এখনো। নেই শুধু আবু বড় মিয়া। শুনেছি কিসলুর শারীরিক অবস্থাও ভাল নেই।
আজহারউদ্দীন আহমেদ আমার সেজ চাচা মারা যাবার আগে তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। ছেলেটি এখন বাগেরহাটে সেটেল করেছে। নোয়া (৪র্থ) চাচা সফিউদ্দীন আহমেদ এর এক ছেলে ডাঃ হাবিবুর রহমান ও এক মেয়ে মেরী। বর্তমানে মেরীই শুধু বেঁচে আছে।
কফিলউদ্দীন আহমেদ চাচার সাত ছেলে পাঁচ মেয়ে। বর্তমানে সবাই বেঁচে আছে ওরা। বাদশার ছেলে মেয়েরাও এখন অনেক বড় হয়েছে। আর ছোট চাচা আতাহারউদ্দীন এর ছয় ছেলে চার মেয়ে। শেষপর্যন্ত এদের সাথেই দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিলো। এখনো অল্প বিস্তর যোগাযোগ আছে সকলের সাথেই। দুলু, তৌহিদ-জাহিদ ও খালিদ ওরা এখনো পারিবারিক ঐতিহ্য আঁকড়ে পড়ে আছে সুঠিয়াকাঠী গ্রামে। কাঠের ব্যবসা নিয়েই ওদের জীবীকা। শুনেছি দুলুর এক ছেলে এক মেয়ে নাকি পাগলামি রোগে আক্রান্ত। গ্রামবাসীরা বলে এটা সেই অভিশাপের ফল। আমি বলি পুষ্টিহীনতা বা ঐ জাতীয় কোন রোগে আক্রান্ত ওরা। জাহিদ বিয়ে করেছে চাচাতো বোন ফেন্সিকে। ফেন্সির ভাল নামটা যে কি এখন আর মনে নেই। ওদের ঘরেও দুই ছেলে মেয়ে আশেক ও সুপ্রীতি।
তোমাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে যে আমাদের বংশে গোড়া থেকে নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা বেশী। আসলেও তাই। আমার ভাইয়েরাও নিজেদের মধ্যেই বিয়ে করেছে। শুধু আমি এবং আমার বোনরাই এই প্রবণতার বাহিরে ছিলাম। আমার বোনদের কিন্তু তৎকালীন পিরোজপুর মহাকুমার ভিতরেই বিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি কি করে অতদূরে ছিটকে পড়লাম সে প্রশ্ন অনেকেরই। সে কথায় একটু পরে আসছি। তবে হ্যাঁ, ভাললাগা বা ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধাটা বরাবরই ছিলো। যেহেতু জানি নিজেদের আত্মীয়দের মাঝে ওদের এইযে বিয়ে করা এর পিছনে ভালবাসার টানই ছিল প্রধান দায়ী। যার জন্যে কাঞ্চন কিংবা রাজার বিয়েটা মেনে না নিয়ে উপায় ছিলো না। রাজা বিয়ে করেছিল ছোট চাচার মেয়ে খালেদা খানম বীণাকে। ঠিক তেমনি আজ আমার মেয়ে ফোয়ারার বিয়েটাও মেনে নিতে হয়েছে। খোলামেলা ভাবে সবার কথাই খুব লিখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু ধৈর্য্যে কুলোচ্ছে না। আসলে আরো আগে লেখা শুরু করা উচিৎ ছিল। এখন তো বেশীক্ষণ বসে থাকতেও পারি না। সবকিছু মনেও রাখতে পারিনা, তাই যখন যেটা মনে পড়ছে খাপছাড়া ভাবে সেটাই লিখে যাচ্ছি। আরিফ তুমি যতটা পারো মিলিয়ে নিও।
আমাদের বাড়ি থেকে নানা বাড়ি খুব দূরে ছিলো না। পরীক্ষা শেষের সময়টা তাই গ্রামে বসেই কাটালাম। আমার মা-খালারা তিন বোন ও পাঁচ ভাই ছিলেন। মা ছিলেন বোনদের মধ্যে বড়। আমাদের বাড়ির সবচেয়ে নিকটতম বাড়িটি হচ্ছে নানা বাড়ি। শুনেছি নানা হাজী দলিলউদ্দীন সাহেবেরও কাঠের বড় ব্যবসা ছিলো। তিনি ছিলেন আমার দাদার চাচাতো ভাই হাজী হাজী নাজেমউদ্দীন ব্যাপারীর খুব ঘনিষ্ট বন্ধু। বাবা চাকুরী করতেন নাজেমউদ্দীন ব্যাপারীর ওখানে। সে সুত্রে হাজী দলিলউদ্দীন সাহেবের সংঙ্গে বাবার পরিচয়। পরবর্তীতে বাবার ব্যাবসায়িক বিষয় বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে আমার মাকে বাবার হাতে তুলে দিয়ে দুটি বড় ব্যবসাও বাবাকে লিখে দেন নানা। বাবার অবদানেই আমাদের বংশীয় ঐতিহ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। চাচারা সবাই ছিলেন বাবার অনুগত। তবে, বাবা কিন্তু বড় চাচা আর দাদীর পরামর্শ ছাড়া কিছইু করতেন না। আমার পাঁচ মামাদের কেউই কাঠ ব্যাবসায়ে আগ্রহী ছিলেন না। বড় মামা মোজাফফর আলী তো ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। তিনি বিয়ে করেছিলেন নাজেম ব্যাপারীর বড় মেয়ে। মেজ মামা আমজাদ আলী কলকাতায় চাকুরী করতেন। সেজ মামা মোবারক আলী ছিলেন কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং এর চাকুরে। চার নম্বর মামা তৈয়ব আলী ও ছোট মামা আলতাফ আলী কলেজ জীবনে আমার তত্ত্বাবোধায়ক ছিলেন। কলকাতাতেই থাকতেন তারা। ছোট মামা ছিলেন ডেনালারী ডিপার্টমেন্টের ডাইরেক্টর। আজ অনেক দিন হয় মামা মারা গেছেন। মামী তার ছেলেদের নিয়ে ওখানেই আছেন।
ছয়
পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে এখনকার মতো তখনও তিন-চার মাস দেরী হতো। আমাদের পারিবারিক নিয়মে ততোদিনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছিলো। চাচারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন ঘর তুলেছেন। সব ঘরেই চাচী-চাচাত ভাই-বোন। ওদের নিয়ে বেশ সময় কেটে যেত। মাঝে মধ্যেই আমরা মেয়েরা দল বেধে বজড়া নৌকায় ঘুরে বেড়াতাম। বেশীর ভাগ সময়টায় সন্ধ্যা নদী পাড়ি দিয়ে চলে যেতাম আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে। কখনো আবার কেরাম খেলার পাশাপাশি গ্রামোফোন রেকর্ডে আব্বাসউদ্দীনের ও নজরুল ইসলামের গজল শুনতাম। গ্রামোফোন নিয়ে তখন একজন লোক যাকে আমরা কলের গানওয়ালা বলে ডাকতাম, সে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান বা চালের বিনিময়ে গ্রামবাসীদের গান শোনাতো। আমাদের গান শোনার আগ্রহ দেখে ছোট চাচা ও ছোট মামা যুক্তি করে একদিন রেডিও কিনে ফেললেন। আর যায় কোথায়! এ নিয়ে গ্রামে তুমুল কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। বাবাতো রেগেই আগুন, তার উপর আবার শরছিনার পীর সাহেবের কাছেও নালিশ গেল। শরছিনার পীর নেছারউদ্দীন সাহেব এসব বিষয়ে খুব কড়া ছিলেন। যে বাড়িতে নামাজ রোজার একটু কামাই বা অনিয়ম সে বাড়ির কাছ দিয়ে তিনি হাঁটতেন না। আমাদের পরিবারে মেয়েদের মধ্যে পর্দার চলন ছিলো না বলে তিনি কখনো আমাদের বাড়ির পানিও স্পর্শ করতেন না। তিনি পালকী চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন, ইস্লামের দাওয়াত দিতেন এবং দরিদ্র অসুস্থ মানুষের সেবা করতেন। ছোট চাচার রেডিও কেনার সংবাদ তার কানে পৌঁছা মাত্র তিনি বাবাকে ডেকে পাঠালেন। এরপর কি ঘটেছিল বলতে পারবো না, তবে ছোট চাচা বাবার ভয়ে চারদিন ঘরে আসেন নাই। আমার পরীক্ষার ফল যেদিন বের হলো সেদিন কলকাতা থেকে কাঞ্চন ছুটে এসেছে। ও আমার রেজাল্ট জানতে আগেই কলকাতা গিয়েছিলো। আমি প্রথম বিভাগে পাশ করেছি শুনে বাবা চাচাদের মধ্যে সেকী উৎসব। বাড়ির সব ছেলে মেয়েরা খুব হল্লা করেছিল। আশে পাশের দশ গ্রামের লোকেরা ভিড় করেছিল আমাদের বাড়িতে। হবেনা কেন মুসলীম মেয়েদের মধ্যেতো আর উচ্চশিক্ষার প্রচলন ছিলনা। আমাদের অঞ্চলে যে আমিই ছিলাম প্রথম মেট্রিক পাশ মেয়ে। এটা অবশ্য ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসের কথা। এ বছরই ছোট চাচা ও ছোট মামা দু’জনের উৎসাহে আমাকে কলেজ পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। শেরে বাংলা ঐ সময় বাবর কাছে ছোট মামা মারফত চিঠি লিখে জানালেন, তিনি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য নিজেই একটি কলেজ তৈরি করেছেন। শেরে বাংলার প্রতিষ্ঠিত কলেজটির নাম দেয়া হয়েছে লেডি ব্রেবোন। পার্ক সার্কাসের একটি ভাড়া বাড়িতে দ্বীতল বিশিষ্ট লেডি ব্রেবোন কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন মিস ক্রোশ। দোতলায় মেয়েদের থাকার জন্য ছেড়ে দিয়ে নীচতলা ব্যবহৃত হতো শ্রেণীকক্ষ হিসেবে। রমাদি ও কমলাদি ছিলেন হোষ্টেল সুপার। চল্লিশ সনের মাঝামাঝি সময়ে লেডি ব্রেবোন পাশেই নিজস্ব ভবন তৈরি করে ফেলেছিল। নতুন ভবনের উদ্বোধনীতে কলকাতার অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসেছিলেন শেরে বাংলার সাথে। তাদের মধ্যে জিন্নাহ ও নেহেরু ছিলেন। আমরা দোতলার জানালা থেকে তাদের দেখেছি। সম্মুখে আসার কোন রেওয়াজ তখন ছিলো না। মেয়েদের অবসর সময়ের বিনোদন ব্যবস্থা হিসেবে তখন দাবা, ব্যাডমিন্টন ও কেরাম ছিলো প্রধান। দরজা জানালা সব সময় পর্দা ঘেরা ছিলো বলে পার্ক সার্কাসের ও বালিগঞ্জের লোকেরা বলতো পর্দা কলেজ। বালিগঞ্জ, বলছি এ কারণে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ সেনারা কলেজটিতে ঘাঁটি গাড়লে কিছুদিনের জন্যে লেডি ব্রেবোন কলেজটিকে বালিগঞ্জের ভাড়া বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। লেডি ব্রেবোন আমার চিন্তা চেতনায় অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। এখানে আমিও ব্যাডমিন্টন খেলতাম। এখানেই প্রথম রবীন্দ্র সংগীতের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল। এখানের নিয়ম শৃংখলায় কড়াকড়ি থাকলেও প্রিন্সিপাল মিস্ ক্রোশ নিজেই মেয়েদের সাথে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন। দেখতে দেখতে বছর কেটে গেল।
এই এক বছরে মাত্র একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কাঁদা পানি মাখা ঐ গাঁয়ের পথের কথা মনে হলে আজ যেমন সুখ, তখনকার ঐ ছাত্রী বয়সে কিন্তু খুব বিরক্তি এসে যেত। দু’বার ছোট চাচা ও মোদাচ্ছের আলী চাচা আমায় নিতে এলে আমি কলকাতায় ছোট মামার কাছে থেকেছি তবু গ্রামে যাইনি। এ সময় হঠাৎ করেই কলেজে ব্রিটিশ সেনারা প্রবেশ করে ঘাটি করল। অনির্দিষ্ট কালের জন্যে কলেজ স্থানান্তর করা হল বালিগঞ্জে। কিন্তু ২য় বিশ্বযুদ্ধের আয়োজনের ব্যাপকতায় শহরে থাকা বড় বিপদজনক হয়ে উঠলো। মাথার উপর দিয়ে ঘন ঘন প্লেনের ছুটে চলা, সাইরেনের শব্দ শোনা গেলেই ছুটে গিয়ে র্যাফেল দেওয়ালের পিছনে আশ্রয় নেয়া এসব ঝুঁকি সহ্য হলো না। ছোট মামাদের সাথে চলে এলাম গ্রামের বাড়িতে। এখানেও দেখি সেই একই আতংক। এই যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই লেডি ব্রেবোনের ছাত্রীদেরকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বলা হল, যার যার বাড়ির পাশের কলেজটিতেই পরীক্ষা কেন্দ্র করা হলো। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার, বাবা চাচাদের চেষ্টায় এখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা হলেও কোন কলেজ তখনও তৈরি হয়নি। এমনকি মহকুমা সদরেও কোন কলেজ ছিলো না। যারফলে, বরিশাল বিএম কলেজেই আমার কেন্দ্র নির্ধারণ করা হলো। বিএম অর্থাৎ ব্রজমোহন কলেজটি তখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে চিহ্নিত। এ কলেজে কেন্দ্র পড়ায় মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম। ইন্টারমিডিয়েট বা হায়ার সেকেন্ডারী পাস করেও এক বছর বিএম কলেজেই বি.এ’তে পড়েছিলাম। বিএম কলেজের বিএ ক্লাশে তখন মাত্র দু’জন মুসলমান মেয়ে। একজন আমি অন্যজনের নাম এখন ঠিক মনে পড়ছেনা তবে শামশুন নাহার বা এ জাতীয় ছিল।
লেডি ব্রেবোনে থাকতে বেশ কিছু বান্ধবী জুটেছিল আমার। আতিয়া, লিলি, হেনা, ফাতেমা ওরা খুব ঘনিষ্ট ছিল। ওদের পাল্লায় পরে মাঝে মধ্যেই আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম Ñ লাইট হাউজ ছিলো সিনেমা হলের নাম। বেশ কবার ইংরেজি ছবি দেখেছি এই হলটিতে। তার মধ্যে বেনহুর, টেল অব ষ্টুমিস এর নাম মনে পড়ে, সবই ছিল নির্বাক ছবি। অনেকটা ঐ সাথীদের জন্যই পুনরায় লেডি ব্রেবোনে ফিরে গেলাম। ইমিডিয়েট ছোট ভাই তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ’তে ভর্তি হয়েছে। ও আমার ছোট হয়েও আমার চেয়ে পড়াশুনায় এগিয়ে ছিলো। কেননা তখানকার দিনের নিয়মে তো মেয়েদের পড়াশুনা করতে দেয়া হতো না। আমার নিজের যদি আগ্রহ না থাকতো, তাহলে তো চৌদ্দ বৎসর বয়সের ঐ অষ্টম শ্রেণীতেই সব চুকে যেত।
কাঞ্চন কলকাতায় থাকায় আমার একটু সুবিধাই হল। ও মাঝে মধ্যেই আমার খোঁজ নিতে আসতো। ওর কাছেই জানতে পারলাম দেশ ভাগের আগাম সংবাদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর ছাত্র নেতা আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী তখন কাঞ্চনের খুব বন্ধু হবার সুবাদে এই প্রথম রাজনৈতিক অবস্থা, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি আমি জানতে বুঝতে শিখছি, আমরা মুসলিম মেয়েরা যখন দেশত্ব বিষয়টি নিয়ে ভাবনা চিন্তায় ব্যস্ত তখন কিন্তু হিন্দু মেয়েরা রীতিমত কোমরে আঁচল বেঁধে “ভারত ছাড়” আন্দোলনের শ্লোগান তুলে পুরুষের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে মিছিল নিয়ে চলে যেত লেডি ব্রেবোনের সম্মুখ দিয়ে। অনেকদিন কলেজের দোতলায় দাঁড়িয়ে, নেহেরু, জিন্নাহ, শেরে বাংলা প্রমূখদের দেখেছি মিছিলের অগ্রভাগে। এই সময়টায় কাঞ্চন কখনো সখনো গ্রামে চলে গেলে আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী আমার হোস্টেলে এসে ওর জন্যে চিঠি লিখে রেখে যেতেন। বেশীরভাগ চিঠিই ছিলো মুসলীম লীগের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সংবাদ জানিয়ে। হিস্ট্রিতে গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত মুসলীম লীগের সুদর্শন এই ছাত্র নেতার প্রতি তখন হোস্টেলের অনেক মেয়েরই আকর্ষণ ছিলো তা বলতে দ্বিধা নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে ওর চিঠি পড়ে কখন যে আমিও নাজেমের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম বুঝিনি। আর সেজন্যেই বুঝি আমাদের বিয়েটা সম্ভব হয়েছিল। সে কথায় না হয় একটু পরেই আসি।
১৯৪৪ সালে বিএ পাস করার পর ঠিক করেছি যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়বো। আমার এখন মহাক্ষমতা। কেননা বাবা চাচাদের কেউ-ই আর পড়তে দিতে রাজী ছিলেনা না। বিয়ের জন ্য চাপা চাপি শুরু হয়ে গিয়েছিল। শহরে থেকে পড়ছি বলে নাকি বেশ ক’জন ভালো পাত্র হাতছাড়া হয়েছে বাবার। যারফলে, তার মধ্যে একটা ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। বিএ পাসের পরীক্ষার ফলাফল গ্রামের বাড়িতে বসেই জেনেছিলাম। বরিশাল বিভাগ তখনো বাকেরগঞ্জ বা চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চল বলেই পরিচিত ছিল কলকাতাবাসীর কাছে। আমিই প্রথম মেয়ে ছিলাম যে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি। এ সংবাদ শেরে বাংলার কানে পৌঁছতে দেরী হয়নি। তিনি বাবা ও ছোট মামাকে ডেকে বলে দিলেন আমার যতদুর ইচ্ছে আমি পড়বো কেউ যেন বাঁধা না দেয়। কিন্তু বাবা তখন বাঁধা দেওয়ার জন্যই তৈরি ছিলেন। ব্যস খবরটি দশ কান হয়ে আমার কানে আসতেই আমি ছুটলাম কলকাতায়। ছোট মামার বাড়িতে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কিন্তু হিস্ট্রি বা অর্থনীতি পড়ায় বাঁধা দিল কাঞ্চন। ও আমার ভর্তির দায়িত্ব গ্রহণ করে আমাকে ভর্তি করল আরবীতে। আমার উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আগ্রহে এখানেই ভাটা পড়েছিল। তারপরও বছর দুয়েক পড়েছিলাম। আমরা কয়েকজন মুসলিম মেয়েরা এই সময় শিক্ষা সচিবের নিকট আবেদন করে মুসলীম মেয়েদের জন্য একটি হোস্টেল দাবি করলে সে সময় মুন্নুজান ছাত্রী নিবাসটি প্রতিষ্ঠিত করা হয়। আমরা মুন্নুজানে থেকেই পড়াশুনা করতাম।
এমন সময় হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে ডেকে পাঠালেন বাবা। ছোট মামার সাথে বাড়ি পৌঁছে দেখি সবাই কেমন গুরুগম্ভীর। কাঞ্চন তখন বাড়িতেই ছিল। খুব গম্ভীর একটা ব্যাপার, ছোট ভাই বোনদের কাছে জানতে পারলাম আমার বিয়ের জন্য বাবা খুব অস্থির হয়ে পরেছেন। এ নিয়ে কাঞ্চনের সাথে তার বেশ কথা কাটাকাটিও হয়েছে। কেননা কাঞ্চনের বন্ধু আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী আমাকে দেখেছে এবং পছন্দ করেছে। মোহাম্মদ আলীর বাবাও ছবি দেখে পছন্দ করেছেন আমাকে। তারা বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। কিন্তু আবু নাজেম জলপাইগুড়ীর বাসিন্দা বলে অতদূর পথে বাবা তার মেয়েকে দিতে নারাজ। শুধু বাবা একা নয়, মনে হচ্ছে সবা চাচারাই নারাজ। আমি কিন্তু এ খবর শুনে মনে মনে বেশ পুলকিত হয়ে পড়েছিলাম। কেননা কাঞ্চনের সাথে নাজেম যে’কবার মুন্নুজান হোস্টেল গেটে এসেছিল দূর থেকে আমি ওকে ভালো ভাবে দেখেছিলাম। লম্বা চওড়া, সুদর্শন ঐ যুবকটিকে দেখার আগেই যে, কাঞ্চনের জন্যে লেখা তার চিঠিগুলো পড়ে আমি তার প্রেমে পড়ে গিয়েছি, তা তো আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।
যাই হোক, হোটেল ভাড়া করে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। এই প্রথম আমাদের পারিবারিক রেওয়াজ ভেঙ্গে কলকাতা শহরের বাবুদের নিয়মে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। বাবাও এলেন অবশেষে। গোপনে দু’চাচা মাকে নিয়ে বিয়েতে উপস্থিত হলেন। চাচীরা সবাই এসেছিলেন, চাচাত ভাই বোনেরা দু’একজন বাদে সবাই ছিলো। তিন দিন পর গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন তারা। পাত্র পক্ষ সুদূর বরিশালে বিয়েতে যেতে রাজী হলো না। তাদের জন্যই কোলকাতায় বিয়ের আয়োজন করতে বাধ্য হলেন বাবা। গ্রাম থেকে আতœীয় স্বজন সবাইকে নিয়ে খুলনায়, সেখান থেকে ট্রেনের বগি রিজার্ভ করে আমার বিয়েতে এলেন সবাই। বিয়েটা হয়েছিল বৌ বাজার স্ট্রিটের পলাশী হোটেলে, খুবই জাঁকজমকের সাথে। ছোট বোনরা নেচে গেয়ে ওদের দুলাভাইকে বরণ করে নেয়। আমার দু’চারজন বান্ধবীও সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলো। বিয়ে হয়ে যাবার পর, আমি নতুন বউ, অজানা অচেনা পরিবেশে সংসার করতে গেলাম জলপাইগুড়ি। আমার শশুরবাড়ি ওখানেই। শুরু হল আমার অন্য জীবন।
সাত
আবু নাজেম মোহাম্মদ আলীর বাবা মোহাম্মদ মসির আলী খান ছিলেন প্রচন্ড রাশভারী টাইপের লোক। প্রথম দর্শনেই তার মুখের উপর আমার বাবার আদল স্পষ্ট দেখতে পেলাম। যেন বাবারই কার্বন কপি তিনি। পারিবারিক ঐতিহ্যগত দিক দিয়েও যে আবু নাজেমরা বেশ সম্ভ্রান্ত তা চারিদিকে প্রজাদের উপস্থিতিতেই স্পষ্ট হয়েছিল। জলপাইগুড়ির স্টেশন পাড়া, চ্যাংমারী, হলদিবাড়ির এলাকা জুড়ে বিশাল জমিদারী ওদের। প্রথমদিন আমাকে একটি জলচকির উপর দাঁড় করিয়ে প্রজাদের ডেকে দেখানো হলো। প্রজাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়ার এই রীতিতে প্রথমে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম, তবে তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়নি। শশুর মশাইয়ের অমায়িক ব্যবহার এবং ক্রমে আমার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ আমাকে খুব সহজেই তার অনুগত করে তুলে ছিলো।
বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই আমাকে ডেকে তিনি বলে দিয়েছিলেন, এখানে আমার একমাত্র কাজ হচ্ছে সকাল বেলা সবগুলো পত্রিকা তাকে পড়ে শুনানো। আবু নাজেম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে গোল্ড ম্যাডেল পেয়েছিল, খুব ভালো মনের, বড় মনের লোক সে। দু’দিনের মাথায় আমাকে ডেকে বলল, তুমি ইচ্ছে করলে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারো। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমার শশুর মশাইও তাকে সাপোর্ট করলেন। আমার শশুর মশাইয়ের বাবা আমার দাদা শ্বশুর মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী খান মূলত টাঙ্গাইল জেলার লোক। দাদা শশুরমশাই তাঁর বাবার উপর রাগ করে নিজ বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে উঠেছিলেন এবং বিয়ে-থা করে এখানেই সংসারী হয়েছিলেন। আবু নাজেমের নানা বাড়ি ছিল হলদীবাড়ি। ওদের মা আমার শাশুরী ছিলেন অনেক অনেক সয়-সম্পত্তির অধিকারী। মায়ের দিক থেকেই ওরা বেশী সম্পদ পেয়েছিলো। শুনেছি আমার দাদা শ্বশুর ইদ্রিস আলী খান প্রথম জীবনে এখানে এসে খুব কষ্ট করেছিলেন। তার জন্মস্থান টাংগাইল জেলার মঙ্গলহর গ্রামে। সেখানকার মধু খান এর বড়ছেলে ছিলেন তিনি। নতুন ধূতি ছিডে যাওয়ায় তার বাবা তাকে ধমকে ছিলেন বলে রাগ করে কুচবিহারে চলে আসেন। তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলেন। যারফলে, খুব সহজেই কুচবিহারের নবাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তার বিধবা বড় শালিকে বিয়ে করেন। তখনকার দিনের নিয়মে যদি কোন মুসলীম অবিবাহিত যুবক কোন বিধবাকে বিয়ে করে তাহলে তাকে পুনরায় অবিবাহিত কোন যুবতীকে বিয়ে করতে হবে। সেই মতে, আমার দাদা শ্বশুর ইদ্রিস আলী খানও নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং চ্যাংমারীর জমিদারের কন্যা লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করেন। দুই ধনি স্ত্রী’র সুবাদে দাদা শ্বশুর বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। যার জন্য তিনি পরবর্তীতে আরও দুটো বিয়ে করে ছিলেন। তার প্রথম ঘরে এক সন্তানহাসান আলী খান ও দ্বিতীয় বউয়ের ঘরে চার সন্তান জন্মেছিল। দ্বিতীয় ঘরে দু’জন ছেলে মসির আলী খান ও আজিজার আলী খান এবং দুইজন মেয়ে হালিমুন্নেসা ও আলিমুন্নেসা। মসির আলী খানই ছিলেন আমার শ্বশুর এবং নাজেম এর বাবা। এসব কথা আমি শুনেছি আমার শ্বাশুরী বছিরুন্নেসার কাছে। তিনি সুযোগ পেলেই স্বামী-শ্বশুরের গল্প করতে খুব ভালোবাসতেন। নাজেম যখন আমার শাশুরী মায়ের গর্ভে তখন আমার শশুর মশাইয়ের বাবা নাকি ছেলে বউকে দেখতে আসেন এবং চলে যাবার পূর্বে ভবিষ্যৎ নাতি সন্তানের নাম রেখে যান আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী। ঐ সময় শশুর মশাই তার বাবাকে নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন – বাবা ছেলে হবেই তারই তো কোন নিশ্চয়তা নেই। উত্তরে শশুর মশাইয়ের বাবা নাকি মৃদু হেঁসেছিলেন। আসলে তখনকার লোকেরা এমনই ছিলেন। অনেক কিছুই তারা লক্ষণ দেখেই বলে দিতে পারতেন। দুই ভাই দুই বোন নিয়ে নাজেমদের সাজানো সংসার, তার মধ্যে একবোন অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় এবং স্বামীর সংসারে দু’ছেলে মেয়ে রেখে মারা যায়। নাম ছিল লুৎফুননাহার রাবেয়া। নাজেমের ছোট ছিল ইউসুফ নামের এক ভাই, আমার খুব ভক্ত ছিল ও। তারপর বোন লুৎফর নাহার রোকেয়া। ননদটি তখন মাত্রই অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। সারাক্ষণ ছায়ার মতে আমার সাথে থাকতো। হলদীবাড়িতে যে ক’দিন একসাথে ছিলাম ওর জন্যেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি খুব সহজেই সামলে নিতে পারতাম। বলা যায়, ঐ ছোট্ট কিশোরী চটপটে মেয়েটি আমাকে বাঁচিয়ে নিতো। আমার ননদদের নাম রাখা হয়েছিল তাদের দাদীর নামের সাথে মিলিয়ে।
আবু নাজেম মোহাম্মদ আলীর বংশীয় পরিক্রমা (বক্স হবে)
সোনা খান এর ছেলে
মধু খান ( টাঙ্গাইল জেলার মঙ্গল হরের বাসিন্দা।) তিন ছেলে দুই মেয়ে মেয়েদের নাম জানা যায়নি। তবে টাঙ্গাইল জেলাতেই তাদের বিয়ে হয়েছে ও বসবাস।
ছেলে
১। ইদ্রিস আলী খান Ñ ছয় ছেলে ও দুই মেয়ে Ñ হাসান আলী খান, মসির আলী খান, আজিজার আলী খান, তালেব আলী খান, মান্নাফ আলী খান, ডাক্তার কছির আলী খান, হালিমুন্নেসা ও আলিমুন্নেসা।
২। আকমল আলী খান Ñ (কোনো সন্তান নেই)
৩। সাহেব আলী খান Ñ (কোনো সন্তান নেই)
মসির আলী খান এর দুই ছেলে দুই মেয়ে
১। আবু নাজেম মোহাম্মদ আলী Ñ দুই ছেলে এক মেয়ে Ñ আসাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী (নূর), আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী (মিজান) ও কাওছার আফছানা ফোয়ারা।
২। আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আলী Ñ
৩। লুৎফুন্নেসা রাবেয়া Ñ এক ছেলে এক মেয়ে
৪। লুৎফুন্নাহার রোকেয়া Ñ আহসান রহিম মঞ্জিল, গুলশিরিন মিলি, নাসরিন শিউলী, জুলফিকার রহিম মাসুম, জেসমিন এ্যানি, নাজনীন তুলি ও ইয়াসমিন লিপি।
আট
বিয়ের অল্পদিন পরেই আমি পুনরায় মুন্নুজান হোস্টেলে চলে এলাম। এখানে বান্ধবীরা আমাকে নাজেমকে নিয়ে বেশ ঠাট্টা মস্করা করলো। আমার স্বামী ভাগ্য নিয়ে যেমন গর্বিত ছিলাম ওরা তেমনি হিংসুটে ছিলো। লতিফাবানু, রোকেয়া, সাহেরা ও জয়নাব নামে এখানে বেশ ক’জন ভালো বন্ধু পেয়েছিলাম। ওদের মধ্যে দু’একজন এখনো জীবিত আছে, ঢাকাতেই থাকে। মাঝে মাঝে ওদের সাথে টেলিফোনে কথাও হয়। মুন্নুজান হোষ্টেলে থাকাকালীন সময়েই বাবু পেটে এলো। ওর জন্যেই আমার আর পড়াশুনা হলো না। শশুর মশাই সংবাদ পেয়েই নিজে ছুটে এসে আমাকে জলপাই গুড়িতে নিয়ে গেলেন। এর পর দেশ ভাগের আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আমরা জলপাই গুড়িতেই ছিলাম। প্রজাদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াতাম। কিভাবে যেন ওদের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো। প্রজাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধা সব কিছু বিষয়ে শ্বশুর-শাশুরী আমার উপর নির্ভর করতে শুরু করলেন। শ্বশুর মশাই খুব বদ রাগী ছিলেন। কোন রকম উল্টাপাল্টা সহ্য করতে পারতেন না। তাই আমার শাশুরীর কাছেই প্রজা মেয়েদের যত আবদার এসে পৌঁছাতো। শাশুরী স্থানীয় মেয়ে বলেই তার প্রতি হয়তো একটা আলাদা টান ছিলো ওদের।
১৯৪৬ সালের শেষের দিকে, বাবু (নূর) জন্মের অল্প কিছু দিন আগে হঠাৎ করেই আমার দেবর ইউসুফ অসুস্থ হয়ে পরলো। তখনকার সময়ে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব ছিলো না। চিকিৎসা বিজ্ঞানতো আর এতো উন্নত হয়নি। মৃত্যুর আগ মুহুর্তে ইউসুফ আমার শাশুরীকে বলেছিল মা, ভাবীর যদি কোন সন্তান হয় তাহলে হর নাম যেন নূর অথবা নূরী রাখা হয়। বাবু জন্মের পরে সবাই ওকে বাবু ডাকলেও আমার শাশুরী কিন্তু নূর বলেই ডাকতেন। এদিকে আবার শশুর মশাই ওর নাম রাখলেন আসাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। এই নাম রাখার পিছনে বেশ মজার কা- ঘটেছিল যা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।
আমার শশুর ছিলেন যেমনি ভালো মানুষ ও অনেক বড় মনের, তেমনি ছিলেন লম্বা এবং গুরুগম্ভীর মানুষ। সাত গ্রামের মানুষ তাকে যেমন ভয় করতো তেমনি ভালোও বাসতো। কিন্তু তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কোনো কিছুর আবদার করার সাহস কারো ছিলো না। এ সব বিষয় সব সময়ই মহলাল বাবু অথবা নৃপেন বাবুই দেখতেন। একদিন বাবুকে তিনি কোলে নিয়ে এমনি এক সভায় নৃপেন বাবুদের মাঝে বসে প্রজাদের ভালো মন্দ দেখছিলেন। হঠাৎ করেই বাবু তার গায়ে ‘হিশি’ কলে দিলো। অমনি তিনি খুব গম্ভীর হয়ে পরলেন। তোর এত বড় সাহস – আমার গায়ে ‘হিশি’ করলি! তাহলে তো তোকে আর বাবু ডাকা যাবে না। আজ থেকে তো নাম আসাদ হওয়া উচিৎ, আজ থেকে তুই আসাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। ব্যাস সেই থেকে শশুর মশাই ওকে আসাদ নামেই ডাকতেন। আমরা সবাই ওকে বাবু বলেই ডাকতাম, কিন্তু আমার শাশুরী ওকে নূর নামে ডাকতেন। আর প্রতিটি শিশুই বুঝি খুব দাদু ভক্ত হয়। নূরও তাই হয়েছিলো। যার জন্যেই হয়তো নূর নামটিই টিকে গেল। জলপাই গুড়ির তেলিপাড়া, কদমতলা, পাহাড়ি পাড়া এবং নতুন বস্তি এলাকাগুলোই ছিল আবু নাজেমের প্রজাদের শান্তিময় বসতভূমি। প্রজারা এখানে কোনরূপ খাজনা প্রদান করতো না। স্বাভাবিক কারণেই জমিদারের জন্য তাদের ভালবাসা ছিল অফুরন্ত। বেশীরভাগ প্রজারাই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের, কিন্তু মুসলমানদের সাথে ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। মহলাল বাবু, এ্যডভোকেট নৃপেন বাবু ওদের কথা আজো মনে পড়ে। জমিদারীর মামলা মোকাদ্দমার দায়িত্ব ছিলো তাদের উপর।
১৯৪৭ সনের সূচনাতেই দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মার্চে নূরের জন্ম। ওর জন্মের ঠিক তিন মাস পরেই দেশ ভাগ হয়ে গেল। নূর পেটে থাকতেই আমি এবং নাজেম চাকুরীর জন্য আবেদন করেছিলাম। দেশ ভাগ হবার সমূহ সম্ভাবনায় আমার ঠিকানা দিয়েছিলাম স্বরুপকাঠীতে। আগস্টে একটা চাঁপা কষ্ট নিয়ে পূর্ববঙ্গে ফিরে এলাম আমরা। আমি, নাজেম আর আমাদের সন্তান নূর। আমার শাশুরী ও ননদ কিছুতেই জলপাই গুড়ি ছেড়ে এলেন না। আমরা এসে কিছুদিন স্বরুপকাঠী অবস্থান নিলাম। এসময়ে আমাদের আবেদনের উত্তরে নীলফামারী গার্লস স্কুলে যোগ দানের জন্য সরাসরি নিয়োগপত্র এলো। বড় বিষাদময় একটা পরিবেশে আমরা স্বামী-স্ত্রী নূরকে কোলে নিয়ে নীলফামারী স্কুলের চাকুরীতে যোগদান করলাম। স্কুলেরই একটি দু’রুম বিশিষ্ট মাটির দেয়াল ঘেরা ঘর আমাদের থাকার জন্য ছেড়ে দেয়া হল। আমি প্রধান শিক্ষিকা আর নাজেম সহকারী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলাম আমরা। হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী, সব মিলিয়ে একশত হবে।
নীলফামারী গার্লস স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রফুল্লকুমার গাঙ্গুলীর কন্যা শ্রীমতি চ্যটার্জী ও ড. এম এম চ্যাটার্জী। ১৯৪৫ সনের ১৯ মে স্কুলটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখনকার ভবনগুলোই এখনো বিদ্যমান আছে। শুধু নতুন দুটি ঘর বেড়েছে। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর এ স্কুলে হিন্দু হোস্টেল ও মুসলিম হোস্টেলের ব্যবস্থা করে মেয়েদের থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা করা হয়। মরহুম খয়রাত হোসেন ও দবিরউদ্দীনের সহযোগিতা ছিল এ বিষয়ে। তখনকার মুসলীম নেতা হিসেবে এরা দু’জনই খুব উল্লেখযোগ্য ছিলেন। মাষ্টারী চাকুরীতে যুক্ত হয়ে আবু নাজেম রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা বন্ধ করে দিলেও প্রচন্ডভাবে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। যারফলে, মরহুম খয়রাত হোসেন ও দবিরউদ্দীনের সাথে খুব গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাদের কাজকর্মের সাথে নাজেমের চিন্তা ভাবনার সম্পৃক্ততা ছিল বেশী। নীলফামারী গার্লস্ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমি হলেও স্কুলের উন্নয়ন বিষয়ে নাজেমই আমাকে পরামর্শ দিতেন, ঘরে ঘরে যেয়ে মেয়েদেরকে স্কুলে আনার জন্য আগ্রহী করে তোলায় তার অবদান নিশ্চয়ই নীলফামারীর মানুষেরা মনে রাখবে। মেয়েদের হোষ্টেলেরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন তিনি। মোট চারজন লোকের দায়িত্বে নীলফামারী গার্লস স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমরা স্বামী-স্ত্রী, একজন মৌলবী এবং একজন ক্লার্ক। থ্রী থেকে টেন পর্যন্ত অধ্যায়ন ব্যবস্থা ছিল। ১৯৪৯ সনের দিকে দুইশত এর বেশী ছাত্রী সংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিলো এই স্কুলে। জলপাইগুড়ির সাথে তখনও নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। সময় সুযোগ পেলেই আমরা বেড়াতে যেতাম। হিন্দু প্রজারা সবাই ছুটে আসতেন। নূরকে নিয়ে টানা হেঁচড়া পরে যেত। ওখানে গেলে নূর বেশীর ভাগ সময় প্রজাদের কোলেই থাকতো। প্রজারাও কিন্তু বাবুকে নূর নামেই ডাকতো। ছোটবেলা থেকেই ও খুব মিশুক টাইপের হয়ে বেড়ে উঠছিলো। ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আবু নাজেমের বাবা মশিউর আলী খান ইন্তেকাল করলেন। জলপাইগুড়ির মাটিতেই তাকে সমাহিত করা হল। নাজেমের শত আপত্তিতেও আমার শ্বাশুরী স্বামীর ভিটে ত্যাগ করলেন না। রোকেয়াকে নিয়ে তিনি থেকে গেলেন জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য। আমরা ফিরে এলাম নীলফামারী। এ সময়েই আমার বাড়ি থেকে সংবাদ এল দাদীমা আর নেই। দু’জনেই ছুটে গেলাম স্বরুপকাঠী গ্রামে। এটা ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের কথা। নূরের মাত্রই নয় মাস বয়স চলছে। দাদীমা মারা যাবার পর আমাদের পরিবারের যৌথ ব্যাবস্থাটা ভেঙ্গে পড়ল। আমার ভাই-বোনরাও সবাই বড় হয়ে উঠছে। চাচাতো ভাইরাও অনেকে সংসারী হয়েছে। ছোট বোনদের অনেকের বিয়েতেই আমি যেতে পারিনি। এমন কি শেফালির বিয়েতেও না। শেফালী দীর্ঘদিন আমার কাছে থেকে পড়াশুনা করেছে। এরপর অনেকদিন অনেক সংবাদ এসেছে বাড়ি থেকে, চাচা-চাচী মারা যাবার সংবাদও পেয়েছি। বিচলিত হয়েছি কিন্তু নিজের সংসারের চাঁপে যাওয়া হয়নি।
স্কুল ঘরের আঙ্গিনার মধ্যেই বেড়ে উঠেছিল বাবু। ৪৯ সনের শেষদিকে খুব সম্ভব নভেম্বর মাসে মিজানের জন্ম হল। এ সময় আবার হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে যাওয়ায় নাজেম ওর মা বোনদের কাছে ফিরে গেল। বিপদের আশংকায় কেঁপে গেল বুক। জলপাইগুড়িতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, এদেশ ছেড়ে হিন্দুরা সবাই পাড়ি জমাচ্ছে ওদেশে, সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। আমার ছাত্রীরা, আমার সন্তানরা যখন আমার থেকে বিদায় নিয়ে পালাচ্ছে তখন বুকটা খান্ খান্ হয়ে যাচ্ছে। একজন ছাত্রীতো বাবুকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল – মা এদেশ কি হামরার নয়? ছাত্রীটির সে প্রশ্ন এখনো কানে বাজে। ওই সময় বরিশাল আর নোয়াখালীতেও দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল।
আল্লাহর হাজার শুকুর যে, দিন কয়েক পরেই মা বোনদের নিয়ে নাজেম ফিরে এল নির্বিঘেœ। জানতে পারলাম ওখানকার হিন্দু প্রজারাই আমার শাশুরী ও ননদকে আগলে ছিলো, ওরাই পার করে দিয়েছে বর্ডার। নাজেম বসতভিটা বিক্রি করে তাড়াহুড়ায় যা দাম পেয়েছে তাই নিয়ে চলে এসেছে। আমার শাশুরীর কান্না আর থামে না। তাঁর নিজের আজন্ম পরিচিত ভিটা মাটি প্রজাদের ছেড়ে ভিন দেশে কিছুতেই আসতে রাজী ছিলেন না তিনি। এখানে এসে যখন দেখলেন এখান থেকেও হিন্দুরা একইভাবে চলে যাচ্ছে ওখানে, তখন তাঁর দুঃখ বুঝি হালকা হলো কিছুটা। কলকাতা, হুগলী, ত্রিপুরা, মাজরাট প্রভৃতি অঞ্চল থেকে দলে দলে মুসলিমরা এদিকে আসছে। নাজেম ওর হাতের বাড়ি বিক্রির টাকায় এখানে জমি ক্রয় করে আর তাদের মধ্যে দান করেন। খুব বিশাল মনের মানুষ ছিলেন উনি। হাতের জমানো টাকায় জমি কিনলেন আর সব-ই দান করে দিলেন আগতদের মাঝে। বেশ ক’ ঘর হিন্দু পরিবারকে যেতে-ই দিলেন না। পিঠ দিয়ে আগলে রাখলেন। দবিরউদ্দীন, খয়রাত হোসেন এ সময় দাঙ্গা থামানোর জন্য নাজেমের সহযোগীতা গ্রহণ করেন। মাত্র বাহান্নজন ছাত্রী নিয়ে তখন আমাদের স্কুলটি টিকেছিল। আমার ননদ রোকেয়া তখন মাত্রই দশম শ্রেণীর ছাত্রী। জলপাইগুড়ি গভর্মেন্ট গার্লস্ স্কুলে ও পড়তো। এখানে এসে নীলফামারী গার্লস্ স্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হলো। আমার ছোট দু’বোন রেণু ও শেফালী এসে ঐ সময় নীলফামারী গার্লস্ স্কুলে ভর্তি হলো। উর্দু এবং সংস্কৃতি পড়াটা ছিল তখন মুসলিম মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক। আমার বোনরা অবশ্য উর্দুটাই বেছে নিয়েছিল। নাজেম তখন ওদের ইংরাজী পড়াতো। ও পুনরায় এল,এল,বি পড়াশুনায় মনোনিবেশ করেছে।
এমন সময় “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠল দেশ। নীলফামারীর মানুষের মধ্যেও তার প্রভাব পড়ল। আবু নাজেম আবার জড়িয়ে গেলেন রাজনীতির সাথে। মুসলিম আওয়ামী লীগের নের্তৃবৃন্দের সাথে আবু নাজেমও রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আন্দোলনে নামালো। ফলে বাহান্ন সনের শেষের দিকে ওকে সহ খয়রাত হোসেন ও দবিরউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হলো। আসলে রাজনৈতিক সচেতন একজন মানুষতো ঐ দুঃসময়ে চুপ থাকতে পারে না, নাজেমও পারেনি। যার জন্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেও নাজেম “নিউ ন্যাশন” পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করছিলো।
আমি অবশ্য বরাবরই রাজনীতি বিরূপ। রাজনীতি নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথ্যা ছিলো না। সত্যি বলতে দেশ ভাগের ঐ ভয়ংকর পরিস্থিতিটায় মানুষের কান্না আহাজারী দেখে আমি রাজনীতিবিদগণের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হয়েছে, ওনাদের জন্যই নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করে ঐ সময়টায় মানুষদের ছুটে পালাতে হয়েছে। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়িক দাঙ্গাটাও ওনাদের তৈরি। ছোটবেলায় যে লবন আন্দেলন দেখেছিলাম, বরিশাল অঞ্চলের মানুষেরা তখন নারিকেল গাছের ডগা পুড়িয়ে ছাই করতো। সেই ছাই একটি জারে তুলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতো। ভিজানো ঐ ছাই থেকে ফোটা ফোটা যে পানিটা পড়তো সেটা লবন পানি। সেই পানি জমা করে জাল দিয়ে লবণ তৈরি করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ছিল বরিশালের মানুষেরা। আমাদের বাড়িতেও ওভাবে লবন তৈরি হতে দেখে যখন দাদুমাকে প্রশ্ন করেছি, দাদুমা উত্তর দিতেন বর্গিরা সব লবন খেয়ে ফেলেছে দিদি।
ঐ সময় মহাত্মগান্ধি বরিশালে ছিলেন। তার উৎসাহে লবন আন্দোলন প্রকট পেলেও আমরা ছোটরা দেখেছি কি অবাধে নারিকেল গাছগুলো ধ্বংস হয়েছে। এক সময়ের নারিকেল রাজ্য বরিশালে আজ নারিকেল তেমন ফলে না সেজন্য এখনো আমি ঐ আন্দোলনকেই দায়ী করি। জানি প্রতিটা আন্দোলনের পিছনে বৃহৎ স্বার্থ কাজ করে, আর সে বৃহৎ স্বার্থকে কুষ্ঠিগত করতে ছোট ছোট ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে। সে না হয় করলাম। নারিকেল বাগানের ক্ষতি স্বীকার করলাম কিন্তু মানুষের সংসারের সাজানো বাগান ভেঙ্গে আমরা কি পেলাম?
নয়
চুযান্ন সনের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন সময়টায় স্কুল বন্ধ থাকায় বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। আমাদের পরিবারে তখন নতুন অতিথি এসেছে। দু’টি ছেলের পর নাজেমের মেয়ের স্বপ্নপূরণ করে ফোয়ারার জন্ম হল।
অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে ফিরলাম। কিন্তু কেমন যেন সব অচেনা ভাব। আমার জন্মস্থানে আমি অতিথি? এটাই মেয়েদের নিয়তী। এই নিয়তীর কথাই ছোটবেল মা ও দাদুর মুখে শুনেছি। তখন বুঝতাম না এখন বুঝি। চারিদিকে এখন অনেক পরিবর্তন। মিঞার হাটটিও বেস জমজমাট হয়ে উঠেছে। দোকান পাটের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে বাড়ি ঘর। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে প্রস্তুত বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদনের জন্যে পূর্ব থেকেই আমাদের গ্রামটি বেশ বিখ্যাত। এখন আবার পাটের তৈরি হস্তজাত শিল্প উৎপাদনে মনোযোগী হওয়ায় দুর দুরান্তের ব্যাবসায়ীদের ভিড় বাড়ছে। অবশ্য ব্যাবসায়ীদের এ ভিড় পূর্ব থেকেই ছিলো। তবে তা শুধু কাঠ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। ইন্দ্রের হাটের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে কাঠের পুলও তৈরি হয়েছে। আমার বিয়ের সময়েই বাবা তিন চাচাকে আলাদা আলাদা ঘর তৈরি করে দিয়েছিলেন খালের ওপারে। আজাহার চাচা, সফি চাচা ও কফিলউদ্দীন চাচাদের ঘর থেকে সাবাই ছুটে এসে ঘিরে ফেললো। বাড়ি ভর্তি লোক। এপারে বড় চাচা-বাবা এবং ছোট চাচার ঘরেও লোকজন কম নয়। আমার চাচাত বোনদের বিশাল বাহিনী দেখে নাজেম বেচারাতো ভয়ে কাচু মাচু। সবাই ওদের দুলাভাইকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। আগেই বলেছি আমাদের বাড়িটা ছিল শিক্ষানূরাগী আধুনিক চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি বাড়ি। পর্দা প্রথা ছিলো না, তবে বাবার কড়াকড়িতে মেয়েরা পুরুষদের সম্মুখে খুব একটা আসতো না। কিন্তু আমার চাচাতো ভাইদের সম্মুখে আসায় নিষেধ ছিলো না। ভাইয়েরা সকলেই খুব ভালো মনের এবং শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলো। ইতিমধ্যে কাঞ্চনও বিয়ে করেছে। বড়মামার মেয়ে জোসনাকে বিয়ে করায় বাবা ওর উপর কিছুটা ক্ষুব্দ হয়েছেন। তাই কাঞ্চন বাড়ি ছেড়ে শহরে যেয়ে উঠেছে, খুলনা শহরে। এদিকে আবার মামাত ভাই শমসের আলী ওকালতি পাশ করে রাজনীতিতে জড়িয়েছে। বরিশালে তার অনেক নাম ডাক, আমার ভাই রাজা মিয়া ও চাচতো ভাই বাদশা তখন বাড়িতে ছিলো না। জানতে পারলাম, ওরা চাকুরীর জন্যে কোথাও গিয়েছে। বাবা ওদের জন্য চিন্তায় আছেন। খুব সম্ভব পটিয়ায় চাচাতো ভাই ডাঃ আশরাফউদ্দীন আহমেদের ওখানে আছে বাদশা কিন্তু রাজার কোন সংবাদ-ই নেই।
নূর ও মিজান তখন রীতিমত ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। এ বাড়িতে পা রেখে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট হলাম যে, আমাদের পারিবারিক রীতি নীতিটা এখনো বজায় আছে এবং চাচাতো ভাইদের মধ্যে আবু বড় মিয়া মারা যাবার পরে সকলের বড় কাঞ্চন হওয়ায় ওর উপরই সব ভাইদের নির্ভরতা এখনো বজায় আছে। কাঞ্চন খুলনায় এবিপি ব্রান্ড ম্যানেজার পদে কাজ করছে। বাবা খুব সম্ভব এ বছর-ই ওকে ওখানে একটা বাড়ি করে দেবেন বলেও আভাস পেলাম। আমাদের ভাইদের প্রত্যেকে যে যেখানে থাকুক না কেন, একে অপরের জন্যে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। বাবার নির্দেশে ভাইয়েরা যে যেখানে থাকতে পছন্দ করবে সেখানেই একটি বাড়ি তৈরি করে দিতে হবে। “আনিসউদ্দীন কল্যান ট্রাস্ট” নামে এজন্যে একটি সমিতির মত খুলেছিলেন বাবা। সব চাচারাই এই ট্রাস্টে তাদের ব্যবসায়ের লভ্যাংশ জমা রাখতেন। এ ফান্ড থেকেই আনিসউদ্দীন আহমেদের ছেলের ছেলেদের ভবিষ্যত নির্ধারণ করা হয়েছিল। মেয়েদের বিয়ের খরচও এ ফান্ড থেকেই দেওয়া হতো।
দশ
বেইলী রোডের বেইলি হাইটস ভবনের চতুর্থ তলায় বসে স্মৃতির প্রহর গোনা এক বৃদ্ধা আমি, আমার সমপর্যায়ের কেউ-ই এখন জীবীত নেই, ছোট তিন বোন অবশ্য ওদের সংসার নিয়ে এখনো টিকে আছে, তবে ভাইয়েরা সবাই চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। ফেরদৌসী রহমান শেফালী আমার ছোট বোন থাকে ঢাকাতেই। গুলশানে ওর স্বামী ডা. মাকসুদুর রহমান বাড়ি করেছে একটা। ওর গ্রামের বাড়ি আমাদেরই পার্শ্ববর্তী গ্রাম নান্দুহার। ওরা বিয়ের পর পরই পাকিস্তানে চলে যায়। দীর্ঘ নয় বছর পর হঠাৎ করে নীলফামারীর বাড়িতে এসে আমাকে চমকে দিয়েছিল ওরা। আর সবার ছোট রওশন আক্তার বুড়ি আছে শ্যামলীতে। গৌরনদীতে ওর বিয়ে হয়েছিল। ওর স্বামীর নাম সিরাজুল হক। আমাদের বাবা-চাচারাও কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তবে চাচাতো ভাইদের মধ্যে বুঝি শাহাবুদ্দিন কিসলু, মালেক, চারু, আর বাদশা জীবীত আছে এখনো, সেদিন বাদশার ছেলে আমিনুল ইসলাম রন এসেছিল। ওর কাছে জানতে পারলাম, ছোট চাচার ছেলেরা এখনো সবাই বেঁচে আছে। তাদের মধ্যে শুধু তিনজন গ্রামে থাকে। দুলু, তৌহিদ, খালিদ আর জাহিদ। জাহিদ নাকি আবার গ্রামের চেয়ারম্যান হয়েছে। বংশের ঐতিহ্যবাহী কাঠ ব্যবসা এখন জাহিদই ধরে রেখেছে এখনো। বাদশা আর জাহিদ চাচাতো ভাই, বাদশার একেবারে ছোট বোন সুমিকে বিয়ে করে জাহিদ আতœীয়তা পুনরায় দৃঢ় করেছে। ওরা কেউ আসে না। অনেক দূরে সরে এসেছে রক্তের বাঁধন। আমার ছেলেরা চেনে না ওদের মামা, মামাতো ভাইদের, এটাই বুঝি দুনিয়ার নিয়ম, আমার বোনদের সন্তানেরা কে কোথায় কেমন আছে কিভাবে আছে সবই জানি আমি, শুধু দেখা সাক্ষাত হয়ে ওঠেনা। রেনূর সন্তানরা বুঝি সবাই দেশের বাইরে। বুড়ি আর শেফালীর ছেলে মেয়েরাও নাকি দেশের বাহিরে। কাঞ্চনের ছেলে দুটি অবশ্য মাঝে মাঝে আসে।
ও ঘরে সুপ্রভা যেন কার সাথে কথা বলছে, সুদীপ্ত আবার খুব চুপচাপ স্বভাবের। আজ কাওছার আফছানা ফোয়ারা আসবে। আমার একমাত্র মেয়ে, ওর বিয়ে হয়েছে ১৯৮৩ সনে। ওর স্বামী ইমতিয়াজ আহমেদ সর্ম্পকে আমার ভাইস্তা। ছোট ভাই কাঞ্চনের ছোট ছেলেও। এক সন্তানের মা হয়েছে অথচ ছেলেমানুষী এখনো যায়নি। ছোট বেলার মত এখনো নূরকে ক্ষেপাতে পারলে খুশী। মাসে একবার অন্তত তিন ভাই বোনদের একত্র হওয়া চাই। নূরের ভীষণ ব্যস্ততা, আহাদ বা মিজান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার উপর রাষ্ট্রপতি শাহবুদ্দিন সাহেবের মেয়ে জামাই এ সব বুঝতে রাজী নয় ফোয়ারা। ওর কথা, হোক নেতা, হোক জামাই-আগে সবাই আমার ভাই। দোয়া করি ওদের এ বাঁধন অটুট থাকুক বাকীটা জীবন।
নূরের বউ বেশ লক্ষ্মি মেয়ে। সব কিছু খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। বেশ কিছুদিন নীলফামারীর বাড়িতে ছিল ও। খুব মানিয়ে ছিল ওকে ঐ গ্রামের পরিবেশ। আহাদের বউ সেতারা, সাবেক বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন সাহেবের বড় মেয়ে। সচরাচর বড়রা যেমন হয়, খুব সরল সোজা একটি মেয়ে সেতারা। গবেষণার কাজে ব্যস্ত বলে কিছুদিন ওর দেখা পাব না। অথচ খুব ইচ্ছে হয় ওদের দু’বউকে সারাক্ষণ পাশে পাশে রাখতে। আমি মাঝে মধ্যে ওর কাছেও গিয়ে থাকি। মাঝে মধ্যে নীলফামারীর জন্য মনটা খুব কাঁদে। ওখানে বাড়িটা এখন ফাঁকা পড়ে আছে। শুনেছি নূর বাড়িটাকে ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করছে। একটি আম গাছ রয়েছে বাড়িতে, আম ধরে কিনা জানিনা, নাকি কেটে ফেলল নূর। সেদিন আরিফ এসেছিল। নূরের কাজে ও নীলফামারী গিয়েছিল ওর কাছে জানলাম নূর কাটেনি ওটি। যাক রোকেয়ারা সবাই ভাল আছে। গাছটার আমও নাকি ও খেয়েছে। তাহলে এখনো আম ধরে গাছটিতে। সুপ্রভার জন্য আরিফ দুটো ভুট্টা নিয়ে এসেছিল, ক্ষেতের ভুট্টা, ওদিকটায় ভুট্টা বেশ ভাল জন্মে। রোকেয়া নাকি দিয়েছে, ও নাকি আমাদের খুব দেখতে চায়, আমার কাছে একটি চিঠিও লিখেছে। বাড়িটার এখন কী যে অবস্থা কে জানে, ঐ বাড়িটার প্রতিটা স্থানে নাজেমের স্মৃতি রয়ে গেছে। নূর এখন প্রায়শই নীলফামারী যায় কিন্তু ঐ বাড়িতে ওঠে না, ওঠে ওর ফুপুর বাড়িতে। বাড়িটা তৈরি শেষ হলে হয়ত নূর স্থায়ী হবে ওখানে। নূরের মধ্যে ওর বাবার ছায়া পুরোমাত্রায়। দেশ আর মানুষের জন্য ওর যতো ভাবনা। এই নীলফামারীর মানুষের ভালোর জন্যই শেষপর্যন্ত রাজনীতিতে নেমেছে নূর। আওয়ামী লীগ থেকে প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভও করেছে।
১৯৭০ সনের প্রথম দিকে বাবা মারা গেছেন। শেষ বয়সে বেশ অসুখে ভুগেছেন বাবা। চিকিৎসার জন্যে তাকে বিদেশে পাঠানো হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাবার মৃত্যুর সময় স্বরূপকাঠী গিয়েছিলাম। নূর তখন রীতিমত বড় হয়ে উঠেছে। ছোটবেলা থেকেই ও নাটক-গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় করে বেড়াতো। ছাত্র হিসেবে ওরা তিন ভাই বোনই বেশ মেধাবী ছিল। নূর যতটা আড্ডা প্রিয়, মিজান ততটাই ঘরমুখী। ছোটবেলা থেকেই মিজান খুব গুরুগম্ভীর স্বভাবের। সবাইকে শাসন করতে খুব ভালবাসতো। আজকে ও যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবে, তা ওর ঐ ছেলেবেলার চরিত্রে স্পষ্ট হয়েছিল। বাবার স্বভাব পুরোটাই পেয়েছে নূর। ওর বাবাই ওকে উৎসাহ দিতো। স্কুলে কিম্বা কলেজের ছেলে মেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন উৎসব ফাংশনে মেতে থাকতে ভালবাসতো নাজেম। নূর এ বয়সেও তেমনি মেতে আছে। মিজান হয়েছে ঠিক আমার মতো, ওকে নিয়ে বেশ তর্ক হতো আমাদের স্বামী-স্ত্রীতে। কিন্তু কাওছার আফসানা আমাদের উভয়ের গুণই পেয়েছে। বাবা মারা যাবার অল্পদিন পরেই মা চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৩ সনের শেষের দিকে সর্বশেষ সুঠিয়াকাঠী গ্রামে গিয়েছিলাম চল্লিশা উপলক্ষে। আমার ভাইয়েরা খুব বড় করে বাবা-মা উভয়েরই চল্লিশা একসাথে পালন করেছিল সেবার।
এগারো
আমাদের সময়টায় আজকের মত এত পত্রিকার প্রচলন ছিলো না, কলকাতা থেকে প্রকাশিত কিছু কিছু পত্রিকা নীলফামারীতে আবু নাজেম মোহাম্মদ আলীর নামে আসতো। গার্লস স্কুলের লাইব্রেরীতেই থাকতো ওগুলো, এদের মধ্যে যুগান্তর, আনন্দ বাজার ছিলো। পূর্বেই বলেছি বই পড়া আমার নেশা ছিলো। অনেক অনেক বই পড়েছি, এখনো পড়ি। চার্লস ডিকেন্সের বই ছিলো আমার খুব প্রিয়। শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি বইটিও খুব ভাল লেগেছিল। স্কুলে মেয়েদেরকে বই পড়ার জন্যে বলতাম। স্কুল লাইব্রেরীতে ওদের কথা চিন্তা করেই নাজেম কলকাতা থেকে পত্রিকার সাথে বিভিন্ন গল্পের বই আনাতেন। মুসলিম মেয়েরা প্রত্যেকেই বোরকা পড়ে স্কুলে আসতো। প্রথমদিকে কিছু বলতাম না তবে হোস্টেলের ছাত্রীদের মধ্যে আমাকে অনুসরণ করা শুরু হলে ধীরে ধীরে বোরকা কালচার পরিহার করল মেয়েরা, আমি ওদের বুঝাতাম মনের পর্দার কথা। শুধু ওদেরকে নয়, ঘরে ঘরে যেয়ে স্কুলে পড়ার জন্য যখন মেয়েদের ডেকে আনতে হয়েছিল তখন ছলে বলে অভিভাবকদেরকে একথাই বুঝাতে হয়েছিল যে বাইরের পর্দা নয়, সত্যিকারের ধর্মীয় বন্ধনতো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। ধর্মীয় সমস্ত শাসনকে নিজের মধ্যে পরিপূর্ণতা দিতে হলে নারী পুরুষ সকলকেই শিক্ষিত হতে হবে। তা না হলে ধর্মীয় অনুশাসন নয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারই বাসা বাঁধবে। আমার মাথার কাঁপড় কখনো পিঠে পড়েনি, রোজা-নামাজ কোনটাই কাঁজা হয়নি। সত্যি বলতে আমি তো ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে নই, একথা বুঝাতে ওদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো।
এটা সত্য যে মেয়েরা যত তার আব্রু সরিয়েছে ততই তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। দেশ ভাগের পরবর্তী সময়টায়ও ধর্ষণ বা এ জাতীয় কোন শব্দ সমাজে ছিলো না। মেয়েদের সাথে পুরুষের সম্পর্কটা অন্দর মহলের বাইরে তখনো পৌঁছায়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরই যেন সব কিছু হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করল।
১৯৬৫ সনের দিকে আবু নাজেম গার্লস স্কুল ত্যাগ করে বিদ্যানিকেতন নামের একটি কম্বাইন্ড স্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই নাজেমের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে মহকুমার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নূর তখন মেট্রিক দেবে। ছেলেটার মধ্যেও বাবার অনুকরণ স্পষ্ট। ওকে নিয়ে খুব ভয়। কি সব বই পড়ে। আমাকে দেখলে লুকিয়ে ফেলে। বুঝতে পারি কমিউনিজম আদর্শে অনুপ্রাণিত হচ্ছে ও। কিছু বলি না। বললেই নাজেম এসে ওর পক্ষ নেবে। পড়াশুনায় ভালো এটাই যে মঙ্গল। ইতিমধ্যে আমরা নিজেদের অর্জিত আয়ে একটি বাড়ি করতে পেরেছি শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। স্কুলের ভবন ছেড়ে এখন নিজেদের বাড়িতেই বসবাস করছি। আমার আর নাজেমের চাকুরীর টাকা জমিয়ে গড়া এ বাড়ির শুধু ভিটেটুকু পাকা করতে পেরেছিলাম। মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে খুব মজবুত দেয়াল গাঁথা হয়েছিলো, উপরে টিন। এ লেখার সূচনা লগ্নে সেভাবেই পড়ে ছিলো বাড়িটি। নাজেম জলপাইগুড়ির জমি বিক্রী করে ফিরে এসে এখানে যে জমি কিনেছিল তার অর্ধেকই চলে গেছে দান খয়রাতে, বাকী যা আছে সেখানে চাষাবাদের জন্য লতিফ নামের একজন চাষীকে বর্গাা দেয়া হয়েছিল। এখনো সে জমি বর্গায় রয়েছে তবে দেখাশুনার দায়িত্বটা রয়েছে নূরের ফুপির উপর।
দেখতে দেখতে মুক্তিযুদ্ধ চলে এল। কলেজে পড়–য়া নূর যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে চলে গেল কুচবিহার ক্যাম্পে। আমরা আরো ভিতরে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। কিছুদিন ছিলাম নীলসাগর গ্রামে, ওখান থেকে আরো ভিতরে খোকসাহবাড়ি আমাদের বর্গাচাষী লতিফের বাড়িতে ছিলাম বাকীটা সময়। মিজান আর ফোয়ারাকে নিয়েই আমার যত চিন্তা। নয়টি মাস বড় দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। পুরো সময়টাই নাজেম আমাদের আগলে থাকলো। বড় উত্তেজিত ছিল ও। নূরের সংবাদ পাবার জন্য যেখানে সেখানে ছুটে বেড়াতো। হানাদারদের গতিবিধির উপর নজর রাখতো। ঐ সময়টায় নূরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ নাজেম একাই রক্ষা করেছিল। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে যুদ্ধ শেষে নূর ফিরে এলো। পরিস্থিতি একেবারে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা খোকসাহবাড়িতেই থেকে গেলাম। তারপর যখন শহরে ফিরলাম, শহর তখন ফাঁকা বলা যায়। পরিস্থিতি যখন একেবারে স্বাভাবিক হলো পুনরায় পড়াশুনায় মনোযোগী হল নূর। নীলফামারী বয়েজ কলেজ থেকেই এইচএসসি পাশ করল নূর। এই কলেজেরই প্রথম প্রিন্সিপাল আবু নাজেম মোহাম্মদ আলীর নাম আজীবন স্মরণ করবে নীলফামারীর মানুষেরা। বাবার মতোই কলেজ জীবনেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যায় নূর। খুব সম্ভব একবার কলেজের নির্বাচনও করেছিল। জিএস বা এজিএস কিছু একটা হয়েছিলো ও। তারপরও খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিলো এইচএসসিতে।
১৯৭২ সনে নীলফামারী গার্লস স্কুলকে জাতীয়করণ করা হল। এখন স্কুলে হাতে গোনা কিছু মেয়ে সবাই মুসলিম, পুনরায় মেয়েদের পড়াশুনায় উৎসাহিত করার জন্যে ঘরে ঘরে যেয়ে আমি আর নাজেম ডেকে আনতে শুরু করলাম। নূরও ওর বন্ধুদের নিয়ে আমাদের সাহায্য করল। ও এম,এ’তে ভর্তি হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অল্পদিন পরেই সংবাদ পেলাম রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে ওর চাকুরী হয়েছে। ছাত্র রাজনীতিতে ওর সক্রিয়তা ছিল। ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত থাকার সুবাধে নীলফামারী কলেজে ওর বেশ নাম ডাক হয়েছিল খুবসম্ভবত সেই জন্যেই রাশিয়ান এ্যাম্বাসীর নজরে পড়েও।
৭৩ সনের দিকে হঠাৎ দেখি নূর টেলিভিশনে অভিনয় করছে। আমার মেয়ে ফোয়ারাই প্রথম টেলিভিশনে নূরকে দেখে চিৎকার করে উঠে, “মা দেখ ভাইয়া”। এসব কথা মনে পড়লে আজ আনন্দ যেমন হয়, কষ্টও তেমনি বাড়ে। সবচেয়ে বেশী আনন্দ পেত নাজেম। রাজনীতি পাগল নূর যে অভিনয় পাগল হবে, এতবড় নামী অভিনেতা হবে নাজেম কিন্তু ঠিকই বুঝেছিল। তবে নূর রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ায় একটু বুঝি ক্ষুব্ধও হয়েছিল।
১৯৮১ সনের পাঁচই জানুয়ারী চাকুরী থেকে আমি অবসর নিয়েছি। আর ঠিক ঐ দিন রাতেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন আবু নাজেম মোহম্মদ আলী। ভেবেছিলাম, এবার তো ছুটি। অফিসের আর কোন ঝামেলা নেই, সকাল হলেই ছুটতে হবে না, রাতে খাতার বান্ডিল নিয়ে বসে থাকতে হবে না। স্বামী-স্ত্রী মিলে হেসে-খেলে বাকী দিনগুলো কাটিয়ে দেব। স্ত্রী হিসেবে ওর প্রতি যে কোনো দায়িত্বই ঠিকভাবে পালন করা হয়নি। বরং চাকুরি ক্ষেত্রে আমার যাবতীয় সমস্যাকে বুক পেতে সমাধান করে গেছে সে। চাকুরীতে দু’বার বদলী হয়েছিলাম। একবার বোর্ড অফিসে আর একবার জামালপুর গার্লস হাইস্কুলে। জামালপুর সরকারী গার্লস হাইস্কুল থেকেই অবসর নিয়েছিলাম। নূরের সাথে সাথে মিজানও মেট্রিক পাশ করে ঢাকাতেই কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওরা তখন বখসী বাজারে দু’কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাসাতে বসবাস করছে। বোর্ড অফিসে বদলীর সুবাদে আমিও ঢাকায় এসে উঠলাম। জামালপুর স্কুলে বদলী হলেও ছেলে মেয়েদের সুবিধার জন্যে বখ্সী বাজারের বাসাটি আর ছাড়া হয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমার জন্য স্কুল কম্পাউন্ডের ভিতরেই আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। শুধু ছুটির দিনে আমি ঢাকায় চলে আসতাম। জামালপুর স্কুল থেকে যেদিন বদলী হব তার আগের দিন সন্ধায় নাজেম নীলফামারী থেকে ঢাকায় চলে আসে। ও খুব ক্লান্ত ছিল। সেজন্য ছেলেমেয়েদের সাথে খুব একটা কথা না বলেই ঘুমোতে চলে যায়। শুধু মিজানকে বলে যায় “ভোর বেলায় তুমি মা’কে আনতে চলে যেও”। মিজান খুব ভোর বেলায় আমাকে নেয়ার জন্যে জামালপুর চলে আসে। সকালবেলা ফোয়ারা কলেজে যাবার আগে বাবাকে এতো বেলা অবধি ঘুমোতে দেখে ডাকতে শুরু করে। কাছে যেয়ে গায়ে হাত দিয়ে ডাকার পরও যখন বাবা ওঠে না, তখন ও চিৎকার করে ওঠে। “দাদু ভাই দেখ বাবা……..”। নূরকে ফোয়ারা দাদুভাই বলেই ডাকে। আমাকে ফোন করে জানান হলো নাজেম খুব অসুস্থ। মিজানকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলাম। একদিকে অবসর গ্রহণ অন্যদিকে স্বামীর অসুস্থতার সংবাদ সব মিলিয়ে বিপর্যস্থ এক নারী আমি। সন্তানের হাত ধরে ঢাকায় বখ্সী বাজারের ভাড়া বাড়িতে এসে দেখি বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজনদের ভিড়। আমার ছোট বোন রেণু ও শেফালী আমাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো, ততক্ষণে আমি বুঝি গেছি নাজেম আর নেই। নাজেমের মৃতদেহ নিয়ে আমরা আবার ফিরে গেলাম নীলফামারী। সেখানে আমার শ্বাশুরী অপেক্ষায় ছিলেন তার ছেলের জন্য।
১৯৮২ সালের ১৮ জুলাই আমার শ্বাশুরী বছিরুন্নেছা মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে তিনি আমার ননদের কাছে ছিলেন। নাজেমের মৃত্যুতে অনেকটা ভেংগে পড়েছিলেন তিনি।
আমার ননদ রোকেয়া নীলফামারীতেই সংসার সাজিয়েছে। ওর স্বামী আবদুর রহিম একজন স্কুল শিক্ষক। নাজেমের উৎসাহে এবং উদারতায় ওদের বিয়েটা সম্ভব হয়েছিল। যারফলে, সব সময় নাজেমকে ঘীরে থাকতে পছন্দ করতো ওরা। ছোট বোনটিকে নাজেমও খুব ভালবাসতো। ওদের ছেলে মেয়েরাও বেশ বড় হয়েছে। সাত ছেলে/মেয়ে ওদের। খুব সম্ভব পাঁচজন মেয়ে ও দু’জন ছেলে। সবার বড় আহসান রহিম মঞ্জিল নীলফামারীতেই থাকে নতুন সংসার সাজিয়েছে ওরা। নীলফামারী গণগ্রন্থাগারের পরিচালক ও। এই গ্রন্থাগারটি জুড়েও নাজেমের অনেক স্মৃতি। মৃত্যুর আগে নাজেম নীলফামারী থেকে ফিরে আসার কারণটাও বেশ বুঝতে পারি এখন। ও আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল ওর দিন ঘনিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিনের সম্পর্কে এটুকু যোগ হয়েছিল যে আমি নাজেমের মুখ দেখেই ওর মনের ইচ্ছে বলে দিতে পারতাম, তেমনি নাজেমও। অবসর গ্রহণ করায় আমার মন খারাপ হয়ে যাবে, আমি হয়তো ঘরে এসে চুপি চুপি কাঁদবো এটা ভেবেই নাজেম আমার আগে ছুটে এসেছে। ঐ দিন ও নীলফামারী থেকে না এলেই বুঝি ভাল ছিলো। আমাকে একা রেখে চলে গেল স্বার্থপরের মতো। এতদিনের এতো উদারতা, এত সেক্রিফাইস্ সব ভূলে গেল।
এরপর দিনগুলো যে কিভাবে কেটেছে বলতে পারবো না। নাজেম জীবিতকালে নূরকে বিয়ের জন্য চাপা চাপি করে লাভ হয়নি কোনো। এবার যেন ও নিজেই যেঁচে বিয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করলো। ১৯৮২ সনের ১৯ নভেম্বর শাহিনা এলো ঘরে। ৮৩ সনের জুলাই মাসে মিজানও বিয়ে করল, একই সময় ফোয়ারাকে বিয়ে দিল ওরা। নূরের দু’টি সন্তান। আরেকুজ্জামান মোহম্মদ আলী (সুদীপ্ত) এবং তাসলিমা জামান (সুপ্রভা)। ফোয়ারার একটি মাত্র ছেলে শাকিল আহমেদ শান্তনু। আহাদুজ্জামান মোহম্মদ আলী (মিজান) একটি মেয়ে সন্তান নাম ইষা শ্রাবণী। আমার বেশীর ভাগ সময়টা ওদের নিয়েই কেটে যেত। নূরের বাড়িতেই থাকা পরে বেশী। আগে মাঝে মধ্যে নীলফামারীর গ্রামের বাড়িতে যেতাম। এখন আর যাওয়া হয় না। বয়স হয়েছে তো, আগের মত হাঁটা চলা ধৈর্য্যে কুলোয় না। যে কোনো সময় এখন চলে যেতে হবে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল স্কুল প্রধান হিসেবে প্রথম জীবনে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে পারা। অনেক ছাত্র – ছাত্রীকেই নিজের হাতে শিখিয়েছি। চেষ্টা করেছি সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। আমার পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও আমি পূরণ করতে পেরেছি। আমি আমার ছাত্রীদেরকে ঝঃঁফবহঃ এর সাতটি বর্ণকে বিশ্লেষণ করে করে শিখিয়েছি। ওরা যেন এ বর্ণগুলোর মর্ম নিজেদের মাঝে ধারণ করতে পারে, আজও সেই প্রার্থনা করি। আজকের সমাজে পত্র-পত্রিকার পাতায় “অহরহ নকলের মহা উৎসব” শুনি। আর আমাদের সময়ে নকল কি জিনিস সেটাই কেউ জানতো না, পরবর্তীতে স্বাধীনতার পড়ে ছেলে মেয়েদের মধ্যে কিছুটা দেখা দেখি করার স্বভব যুক্ত হলেও বই কাগজ ছিড়ে নকল করার চিন্তা কেউই করতো না। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে যথেষ্ট সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালবাসা পেয়েছি। সত্যিকারের শিক্ষক সবসময়ই তা পায়।