‘সেই কবে থেকে তোমার পায়ের কাছে
লুটোপুটি খাচ্ছে আমার কথারা
আমার ব্যাথারা মাথা কোটে
তুমি কি শুনতে পাও? নাকি
তুমিও পাথর!
যদি পাথরও নও তাহলে অহল্যা হলে কেন?’
১৯৮২ সালে প্রকাশিত কবি মুশাররাফ করিম-এর পাথরের সাথে কথা নামের প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রধান কবিতার চরণগুলো ছিল এমনই আবেগ আর প্রতিবাদ মিশ্রিত জিজ্ঞাসায় ভরপুর। ১৯৮২ থেকে ২০০৮ সালের ব্যবধান অনেক। প্রায় ৩০ বছরে ব্যবধানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু চিরতরুণ মুশাররাফ করিমের চিন্তা চেতনার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এখনো তার লেখনীতে প্রতিবাদ আর জিজ্ঞাসা, আবেগ আর ভালবাসার মিশ্রণ একইভাবে খেলা করে ব্রহ্মপুত্রের জলে। এখনো তিনি লেখেন –
‘একটা কিছু হবে, একটা অসাধারণ নাটক
সহসাই হবে মঞ্চায়ন, অনভিজ্ঞরা টের পাবে না
টের পাবে তারা, যারা থাকে উইংসের আড়ালে।’
শুধু যে একজন কবি তা কিন্তু না, তিনি একাধারে কবিতো বটেই- গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাসসহ সাহিত্যে সব ক্ষেত্রেই তার সমবিচরণ। মুশাররাফ করিম তার বৈচিত্রময় জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকেই ধারণ করেছেন তার লেখনীতে। গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের প্রতিটি চরণে ফুটে আছে তার নিজস্ব চিন্তা চেতনা ও কর্মের প্রতিফলন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ – ছোটবিবির বিত্তান্ত, প্রথম উপন্যাস – পূর্বপুরুষগণ সাহিত্যমহলে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। এরপর প্রায় ৪০টি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। এর মধ্যে তেরটি শিশু কিশোর সাহিত্য ও পনেরটি কাব্যগ্রন্থ।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়টা কিছুটা পোয়াতী নারীর মতন। সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, সবক্ষেত্রেই এই পোয়াতী দসা। বাচ্চাটি প্রসব না হওয়া পর্যন্ত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে এ সময়টা মৃত সন্তান জন্ম দেবে না জীবিত সন্তান? কথা সাহিত্য নিয়ে বা প্রবন্ধ নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনা বা সমালোচনা হয় না। কিন্তু কবিতা নিয়ে প্রায়ই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তাই সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিত্ব সত্তাটাই প্রধান হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ে কবিতাঙ্গনে দুটি ধারা চলছে। একটি ধারা চলছে গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে, পূর্বসূরীদের অবজ্ঞা করে। তারা লিটল ম্যাগ করছে, উত্তরাধুনিকতার নামে তারা কবিতাকে ক্রমশ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করে আনছে। উদ্ভট একটা ধারায় চরছে এরা। এরা ৬০ বা ৭০ দশকের কবিদের স্বীকার-ই করতে রাজী নয় যেন, (নাম বলাটা ঠিক হবে না তাই নাম বলছি না)। অন্যটি ধারাটিও চলছে এই উত্তরাধুনিক ধারায়, তবে তাদের মধ্যে কিছুটা দায়বোধ রয়েছে, তাদের কেউ কেউ সত্যিকার প্রতিভাও বহন করছেন। আমি তাদের নামও বলতে পারি যেমন আলফ্রেড খোকন, টোকন ঠাকুর, কাজী নাসির মামুন, অনিন্দ্য জসিম, হাদীউল ইসলাম, জাহানারা পারভীন প্রমূখ। তবে এরা উত্তারাধুনিক ধারার হলেও এরা কিন্তু উদ্ভটতা থেকে মুক্ত, ভালো লেখেন।
কথা সাহিত্যে নতুন যারা লিখছেন তাদের মাঝে একধরনের দায়বোধ খুঁজে পাওয়া যায়। আধুনিকতার ঢং তাদের মধ্যে আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় আমাদের কথাসাহিত্যের আঙ্গিকটা দুর্বল। এ ক্ষেত্রে বলা প্রয়োজন কথাসাহিত্যের আঙ্গিক দুর্বল হলেও আমাদের কবিতা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি জীবন ঘনিষ্ঠ।
সাহিত্যটাকে সমৃদ্ধ করতে পারতো জাতীয় দেনিকগুলো। ঠিক আজকে ‘সাহিত্য বাজার’ যেটা করছে, এই একইকাজ কিন্তু জাতীয় দৈনিকে হতে পারতো। কিন্তু সেখানেও তারা পরস্পরের পিট চুলকানোর কাজে ব্যস্ত। প্রথম আলো গ্র“প, সমকাল বা জনকণ্ঠ গ্র“প। এ রকম একটা ভাগ তারা করে নিয়েছেন। দৈনিক ইত্তেফাকে নিয়মিত কবিতা লিখছে অথচ প্রথম আলোতে তার কবিতা ছাপছে না-এমন অভিযোগও অনেক। আসলে ঘুরে ফিরে নিজেরাই নিজেদের সাহিত্যপাতার লেখক বা কবি তারা। যে কোন দৈনিকের সাহিত্যপাতার কোন বিশেষসংখ্যা হাতে নিলেই ঘুরে ফিরে গুটিকয়েক নামই দেখা যায়। যেন এদের বাহিরে দেশে আর কোন কবি নেই, আর কেউ কবিতার চর্চা করে না। তাদের আচরণে মনে হয় সাহিত্যপাতার সম্পাদকরাই একমাত্র সাহিত্যিক।
জীবন ও কর্ম
১৯৪৬ সনের ৯ জানুয়ারী ময়মনসিংহ শহরের, সেহড়া বড়বাড়িতে মাতুলালয়ে মুশাররাফ করিমের জন্ম। যৌবনের একাংশ কেটেছে ব্রক্ষপুত্র নদের ধারে ময়মনসিংহ শহরেই। গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার খৈরাটি জজবাড়ি। তাঁর পিতাঃ এম.এ.করিম, মাতা ঃ আমিনা খাতুন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে মোশারফ জ্যৈষ্ঠ। এম.এ (বাংলা) প্রথম পর্ব উত্তীর্ণ হয়েই ইতি টেনেছেন শিক্ষা জীবনের। অভিজাত পরিবারের সন্তান হলেও জীবনে বিচিত্র সব পেশার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। শম্ভুগঞ্জের পেট্রোল পাম্পের সেলস বয় হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা। এক ওষুধ কোম্পানীর বিক্রয় প্রতিনিধ ছিলেন কিছুদিন। সাবানও বিক্রি করেছেন যাদব লাহিড়ী লেনে বসে। এক কলেজে খন্ডকালীন অধ্যাপক ছিলেন। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সাহিত্য পত্রিকা মহুলা এর নির্বাহী সম্পাদকের কাজ করেছেন। জেলা কৃষি-শিক্ষা শিল্প প্রদর্শনীর স্টল ও প্যাভেলিয়ন নির্মাণ ও ঠিকাদারি করেছেন। আবার পেশা বদল। প্রথমে জাতীয় পত্রিকা দৈনিক দেশে পরে দৈনিক দিকালে। তিনি দিনকাল পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক, সাহিত্য সম্পাদক ও যুগ্ম-বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে নেত্রকোণার বিরিশিরিস্থ উপজাতীয় কালচারাল একাডেমীর পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কমরেড সিরাজ সিকদার-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে কাজ করে ষাটের দশকে বামপস্থী ছাত্রনেতা হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ছিলেন, আবার গণতান্ত্রিক ছাত্র সংহতি শিবিরের যুগ্ম আহ্বায়কও ছিলেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গঠনেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা আছে। ঊনসত্তুরের গণ অভ্যূত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে বলিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করেন। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ আরো অনেকের সঙ্গেই তার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ষাট দশকের প্রথমার্ধে তাঁর কাব্য রচনার সূত্রপাত। এ যাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। এগুলি হচ্ছেÑ পাথরের সাথে কথা, অন্য এক আদিবাসে, সে নয় সুন্দরী শারিন, কোথায় নেই দীর্ঘ দেবদারু, নিবেদনের গন্ধঢালা, অন্তরের ব্যাকুল ব্যাধি, কে আছে কেউ কি আছে, নির্বাচিত কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবিতা, কবিতা সমগ্র, বিরিশিরি গীতিকা, যদি এক বর্ণও মিথ্যে বলি, বর্তমানে আছি একাকী-বান্ধবহীন, কোন গাছ নেই নিকট সান্নিধানে ও সকল বাড়ি তোমার জন্যে আকুল। শিশু-কিশোর উপন্যাস লিখেছেন তেরোটি। সেগুলি হচ্ছে-কোকাকা, লেবেডিশ, বোগাস ভূত, গুড ফর নাথিং, শিহাবের যতো কান্ড, নিঝুমপুরের পোড়াবাড়ি, ভয়ংকর ছেলেধরা, আগুনের জ্বিন, ছক্কামামার গালগল্প, হানাবাড়ির গুপ্তধন, চোরাগুহার রহস্য, উপন্যাসত্রয়ী ও কিশোর উপন্যাস সমগ্র। তন্মধ্যে ‘কোকাকা’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কথা সাহিত্যেও কাজ করেছেন। ‘প্রথম বৃষ্টি’ বড়দের জন্য রচিত উপন্যাস। তাঁর দীর্ঘ উপন্যাস ‘পূর্ব পুরুষগণ’ আমাদের কথা সাহিত্যে এক উল্লেখ্যযোগ্য সংযোজন। গল্প রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ও সৃজনশীল। তাঁর প্রথম গল্পগ্রস্থ ছোট বিবির বিত্তান্ত। প্রবন্ধ ও সাহিত্য বিষয়ক কলাম ও গ্রস্থ সমালোচনা লিখেছেন। একজন সাহিত্য সংগঠক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কারের অন্যতম প্রবর্তক। অসংখ্য লিটন ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন। এর মধ্যে ‘তিলোত্তমা’ ‘মহুয়া’ ‘সৌরভ’ ও ‘উচ্চারণ’, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুশাররাফ করিম বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), জাতীয় প্রেসক্লাব সম্মাননা পদক, পূরবী স্বাধীনতা পদক, কালচক্র স্বাধীনতা পদক, জিসাস সাহিত্য পুরস্কার, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব পদক, সময় নৃত্যকলা একাডেমী পুরস্কার, সেবারত্ম সম্মাননা, একুশ শতকের স্রোত পুরস্কার, কমলকলি জিয়া স্মৃতি পদক, স্বাধীনতা সংসদ পুরস্কার, শিরি শিশু সাহিত্য পুরস্কার, জলসিড়ি সম্মননা স্মারকে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়াও ময়মনসিংহ নাগরিক সংবর্ধনা, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব সংবর্ধনা লাভ করেছেন। মুশাররাফ করিম বাংলা একাডেমীর ফেলো, জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য। তিনি বিভিন্ন সময় নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য, শিশু একাডেমীর প্রকশনা বিভাগের সদস্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুস্তক বাছাই ও ক্রয় কমিটির সদস্য, শিল্পকলা একাডেমীর দ্বি-বার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীর সদস্য হিসাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর বিদেশ ভ্রমণের মধ্যে রয়েছে-জাপান, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর। স্ত্রী সখিনা আক্তার কণ্যা নফিসা মাহজাবীন (দোলা) ও মেয়ের স্বামী এনামুল কবীরসহ পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে দুঃখে জীবন কাটছে।
জীবনের বেশিরভাগ সময়ই মফস্বলে পরে থেকে সাহিত্যচর্চা করে চলছেন তিনি। সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি ও অন্যান্য নামে গবেষণাধর্মী গ্রন্থের কাজ নিয়ে এখনো তিনি সমান ব্যস্ত।