সাহিত্য বাজার সাহিত্য উৎসব ও সম্মেলনের প্রথমদিনে আগামি ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের অন্যতম চিন্তানায়ক অধ্যাপক যতীন সরকার ও আবৃত্তিগুরু তারিক সালাউদ্দিন মাহমুদ কে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাবে সাহিত্য বাজার। সাহত্য বাজার পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে অধ্রাপক যতীন সরকার এ পত্রিকাটির একজন নিয়মিত লেখক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। তাকে কখনো লেখনীর জন্য যথার্থ সম্মানী দিতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করে পত্রিকাটির সম্পাদক ও উপদেষ্টামণ্ডলীর এ চেষ্টাকে আমরা আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের অন্যতম চিন্তানায়ক যতীন সরকার : মোজাফফর
দারিদ্র্য তাঁর পড়াশুনার পথ রুখতে পারেনি। বরং দারিদ্র্যকে সঙ্গী করেই তিনি পড়াশুনা করেছেন এবং পাশাপাশি লেখালেখিও চালিয়েছেন। বাঙালির বুদ্ধির মুক্তি ও চেতনার বিকাশে সমর্পিত এই চিন্তাবিদ পাকিস্তানের ইতিহাস রচনায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তাঁর পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন নামক অনবদ্য গ্রন্থে। ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র, সাহিত্য, লৌকিক ঐতিহ্য ইত্যাকার বিষয় নিয়ে তাঁর লেখা খুব বেশি নয়। অল্প কিন্তু মর্মভেদী সেসব লেখার জন্য সবার নজর কেড়েছেন তিনি।নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে কেন্দুয়া থানার রামপুর বাজার। গৌরীপুর থেকে রামপুরের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে মদন থানায়। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা হয়ে রামপুরের ভেতর দিয়ে অপর একটি রাস্তা চলে গেছে কেন্দুয়া থানায়। এই চৌরাস্তার মোড় ঘিরে জমে উঠা রামপুর বাজারের পৌনে এক মাইলের মধ্যে চন্দপাড়া গ্রাম। এ গ্রামেই ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট (বাংলা ১৩৪৩ সালের ২ ভাদ্র) যতীন সরকারের জন্ম।
ছোটবেলায় সবাই খেলাধুলা করে। কিন্তু যতীন সরকার ছেলেবেলায় খেলাধুলার দিকে না ঝুঁকে পড়াশুনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। অবশ্য ঝুঁকেছিলেন না বলে তাঁকে ঝোঁকানো হয়েছিল বললে ঠিক বলা হবে। একেবারে ছোটবেলা থেকে আদরে আদরে তাঁকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। তাঁর বাবার কোনো ভাইবোন ছিল না। তাঁর জন্মের আগে তাঁর এক বোন পৃথিবীতে আসার কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। বংশবিলোপের আশঙ্কায় আদরের বাড়াবাড়ির মধ্যে পড়তে হয় যতীন সরকারকে। তাঁর ঠাকুমা তাঁকে বলতেন- ‘তোরে মাথায় রাখি না উকুনে খাবে, মাটিতে রাখি না পিঁপড়ায় খাবে।’ কাজেই, তাঁকে খেলাধুলার সবকিছু থেকে ফিরিয়ে শুধু বইপত্রের মধ্যে একেবারে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বাড়ি থেকে আধমাইল দূরে কবিরাজ বাড়ি। কবিরাজ জগদীশ চন্দ্র নাগ কাব্যতীর্থ সাহিত্যশাস্ত্রী বিদ্যাবিনোদ ভিষগাচার্য বেশ কয়েকটি পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। যতীন সরকার ওইখানে চলে যেতেন পত্রিকা পড়তে। সেখানে ‘বসুমতী’ ও ‘প্রবাসী’-র মতো পত্রিকাগুলোর বাঁধাই করা কপি, সাপ্তাহিক ‘দেশ’ এবং অন্যান্য মাসিক পত্রিকা পড়তেন তিনি। এছাড়া ঠাকুরদা রামদয়াল সরকার তাঁকে রামায়ণ, মহাভারত, রামকৃষ্ণ কথামৃত, স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ইত্যাদি পড়ে শুনাতেন। বাংলার পাশাপাশি সংস্কৃত পাঠেরও শুরু পারিবারিক পরিমণ্ডলেই।
তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকারের হেমিওপ্যাথি ডাক্তারি ছাড়া আর কোনো আয়ের উৎস ছিল না। তাঁদের গ্রাম চন্দ্রপাড়ার পার্শ্ববর্তী দলপা ও নন্দীগ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। পাকিস্তান হওয়ার পরপর ওই এলাকার লোকজন ব্যাপক হারে ভারতে অভিবাসী হয়। ফলে তাঁর বাবার ডাক্তারি পেশার প্রসার কমে আসে। তাঁর পরিবার দারুণ আর্থিক দৈন্যের মধ্যে পড়ে যায়। ফলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই রামপুর বাজারে তাঁকে দোকান খুলে বসতে হয়। বাজারে চাটাই বিছিয়ে তিনি ডাল, পান, বিড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি বিক্রি করে সংসারের প্রতিদিনের খরচ জোগাতে থাকেন।
প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁকে পড়াশুনা করতে হয়েছে।১৯৫৪ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিলেও আই.এ. ক্লাশে ভর্তির টাকা জোগাড় করার জন্য তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। টিউশনি করে টাকা জমিয়ে ১৯৫৫ সালে আই.এ. ক্লাশে ভর্তি হন নেত্রকোনা কলেজে। শহরে লজিং থেকে চালিয়ে যান লেখাপড়া। এই কলেজের ছাত্রসংসদে তিনি সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যে পরিবারে লজিং থাকতেন সে পরিবারের অভাবের সংসারে অর্থের যোগান দেওয়ার পাশাপাশি অনেকদিন সবার সাথে তাঁকেও থাকতে হয়েছে অনাহারে। নেত্রকোনা কলেজ থেকে আই.এ. পাশের পর ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে বি.এ. ভর্তি হন। ময়মনসিংহ শহরে লজিং থেকেই শুরু হয় তাঁর বি.এ. পড়া। ১৯৫৯ সালের বি.এ. পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষকতা শুরু করেন নেত্রকোনার আশুজিয়া হাইস্কুলে। পরে বারহাট্টা থানা সদরের হাইস্কুলে শিক্ষকতা। এই স্কুলেই কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ছাত্র ছিলেন। ১৯৬১ সালের গোড়া পর্যন্ত প্রায় দুই বছর শিক্ষকতা করে টাকা জমিয়ে বাংলায় এম.এ. ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও তাঁকে কষ্ট করে পড়াশুনার খরচ যোগাতে হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুস্তফা নূরউল ইসলাম। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩-এর অক্টোবরেই বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাইস্কুলে। ১৯৬৪ সালের আগস্টে ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিষয়ে প্রভাষক নিযুক্ত হন। ২০০২ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি অবসরে যান।
বালক বেলার রামপুর বাজারকে যতীন সরকার ‘দুনিয়ার জানালা’ হিসেবে অভিহিত করেন। দুনিয়ার খবরাখবর প্রথম এ বাজারেই এসে পৌঁছত এবং পরে ছড়িয়ে পড়তো গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। রামপুরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ডিস্ট্রিক বোর্ডের ওই রাস্তা ধরে নেত্রকোনা আসা কিন্তু সহজ ছিল না। বর্ষাকালে প্রায় দশ মাইল পথ হেঁটে জলে-কাদায় মাখামাখি হয়ে নেত্রকোনা মহকুমা সদরে (বর্তমানে জেলা) আসতে হতো। গ্রামের কারও কারও সাইকেল ছিল। কালেভদ্রে শহর থেকে ধনীদের কেউ কেউ আসতেন ঘোড়ার গাড়িতে করে। তখন ছেলে বুড়ো সবাই ঘোড়ার গাড়ি ও শহরের মানুষ দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত।
রামপুর ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলই তাঁর বাল্যের স্কুল। ভালো ছাত্র তিনি ছিলেন না। স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সাথে নিতান্ত পরীক্ষা পাসের জন্য যেটুকু দরকার, সেটুকু ছাড়া কোনো সম্পর্কই ছিল না। পরীক্ষায় ফেল করেননি, কোনও রকমে পাস করেছেন। যতীন সরকারের শিক্ষা ও পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলেছে রাজনীতি ও লেখালেখির প্রস্তুতি। নেত্রকোনা কলেজে আই.এ. ক্লাসে পড়ার সময় সরাসরি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তখনও ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়নি। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়েই শুরু তাঁর ছাত্র রাজনীতি। ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কমিউনিজমে দীক্ষা নেন তিনি। ময়মনসিংহ শহরের চন্দ্রকান্ত ঘোষ (সিকে ঘোষ) রোডে ছিল নয়া জামানা পুঁথিঘর। বইয়ের দোকান হলেও এটিই ছিল ময়মনসিংহে কমিউনিস্টদের অলিখিত অফিস। সবাই জমায়েত হতো এখানেই। আর একটি আড্ডা বসতো শৈলেন রায়ের বাসায়। এই দুই আড্ডায় অবাধ যাতায়াত ছিল যতীন সরকারের। এ সময়টাতেই তাঁর হাতে আসে জোসেফ স্তালিনের ‘দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ এবং মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ । এ দুটি পুস্তক তাঁর মানকে প্রচণ্ড আলোড়িত করে।
যতীন সরকারের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় আনন্দমোহন কলেজে বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময় কলেজ বার্ষিকীতে। সেটি ছিল একটি রম্যধর্মী রচনা। নাম ছিল- ‘আপনি কি লিখিয়ে?’ এরপর দীর্ঘদিন তিনি লেখেননি কোথাও। এরপর বাংলা একাডেমী ‘পূর্ব পাকিস্তানের উপন্যাসের ধারা’ শীর্ষক প্রবন্ধ আহ্বান করে। উল্লিখিত বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ লিখে ১৯৬৭ সালে তিনি ডক্টর এনামুল হক স্বর্ণপদক লাভ করেন। ওই লেখাটা বাংলা একাডেমী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পরে আহসান হাবীব ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ সেটা পুনর্মুদ্রণ করেন। আহসান হাবীব ওই সময় তাঁকে দিয়ে বেশকিছু প্রবন্ধও লিখিয়ে নিয়েছিলেন।
যতীন সরকার ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বরে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের কাজ করতে থাকেন। এদিকে দেশে তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রী কানন সরকারকে তাঁর বাবার পরিবারের সঙ্গে আত্মরক্ষার তাগিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়।
যতীন সরকারের প্রথম গ্রন্থ সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। সাহিত্যের কাছে তাঁর প্রত্যাশার বিষয়টি এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতে উপস্থাপন করেছেন তিনি। মুক্তধারা থেকে প্রকাশিত তাঁর এ গ্রন্থ দিয়েই তিনি প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলাসাহিত্যে নিজের অবস্থান জানান দেন। এত বেশি বয়সে প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের ঘটনা বাংলাসাহিত্যে আর কোনো লেখকের ক্ষেত্রে ঘটেছে বলে মনে হয় না। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিভাবান নই। আমি কষ্ট করে লিখি। যা লিখি তা-ও আবার পড়ে আমারই পছন্দ হয় না। এসব কারণে ভরসা পাইনি এবং এখনও পাই না। অন্যরা হয়ত প্রশংসা করে ঠিকই।’
এরপর একে একে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমী থেকে ‘বাংলাদেশের কবিগান’ (১৯৮৬), ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’ (১৯৮৬), হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে ‘মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’ । এ প্রবন্ধ গ্রন্থগুলোর পাশাপাশি শিশুদের জন্য সুপাঠ্য একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’ (১৯৯৪) বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে এবং ব্যাকরণ গ্রন্থের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বাংলা একাডেমীর জীবনী গ্রন্থমালার মধ্যে চারটি গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। সেগুলো হচ্ছে, ‘কেদারনাথ মজুমদার’, ‘চন্দ্রকুমার দে’, ‘হরিচরণ আচার্য’, ‘সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী’। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী’, ‘প্রসঙ্গ মৌলবাদ’ ও ‘জালাল গীতিকা সমগ্র’ । নন্দিত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘জালাল গীতিকা সমগ্র’ বাংলাসাহিত্যে নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা ।
বাংলাসাহিত্যে ‘আত্মজীবনীর বিবেচনায়’ এবং ‘পাকিস্তান ও বাংলাদেশ’ নামক দুটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রজীবনীর যৌথতায় একটি অনন্য গ্রন্থ ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন’ (সাহিত্যিকা-২০০৪)। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাস সন্ধানীদের জন্য এটি অসাধারণ একটি গ্রন্থ। তাঁর আরো দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনা’ (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ২০০৬), ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’ (জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ২০০৭)।
যতীন সরকার বিয়ে করেন ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে বন্ধু শচীন আইচের বোন কানন আইচকে। তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে। ছেলে সুমন সরকার ও মেয়ে সুদীপ্তা সরকার। দুই ছেল-মেয়েই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
যতীন সরকার শুধু মানুষের চিন্তার মুক্তির জন্য লিখে লড়াই করেননি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সরাসরি জড়িত থেকে ভূমিকা পালন করেছেন সক্রিয়ভাবে। বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য হওয়ার মতো সাংগঠনিক সম্মানের পাশাপাশি উদীচীর সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। এছাড়া ময়মনসিংহ নাগরিক কমিটি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। যতীন সরকারের এ সাংগঠনিক ভূমিকার শুরু হয়েছিল কলেজে পড়ার সময় থেকে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন। এতকিছুর মধ্যে নিজের একান্ত প্রিয় সংগঠন ময়মনসিংহের মুক্ত বাতায়ন পাঠচক্র । এখানেই যতীন সরকারের অনেক প্রবন্ধের প্রথম পাঠ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। সাংগঠনিক ভূমিকার সূত্রেই তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় নেত্রকোনার মতো অজপাড়াগাঁয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিটিং মিছিল করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা রাখেন।
নিজেকে ঘরকুনো স্বভাবের মানুষ বলেই মনে করেন তিনি। তারপরও ঘুরে এসেছেন চেকোশ্লোভাকিয়া ভেঙে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র স্লোভাকিয়া। ২০০১ সালে ছেলের কাছে কয়েক সপ্তাহ থেকেছেন স্লোভাকিয়ার রাজধানী বাতিস্লাভায়। ৪২ হাজার বর্গমাইলের (বাংলাদেশের প্রায় সমান) এবং ৫৫ লাখ মানুষের এ দেশটিকে গভীরভাবে জানার সুযোগ হয়েছে তাঁর। এর আগে ১৯৮১ সালে গিয়েছিলেন বার্লিনে। বার্লিন তখন পূর্ব জার্মানির রাজধানী। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন গ্যাটে সম্পর্কে বলতে হয়েছিল তাঁকে। ২০০১ সালে তিনি উদীচী সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন লন্ডনে। ভারতে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। সর্বশেষ ২০০৫ সালে লক্ষ্নৌয়ে ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তিনি।
২০১০ সালে তাঁকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়। নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ তাঁকে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে। এছাড়া মনিরউদ্দিন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কার, শ্রুতি স্বর্ণপদক (নারায়ণগঞ্জ), ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব সাহিত্য পুরস্কার এবং প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১১ পুরস্কার-এ ভূষিত হয়েছেন তিনি। এসবের বাইরে নেত্রকোণা উদীচী, ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ ও কেন্দুয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে।
রবন্ধ ও গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০০৭ সনের বাংলা একাডেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক যতীন সরকারের জন্ম নেত্রকোনা জেলার চন্দ্রপাড়া গ্রামে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে। লেখকের প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’। ২০০৫ সালে তাঁর ‘পাকিসত্মানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’-এর জন্য তিনি ‘প্রথম আলো’ পুরষ্কার পান। চল্লিশ বছরেরও অধিক কাল অধ্যাপনার সাথে যুক্ত থাকার পর বর্তামানে তিনি নেত্রকোনায় অবসর জীবন-যাপন করছেন।
কৃতজ্ঞতা : শাশ্বতিকীর লোকসংখ্যা ও উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে।