আফসান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশ ’৭১ : পর্ব দুই

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

গ্রামীণ সমাজ ও ’৭১

33কুষ্টিয়া

তৃতীয়জন হলেন উজানগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দুর্বাচারার সলিম বিশ্বাস। বিকেল ধনীব্যক্তি, দুই স্ত্রী, ৮ ছেলে ও ৮ মেয়ে। তিনি যুদ্ধের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন এবং সাহায্য-সহযোগিতা দিতে থাকেন। এতে করে অচিরেই তিনি পাকবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন ও পালিয়ে বেড়াতে শুরু করেন। তার এতবড় পরিবারটিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ছেলেরা ভারতে ট্রেনিং নিতে যায়। শুধু তিনিই নন তার পরিবারের সবাই এমনকি আত্মীয়-স্বজনও তার কারণে পালিয়ে বেড়াতে থাকে এবং নানা হয়রানির শিকার হয়। যেমন তার স্ত্রীর বড় ভাইকে শুধু তার কারণেই তিনবার আর্মিক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার ও পরিবারের জীবন রক্ষায় এলাকাতে কৌশলে রটিয়ে দেওয়া হয় যে, ভারতে যাওয়ার পথে সলিম বিশ্বাস ছেলেমেয়ে নিয়ে নদীতে ডুবে মারা গেছেন। প্রতিটি উৎস থেকে একই কথা শোনার পর আর্মি তার সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে তিনি বেশ নিরাপদেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, রাতুল পাড়াতে হুর আলীর নিকট থেকে সলিম বিশ্বাস প্রদত্ত ১টি রাইফেল ও ৫০ রাউন্ড গুলি আর্মি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। ছোটখাট ও কৃশকায় সলিম বিশ্বাস কতটা আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। ধলনগর করিমপুরে পাকসৈন্যদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে তার বড় ছেলে শহীদুল ইসলাম বাবু শহীদ হয় এবং অপর ছেলে সাবু রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া বাবুকে যখন দাফনের জন্য দুর্বাচারাতে নিয়ে আসা হয়, তখন তার বাবা পালিয়ে ছিলেন রাতুল পাড়াতে। ওখান থেকে বাবুর মামা এদবার বিশ্বাস খাটিয়ায় করে দুর্বল ও ভগ্নস্বাস্থ্যের সলিম বিশ্বাসকে নিয়ে যান শেষবারের মতো সন্তানকে দেখাবার জন্য। তবে হার্টফেল করতে পারেন ভেবে প্রথমে না বলে ধীরে ধীরে তাঁকে বলার চেষ্টা করা হয়। এদবার বিশ্বাসের ভাষায়,“ যখন আমরা দুর্বাচারার কাছাকাছি তখন আমি বললাম, ‘ভাইজান। বাবুতো আজ চলে যাচ্ছে (আমি কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না।) শেষদেখার জন্য নিয়ে যাচ্ছি।’ আশ্চর্য যে তিনি অসুস্থ শরীরে খাটিয়ার উপর উঠে বসে বললেন ‘ওহঃ, বাবু চলে যাচ্ছে তাই তোমরা আমাকে নিয়ে আসছ। ওতো যাবেই ওর যে যাবার সময়  হয়ে গেছে।’ সাবু যে ধরা পড়েছে তা তখনও তাঁকে বলিনি। এ-অবস্থায় ও তার যে মনের জোর তা সত্যিই বিস্ময়কর।”

আরেকটা শ্রেণী যারা নিজেরা যুদ্ধ করেন নি, কিন্তু তাদের জীবনে ঝুঁকি ছিল খুব বেশি। এরা হচ্ছেন ইউনিয়ন বা থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা। বেশিরভাগ নেতাই ভারতে চলে যান। কিন্তু যারা থেকে গিয়েছিলেন তারাই এই দুর্ভোগের শিকার হন। তাদের নামে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন রিপোর্ট ইউনিয়নের রাজাকার ক্যাম্প বা শান্তিকমিটির কার্যালয়ে এবং সেখান থেকে আর্মি বা বিহারি ক্যাম্পে দেওয়া হতো। তাদের উপর কড়া নজর রাখা হতো। তারা দিন নিজ নিজ বাড়িতে থাকলেও রাতের বেলা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পালাতে হতো। নিরাপত্তাহীনতার কারণে পান্টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি (’৭১ পূর্ববর্তী) মহিউদ্দিন মোল্লা সপরিবারে শৈলকুপা থানার কাতলাগাড়িতে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। আর তৎকালীন সভাপতি মাওলানা তোফাজ্জেল হোসেন সমগ্র যুদ্ধের সময়কালে কোথাও স্থির থাকেন নি। একদিন পান্টি থাকলে আরেকদিন পাশের গ্রামে কিংবা অন্যদিন নতুন কোনো জায়গায়। সেক্রেটারি আবদুল জলিল মোল্লা তেমন কোথাও যান নি। তবে রাত্রিতে তিনি গ্রামের আখের কিংবা পাটের ক্ষেতে অথবা গ্রামের কিংবা পাশের গ্রামের এমন একজনের বাড়িতে রাত কাটাতেন যাকে কেউ কখনও সন্দেহ করত না। এরপরও তাদের নিস্তার দেওয়া হয় নি। শান্তিকমিটি গঠনের পর তারা এদের সম্পর্কে রিপোর্ট করে এবং পান্টিতে প্রথম আর্মি নিয়ে আসে। নেতাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, তারা আর্মি অফিসারের সাথে যেন দেখা করে। কয়েকদিন পালিয়ে থাকার পর মওলানা তোফাজ্জেল হোসেন ও আবদুল জলিল মোল্লা পরিচিত শান্তিকমিটির এক সদস্যের মাধ্যমে ক্যাম্পে হাজির হন। আর্মি অফিসারটি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে “আপনারা নৌকায় ভোট দিয়েছেন? আপনারা মুজিবের দল করেন?” দুজনেই একবাক্যে স্বীকার করেন যে তারা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি এবং উভয়েই নৌকাতে ভোট দিয়েছেন। পরবর্তী প্রশ্ন ছিল “আপনারা কি জানেন মুজিব দেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে?” মওলানা উত্তেজিত হয়ে উঠলেও আবদুল জলিল মোল্লা বিনীতভাবে বলেন, “আমরা ৬ দফার জন্য ভোট দিয়েছি। এতে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু স্বার্থ ছিল। কিন্তু দেশ বিক্রি করার জন্য আমরা নৌকায় ভোট দিই নি। আর এরকম কিছু হলে আমরা মুজিবকে সমর্থন করব না।” সে তখন বলে, “তাহলে আপনারা তওবা করেন।” সে মুহূর্তে দুজন তওবা করে ফিরে আসেন।

পরবর্তীকালে যুদ্ধের তীব্রতায় পান্টিসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। তেমনি এক সময়ে পান্টি ইউনিয়ন পরিষদ ও শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান খেলাফত উদ্দিন পুনরায় এদেরকে তলব করেন। কিন্তু দেখা যায় যে মওলানাকে যেদিন বাড়িতে পাওয়া যায় সেদিন সেক্রেটারি নেই কিংবা তিনি থাকলেও মওলানা নেই। তারা অবশ্য নিশ্চিত ছিলেন যে, এবারে তাদেরকে মেরে ফেলা হবে। তাদের দুজনকে একত্রে পরামর্শ করে একইসাথে যাওয়ার জন্য রাজাকার ও পিসকমিটির স্থানীয় সদস্যরা অনুরোধ করে। কিন্তু কয়েকদিন অতিক্রান্ত হওয়ায় মওলানাকে না পেয়ে নিরুপায় হয়ে আবদুল জলিল মোল্লা পিসকমিটির সদস্য মোজাম্মেল হক জোয়ার্দ্দারের সাথে উপস্থিত হন। (ইতোমধ্যে তিনদিন তাঁকে ধরে নিয়ে আসার জন্য রাজাকার শফি ডাক্তারকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন।) পান্টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে  বিহারি নেতা মজিদ খানের সামনে তার বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিকেলে বিচার দেখতে পান্টি বাজারের অধিকাংশ লোক মাঠে উপস্থিত হয়। সেখানে খিলাফত উদ্দিন একে একে সেই বিহারির নিকট অভিযোগগুলি পেশ করতে থাকে। সে বলে, “এই ব্যক্তি কুমারখালীর দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করে, তার নির্দেশেই অনেককে হত্যা করা হয়, তার নেতৃত্বে পান্টির রাজাকার ক্যাম্পে হুমকি দেওয়া হয় এবং ক্যাম্প গুটিয়ে  যায়। সর্বোপরি সে স্যারের কাছে (আর্মি অফিসার) তওবা করে আবার সেই কাজ করেছে। এত কিছুর পর তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা উচিত হবে না। আমি তার মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ আশা করি।” মজিদ বিহারি যে ইতোমধ্যেই ‘কসাই’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত হয়েছে সে মৃত্যুর আদেশ দিতে প্রস্তুত হলো। কিন্তু শান্তিকমিটির পরিচিত সদস্য, রাজাকার, পান্টি ও আশেপাশের গ্রামের মুরুব্বী যারা বাজার থেকে বিচার দেখতে এসেছিল তাদের মধ্য থেকে গুঞ্জন উঠতে থাকে। ধীরে ধীরে তা প্রতিবাদে পরিণত হয় এবং সব লোক একে মিথ্যা ও শত্র“তামূলক বলে প্রতিপন্ন করে। তারা মজিদ বিহারির কাছ থেকে আব্দুল জলিল মোল্লার মুক্তি নিশ্চিত করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও জীবন রক্ষা করতে নানারূপ কৌশল অবলম্বন করে। যে এলাকায় আর্মি আসার কথা শোনা যায়, জীবন বাঁচাতে লোকেরা তার আশেপাশের গ্রাম, মাঠ-ঘাটে আশ্রয় নিত। আর যুদ্ধের নয় মাসে এটা জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। রামনগরের বিমল কৃষ্ণ পোদ্দার জানান, আর্মি এলে তারা পাশের বিত্তিপাড়া কিংবা ধর্মপাড়া গ্রামে চলে যেতেন। চাপড়া ইউনিয়নের ধর্মপাড়া গ্রামের কামাস্ক্যা অধিকারী জানান, যেদিন ইউনিয়নে শান্তিকমিটি গঠিত হয়, সেদিনই দুপুরের পরে আর্মি, বিহারিরা ভাঁড়রা গ্রাম ও আশেপাশে অভিযান করে। রণজিত ঘোষকে পুড়িয়ে হত্যা করে। ধর্মপাড়ার সবলোক পালিয়ে গড়াই নদীর চরে আশ্রয় নেয়। সন্ধ্যার দিকে ফিরে এসে সেই রাতেই হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামের অধিকাংশ লোক ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এটা ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথমদিন। কর্মজীবী যেসব হিন্দু ভারত যেতে পারে নি কিংবা যায় নি তারা শান্তিকমিটির চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ করত যা তাদের চরম বিপদের মুখে সহায়তা করত।

বিমল কৃষ্ণ পোদ্দার একাধারে শিক্ষিত, পান্টি স্কুলের কার্যকরী পরিষদের সদস্য (যার সহ-সভাপতি খিলাফত উদ্দিন)। অপরদিকে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে তিনি ‘চাঁদশী ক্ষত চিকিৎসক’(পান্টি ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের পোদ্দার বংশ ওই নামে চিকিৎসা শুরু করে। বিভিন্ন ভেষজ ওষুধের সাহায্যে স্বল্প খরচে জনগণকে খোস, পাঁচড়া, কাটা, ঘা, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করে এবং ছোটখাট অপারেশনের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলে। ক্রমে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়)। তিনি সহজেই চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ করেন। একদিন (প্রথম রোজার দিন) কয়েকজন রাজাকার ধুতি পরিহিত ডাক্তারকে দেখে সাইকেল থেকে নামায়। পরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তারপর এক বাগানে বসে আর্মির হাবিলদারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, যে তার বিচার করবে। এর মধ্যে রাজাকাররা বাগান থেকে বাতাবী লেবু পেরে খেতে থাকে। ডাক্তার বারবার কার্ড দেখালেও রাজাকাররা তার সাথে অশালীন আচরণ করে। কিন্তু যখন হাবিলদারকে কার্ড দেখানো হয় তখন সে আঁতকে উঠে। কারণ কার্ডে যার স্বাক্ষর সে তারই উপর র‌্যাংকের অফিসার। সে সাথে সাথে ছেড়ে দিয়ে বিমল কৃষ্ণ পোদ্দারকে চেয়ারে বসতে দেয়। কয়েকজন রাজাকারকে তাকে ওই এলাকা পার করে দিয়ে আসতে বলে। এবারে রাজাকাররা তার পায়ে ধরতে থাকে যেন রোজার দিন খাওয়ার কথা হাবিলদারের কাছে না বলে। এভাবে সেদিন ডাক্তারের জীবন রক্ষা হয়। তবে আরেকটি সমস্যা দেখা দেয়, আর তা হল পান্টি ক্যাম্পে তার ডাক্তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে এবং  রাতে কিংবা দিন তাকে ক্যাম্পে গিয়ে খোস-পাঁচড়া, যাবতীয় ক্ষত এমনকি যুদ্ধে আহত সৈন্যদেরও চিকিৎসা করতে হতো। তবে অবশ্যই তা গোপনে। আর না গেলে জীবনের ঝুঁকি আরও অনেক বেশি ছিল। তাই নিরুপায় হয়ে যতদিন পান্টিতে আর্মিক্যাম্প ছিল তাকে এই কাজ করে যেতে হয়েছে।

কার্ড পাওয়ার অধিকার থাকার পরও যারা শান্তিকমিটির সাথে যথাযথভাবে যোগাযোগ রাখত তারাই এ কার্ড পেয়েছে। এর জন্য যেমন হয়রানির শিকার হতে হয় তেমনি অনেকে চেষ্টার পরও পায় নি। যেমন শ্রীপুরের যতীন মণ্ডলের ভাই কার্ড করতে পারলেও পান্টির হাজারী মণ্ডল অনেক কষ্টের পরও তা করতে ব্যর্থ হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ান। একরাতে মুক্তিযোদ্ধা কেসমত কিছু সময়ের জন্য তার বাড়িতে এসেছিল এবং অস্ত্রটা এক বেলার জন্য বাড়ির পাশে রেখে গিয়েছিল। কীভাবে যেন এটা জানাজানি হলে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরে রাতে বাড়ি থাকা নিরাপদ নয় ভেবে সে তোফাজ্জেল মৌলভিড় বাড়িতে কয়েক রাত, ইব্রাহিম বিশ্বাসের বাড়িতে কয়েক রাত এভাবে কাটান। বাড়ির মেয়েসহ বেশিরভাগ লোককে বিত্তিপাড়ার জলিল কারিকরের বাড়িতে রাখা হয়। পান্টি বাজার পোড়ানোর দিন পাশের বাড়ির মাছ ব্যবসায়ী হারান একটা ইলিশ মাছ দেয়। রান্নার পরে খাবে এমন সময় আর্মি এসে গেছে শুনে এবং আগুনের ধোঁয়া দেখতে পেয়ে যে যার মতো দৌড়িয়ে বিত্তিপাড়া যান। পরে তাদের দুজনেরই মনে হয় (স্বামী-স্ত্রী) ছেলে সুবোধকে চুলার গোড়ায় শোয়ায়ে রেখে গেছেন। তারা ফিরে এসে দেখেন যে, চুলার ঝিকের গরমে বাচ্চার পিঠ পুড়ে গেছে। এখনও (২০০৩ সাল) সে পোড়ার দাগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন,“সারা সপ্তাহে বাড়িতে মাকু তৈরি করে শনিবারে কুমারখালী বিক্রি করতে যেতাম। একদিন বিক্রি করে ২২ সের চাল কিনি সাথে ছিল আমার বড় ছেলে, যে বেশ ছোট। খেয়াঘাটে আসার পর দেখি যে ভাঁড়রা-ধর্মপাড়াতে অভিযান চালিয়ে আর্মি-বিহারিরা (আর্মির সাথে কুষ্টিয়ার কয়েকজন অবাঙ্গালী ছিল) ঘাটে এসেছে। খেয়া থেকে নামতেই এক বিহারি এসে বলে লাইন দাও। আমি ছিলাম ৬ জনের পরে। আমার আগের সবাই মুসলমান। আমি দেখলাম যে, আজ আর বাঁচতে পারছি না। ছেলের হাতে চাল দিয়ে বললাম যে, আখের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে চাল নিয়ে বাড়ি যা। আর বলবি যে বাবাকে মেরে ফেলেছে। বিহারিরা যখন আমার আগের ৪ জনকে জিজ্ঞাসা করে তখন এক আর্মি বলল যে, এরা সবাই মুসলমান। সবাইকে কলেমা পড়তে বলে। আমিও সবার সাথে পড়লাম। এক বিহারি বলল যে, কাপড় খুলতে হবে। তখন লাইনের প্রথমে থাকা ধর্মপরায়ণ সৈয়দ আনসারী বলেন,‘ আমরা মুসলমান, বেইজ্জতি হতে পারব না, না হলে তোমরা গুলি কর।’ তখন আর্মি এসে সেই অবাঙ্গালীকে চড় দিয়ে সরিয়ে দেয়। আমরা সবাই চলে আসি। বাড়ি এসে দেখি সবাই কান্নাকাটি করছে।”

বুনিরানী (ডোম) জানায় যে, তার ভাই মানিকগঞ্জে এক মুসলমানের বাড়িতে ছিল। সেখানে বিহারিরা তাকে ধরলে সে নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়। তখন তাকে নামায পড়তে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৪/১৫ বছরের এই কিশোর দেখলো যে, ওদের সাথে থাকা নিরাপদ নয় কারণ যেকোনো সময় কাপড় খুলে দেখতে পারে। তাছাড়া নামাযও ঠিকমতো জানা নেই। তাই ২/৩ দিনের মধ্যেই সে পালিয়ে চলে আসে।

সত্যজীবন বাগচী ওরফে শম্ভু ঠাকুর বলেন,“বাড়ি (রামদিয়া) থেকে বাজারে (পান্টি) যাচ্ছিলাম। পথে দেখি আর্মি, যে যাচ্ছে তাকেই ধরে হিন্দু না মুসলমান এরকম অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে। আমাকে দাঁড়াতে বললেও আমি শুনিনি এমন ভাব করে যাচ্ছিলাম। ওরা আমার প্রতি বিরক্ত হয়। কিন্তু ঐ-সময়ে রাজাকার কমান্ডার কুতুবের মা আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। তারপর আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ওইদিন এভাবেই বাঁচি।” তিনি আরও বলেন, পান্টি বাজার পোড়ানোর দিন আর্মি কোথায় আসবে না আসবে ভেবে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। আমিও একদিকে চলে যাই। লোকদের ছোটাছুটি দেখে আমার বৃদ্ধা মা-ও বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যেতে থাকে। ডাকুয়া নদীর ধারেই আমি ছিলাম। সবাই চলে গেলেও আমার মা নদী পার হতে পারেনি। পানির মধ্যে দাঁড়ানো মাকে দেখে আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। মায়ের মুখটা রক্তে ভেসে গেছে, আর আমি মনে করলাম যে মা মারা যাচ্ছে। আসলে মা বাড়ি থেকে বেড়োনোর সময় একটিন মুড়ি সাথে নেয়। কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে টিনের এক দিকে লেগে কপাল কেটে যায়। মা তখনো খেয়ালই করেনি। কিন্তু এত রক্ত পড়ছিল যে আমি গুলি লেগেছে মনে করি।”

সাঁওতার সুধীর বিশ্বাস (৭০)বলেন,“বিহারি নিয়ে (কুষ্টিয়া থেকে) রাজাকাররা যখন আমাদের গ্রামে আসে তখন গ্রামেরই অপর পাড়ায় কিলুদের বাড়ি, কিংবা আশেপাশের পাটক্ষেতের মধ্যে পালাই। যে যেদিকে সুযোগ পায় সেদিকেই পালাতে থাকে। বাড়ির মেয়েছেলেরা কোথায় যাচ্ছে তারও খোঁজ নেওয়ার অবসর নেই। আমার মেয়েটাকে (৬/৭ বছর) গ্রামেরই জলিলের বাড়িতে ওর মা পাঠিয়ে দেয়। রাজাকাররা জলিলের বাড়িতেও হিন্দুরা পালিয়েছে কিনা দেখতে যায়। কিন্তু জলিলের স্ত্রী বলে,‘এখানে কোনো হিন্দু নেই।’ সবকিছু দেখে রাজাকাররা ফিরে চলে যাচ্ছিল তখন মেয়েটা ‘পিসিমা’ বলে মাটিতে বসে থাকা জলিলের স্ত্রীকে বসার জন্য পিড়িটা এগিয়ে দেয়। এতে একজন রাজাকার ‘হিন্দু রেখেছিস’ বলে হাতের রাইফেল দিয়ে আঘাত করলে ওই মহিলাটি অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে অন্য রাজাকাররা চলে যাওয়ায় ওই রাজাকারটিও চলে যায়।

হরিনারায়ণপুরের রাধারমন পাল (৮২) বলেন, “আর্মি আসার কথা শুনলেই আমরা আশেপাশের ডোবা, ঝোপঝাড়ে এবং কুষ্টিয়াতে বোম্বিং-এর সময় কালীনদীর ওপারে জঙ্গলী গ্রামের বিলাত আলী মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নিই। এ ছাড়া অন্য একদিন লক্ষ্মীপুর বাহের মণ্ডলের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি।”

গোবিন্দ ঘোষ (৫৩) জানান, তিনি মহেন্দ্রপুর অভিযানের দিন সানু সর্দ্দারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এদিন সুনীল ঘোষ, সুশীল ঘোষ, গোপাল ঘোষ, সূর্য ঘোষের বাড়ি পোড়ায়। আর্মি দেখেই সবাই বিভিন্ন দিকে পালাতে থাকে। এ ছাড়া একবার তারা (পরিবারের লোক) এহেদ প্রামাণিকের বাড়িতে ৫/৬ রাত ছিলেন। খুব ভোরে বাড়ি এসে সারাদিন থাকতেন। আবার সন্ধ্যায় ওখানে যেতেন। আষাঢ় মাসে তাদের ও চিত্ত ঘোষের বাড়িতে ডাকাতি হয়। কারা ডাকাত তা বোঝা যায় নি। মহেন্দ্রপুর অভিযানের দিন (আশ্বিন মাসে) আর্মি ঘোষপাড়াতে পূর্ণ ঘোষকে হত্যা করে। এ ছাড়াও তিনি জানান, মোল্লা পাড়াতে গফুর মোল্লা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে তার বাবা আকবর মোল্লা ও চাচা জব্বার মোল্লাকে ধরে নিয়ে যায়। জব্বার মোল্লার দুই ছেলে সিরাজ মোল্লা ও সামসু মোল্লাকে পালানোরত অবস্থায় গুলি করে। তারপরও সিরাজ মোল্লা প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে আবার গুলি করে এবং সে সাথে সাথেই মারা যায়। জব্বার মোল্লা ও আকবর মোল্লাকে কুমারখালী নিয়ে হত্যা করে। তবে এদিন শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান মজিবর মুন্সী তার বাবাকে আগেই সংবাদ দেয় এবং অন্যের বাড়িতে আগুন দিলেও তাদের বাড়িতে আগুন দিতে দেয় নি। তার মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নেওয়া এবং অস্ত্র রাখার কথা চেয়ারম্যানকে আগেই জানিয়েছিলেন। তা ছাড়া সে (গোবিন্দ ঘোষ) চেয়ারম্যানের সাথে সবসময়ই যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।

মহেন্দ্রপুরের পদনাথ সরকারের (৭৬) কাছ থেকে জানা যায় যে, আর্মি দিবক সর্দারকে জবাই করে, এতে সে মারা না যাওয়ায় তাকে আবার জবাই করে। সিদ্ধি হালদারকে গুলি করে। কিছুসংখ্যক হিন্দু দয়ারামপুরসহ আশেপাশের গ্রামে অভিযানের কথা জেনে অতি গোপনে আয়ের উদ্দিন শেখের কাছে কয়েক টিন ঘি রাখে। কিন্তু রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা (রাজাকার ও আর্মি) অভিযানে এসে আয়ের উদ্দিনকে ঘরের পাল্লায় বেঁধে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে সে পুড়ে মারা যায়। এ ছাড়া এক পাড়াতে আর্মি ঢোকার কারণে অন্য পাড়ায় ভগবান সরকারের ফাঁকা বাড়িতে কয়েকজন মহিলাসহ কিছু লোক আশ্রয় নেয়। এ সংবাদ পেয়ে আর্মি এসে বাড়িতে তালা লাগিয়ে আগুন দেয়। তবে আর্মি চলে যাওয়ার সাথে সাথে হাজি অখিল উদ্দিন ওরফে ওহিরুদ্দিন হাজি আখক্ষেতের আড়াল থেকে এসে বেড়া কেটে সবাইকে উদ্ধার করে। তিনি বলেন, “এদিন আমাদের গ্রামের গোপাল, মাধাই, ধুনা, বেগো, মঙ্গল প্রামাণিক ও বিশ্বনাথের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ-সময়ে আমরা সবাই বাড়ির ধারেই আখক্ষেতের মধ্যে পালিয়ে থাকি।

আমার মেঝভাই ঘরে কি একটা জিনিস রয়েছে বলে এক দৌড়ে আনতে যায়। কিন্তু ঘরের চৌকাঠে পা দিতেই আর্মি ঢুকে পড়ে এবং তাকে ধরেই মারতে থাকে। ভাইয়ের বৌ এবং বাড়ির মেয়েরো কাঁদতে থাকলে মুখ চেপে বন্ধ করি। কিন্তু আমার মাকে কোনোভাবেই আটকে রাখা যাচ্ছিল না। চোখের সামনে ছেলেকে পিঠমোড়া করে বেঁধে মারতে মারতে গরুর মতো নিয়ে যাচ্ছে। শুধু ভাই না, পাশের ঘরের তারাপদসহ আরও কয়েকজনকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিশ্চিত যে ভাইকে কিছুক্ষণের মধ্যেই মেরে ফেলবে। কিন্তু কোনো একজন রাজাকার সংবাদ দেয় যে, আর্মি অভিযানের কথা শুনেই পিনু শেখের গরু চরভবানীপুর বাথানে রাখা হয়েছে। তখন আমার ভাই আর তারাপদকে বাঁধন খুলে গরু নিয়ে আসতে বলে। মুক্ত হয়ে দু’জন প্রথমে চরে গিয়ে পরে নদী পার হয়ে আমাদের বাড়িতে সংবাদ দেয়। আমরা জীবন বাঁচাতে সে রাতেই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।”

শুধু হিন্দুগ্রামেই যে পাক-আর্মি অভিযান চালাবে আর ভয়ে পালাতে হবে বিষয়টা এরকম ছিল না। সাঁওতা ও কাঞ্চনপুর গ্রামে ২ জন ছাড়া পুরো গ্রামবাসী ছিল রাজাকার কিংবা পাকিস্তানের সমর্থনকারী। এখানে একবার অবাঙ্গালী ও রাজাকাররা অভিযানে আসে। গ্রামের সবলোকই পাশের ডোবা, ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গলে পালাতে থাকে। পরে অবশ্য গ্রামের রাজাকাররা আর্মিকে বোঝাতে সক্ষম হয় এবং তারা চলে যায়।

কুষ্টিয়ার ঐতিহ্য লালনসাঁইর আখড়া বা মাজারেও যুদ্ধের সময় আতংক-ভয় ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে সেখানেই ছোট অয়্যারলেস অফিস, যেখানে প্রতিরোধযুদ্ধে পাক-আর্মির একটা অবস্থান ছিল। তাই কুষ্টিয়া পুনর্দখল করার পরে কোনো বাউলের আখড়াতে অবস্থান বা আসর বসানোটা অকল্পনীয় ছিল। চারিদিকে ভয়, যেকোনো সময় মেরে ফেলতে পারে। বিশেষ করে এটা অবাঙ্গালীদের এলাকা হওয়ায় ভয় আরও বেড়ে যায়। এই ভীতি সাধারণ থেকে শুরু করে বাউলদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।

মাজারের খাদেম বিল্লাল শাহ, বাদের শাহসহ হাতে গোনা কয়েকজন একান্তই লালন প্রেমী মাজারে থাকত। একদিন আর্মি মাজারে এলে বাউলরা যে কয়জন ছিল তারা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে  যায়। তবে আর্মি এসে মাজারের আদব রক্ষার্থে জুতা খুলে প্রবেশ করে। তারা মাজারের জন্য টাকা দান করতে চাইলে বিল্লাল শাহ তা সবিনয়ে ফিরিয়ে দেয়। আরেকদিন আর্মি আসে এবং সেদিনের বাদের শাহ ও বিল্লাল শাহ ছাড়া সবাই পালিয়ে যায়। এদিন তারা মাজারে বিতরণের জন্য অনেক মিষ্টি নিয়ে আসে। কিন্তু তারা যতই অভয় দিক না কেন কেউ সে মিষ্টি নিতে আসেনি। কোনো লোক খুঁজে না পেয়ে তারা তা ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে মাজারে আর্মির ঘনঘন আসাকে বাউলরা সন্দেহের চোখে দেখে এবং সব বাউলই একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাদের শাহ যার বাড়ি মাজারের সাথেই এবং একান্ত শিষ্য, সেও জীবনের ভয়ে কালোয়ায় শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেয়।

ওয়াশীর গোলাম সরোয়ার (৫৫) মাস্টার জানান, তিনি ও তাঁর পরিবার পরিজনসহ গ্রামের অনেকেই পাক-আর্মির ভয়ে গজারিয়া বিলে পালিয়ে থাকতেন। এ ছাড়া পাশের গ্রামটি (বশিগ্রাম) রাজাকার অধ্যুষিত হওয়ায় যেদিন শোনা যেত ওখানে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করবে সেদিন ওরা এসে গ্রামের সম্মানিত লোকের বাড়িতে গোপনে রাত কাটাতেন। মুক্তিযোদ্ধারা এদেরকে সন্দেহ করত না, তবে থাকতে না দিলে কিংবা রাজাকারদের সংবাদ জানিয়ে দিলে গুলি করা হবে এরকম হুমকি দিত। শবেবরাতের রাতে নগরকয়ার আফিল আর কাশেম রাজাকার বিরিকয়ার আফসার উদ্দিন শেখের বাড়ি যায়। চেনা জানা থাকায় ওদেরকে বসতে দিয়ে হালুয়া রুটি গোশত খেতে দেওয়া হয়। ওরা খেয়ে যাবার সময় বলে যে, তেমন কোনো সমস্যা হলে রাতে এসে থাকতে পারি। কীভাবে যেন মুক্তিযোদ্ধারা একথা জেনে যায় এবং আবদুল মাসুদ ফুল কমান্ডারের (বিরিকয়া) নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে আফসার উদ্দিনকে ডেকে বাইরে নিয়ে আসে এবং বাড়ি সার্চ করে। রাজাকাররা রাতে না আসায় মুক্তিযোদ্ধারা কাউকে খুঁজে না পেয়ে চলে যায়। তবে আফসার উদ্দিনকে এ-ধরনের কাজ করতে নিষেধ করে।

আর্মি একবার পান্টি আসার সময় ডাকুয়া নদীর উপরের সাঁকো (চরাট) গ্রামের লোকজন তুলে দেয়। এতে ওরা খুব কষ্টে নদী পার হয়ে এসে লোকদের খুঁজতে থাকে। কিন্তু পান্টি বাজারসহ আশেপাশের সবাই পালিয়ে যায়। আবুল শাহ(৭৯) ওরা কি করে দেখার জন্য দোকানের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে এসে একজন তাকে ধরে ফেলে এবং পান্টি ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে মারধোর করে আর মুক্তিবাহিনী কোথায় জিজ্ঞাসা করতে থাকে। কিছু না জানা থাকায় ও না বলায় তাকে আটকে রাখে। তার মা-বউ ক্যাম্পের সামনে গিয়ে কান্নাকাটি করতে থাকে। অর্ধেক রাতের পরে তাকে বলে ঝাড়–, কাঁথা, মাদূর, বালিশের ব্যবস্থা করে দিতে। সেই রাতে এ বাড়ি ও বাড়ি করে এবং নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে ওদের সেগুলো দেওয়া হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে দুইজন সাথে এসে তার বাড়িটা দেখে যায়। এরপরে তারা যে কয়দিন (প্রায় একমাস) ছিল সারা সময়েই তাকে দিয়ে ছোটখাট প্রয়োজনীয় কাজ করাত। তবে চলে যাবার সময় আধবস্তা আটা আর কয়েক সের চিনি দিয়ে যায়। গাড়োয়ান আবুল শাহ আরও জানান, পান্টি বাজার পোড়ানোর কয়েকদিন আগেই বাড়ির সবাইকে কচুয়া (শৈলকুপা থানা) জামাই বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। ঘোড়াটা ছেড়ে দেওয়া ছিল। তবে গরু বাছুর বাড়িতেই বাঁধা ছিল। পাশের হাকিম শাহদের বাড়িতে আগুন দিলেও দরিদ্র বলে আবুল শাহের বাড়িতে কেউ ঢুকে নি এবং গরুও কেউ নেয় নি। এমনকি ছেড়ে দেওয়া ঘোড়াও পাওয়া যায়। আর আবুল শাহ সেদিন ধানের ক্ষেতে আত্মগোপন করে জীবন রক্ষা করে।

তবে সেদিন মোহননগরে আমজাদের বাড়িতে আগুন দিলে এবং আশেপাশের কয়েকবাড়ি পোড়াতে থাকলে সবাই দৌড়ে যে যার মতো পাটের, ধানের কিংবা আখেরক্ষেতে আত্মগোপন করে। পাটেরক্ষেতে পালিয়ে থাকা ফকির মোল্লা মাথা উঁচু করে আর্মি কতদূর গিয়েছে দেখতে গেলে, সাথে সাথে একঝাঁক গুলি এসে তার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং সে মারা যায়। এ-সময়ে পিসকমিটির সদস্য জোয়াদ মিয়া আর্মির নজর এড়াতে রাস্তার উপর থেকে মাঠের মধ্যে নেমে যায় (আর্মি দেখেই গুলি করছে)। ছোটখাট কিন্তু বিকেল ভুঁড়ির অধিকারী জোয়াদ মিয়া মাঠের মধ্যেই ৪/৫ জন যুবককে সাথে নিয়ে শ্রীপুরের মধ্য দিয়ে রামদিয়া হয়ে নদী পার হয়। তখন তারপরনে মাত্র একটা গামছা, গরমে অস্থির হয়ে মারা যায়, তার এরকম অবস্থা। এদিকে তার ছেলে জাফর মুজিববাহিনীর সহকারী কমান্ডার বলে একজন শান্তিকমিটির সদস্য রিপোর্ট করলে তার বাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!