রঙিলা রাজা : আফরোজা অদিতি

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

khulna-3রঙিলা রাজা
আফরোজা অদিতি
সবুজ সবুজ পাতা আর হরেক রকম ফল ফুলে ভরা এক বন। বনেরর গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে দিনে সূর্যের আলো আর রাাতে চাঁদের আলো টুকরো টুকরো ছড়িয়ে মায়া মায়া করে রাখে সেই বনের পরিবেশ। সেই বনের গা ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে এক হাওড়। হাওড়ের জলে রঙ-বেরঙের মাছ ছাড়াও কাঁকড়া, গুগলি, শামুকেরা খেলা করে, খায়-দায় থাকে। অতিথি পাখিরা আসে-যায়। ওই বনে হাতি, গন্ডার, সিংহ, বাঘ হরিণ তো আছেই আরও আছে খরগোস, কাঠবিড়ালি, বনমোরগ, বাঘডাসা। নানান প্রজাতির পাখ-পাখালি, প্রজাপতি, ফড়িং ওড়ে, উড়ে উড়ে এ ফুল, ও ফুল, পাতা, ঘাস, ঘাস-ফুলে বেড়ায়। সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো ওরাও বাস করতো ওই বনে। বনের পাশের হাওড়ের জল খায়, সেখানেই গা ধোয় বনের পশু-পাখি। ওই বনে সকলেই বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলো।
কিন্ত একদিন, এক সিংহ ঘোষণা দিলো বনের রাজা হিসেবে মানতে হবে তাকে। সিংহের হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো বন, কেঁপে উঠলো বনের পশু-পাখি। ভয়ে ভয়ে সিংহকে, রাজা হিসেবে মেনে নিলো বনের পশু-পাখিরা। ভালোই চলছিলো সিংহের রাজ্য। কেউ কিছু বলতো না, বলার সাহসই পেতো না। একদিন এক শিকারীর গুলিতে সিংহরাজা আহত হলো, মারা গেলো। সিংহাসনে বসলো নতুন সিংহরাজা। নতুন রাজা রাজদন্ড হাতে পাওয়ার পর কেমন যেন বদলে গেলো বনের পরিবেশ। নতুন রাজা হওয়ার পর অন্যান্য সিংহরা  নিজেদের মনমতো কাজ করতে শুরু করলো। সিংহরা, ওদের থেকে দূর্বল প্রণীদের ঘাড় মটকে খেতে শুরু করলো। শুরু করলো অত্যচার। যে পথে হরিণেরা যাবে পানি খেতে সে পথে গাছের ডালপালা জড়ো করে ব্যারিকেড দেয়। যাতে হরিণ, খরগোস বা নিরীহ সব প্রাণী যাওয়ার সময় খেতে পারে। সিংহরা হরিণ দেখলেই তাড়া করে। খরগোসদের না পেয়ে ওদেও বাসা ভেঙে দেয়। যখন তখন গর্জন করে। ওদের ডাকে পাখির বাচ্চা ভয় পেয়ে বাসা থেকে পড়ে যায়। ওদের অত্যাচারে খুব অসহায় হয়ে থাকে বনের অন্যান্য পশু-পাখিরা।
শিয়ালপন্ডিতের পাঠশালা ছিলো নদীর তীরে একটা উঁচু ডিবির ওপর, সেটাও একদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো সিংহ রাজার চ্যালা চামুন্ডা। ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’- এরকম মনোভাব তাদের। হুঙ্কার দিলো তারা, সব বন্ধ, সব। সিংহ ছাড়া কেউ তাদের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারবে না, থাকতেও পারবে না। এই বনে যারা আছে তাদের কাজ শুধু সিংহের খাদ্য হওয়া আর খাবার সাপ্লাই করা, এবং ‘জী হুজুর’, ‘জী হুজুর’ করা। বনে তো শুধু ভালো প্রাণীরাই থাকে না, খারাপ মনোভাবের পশুরাও থাকে। এ রকম কিছু পশু-পাখি জী হুজুর, জী হুজুর করতে শুরু করে সিংহ রাজাকে। ওই সব পশু পাখিদের জন্য সিংহদের অত্যাচার বাড়তে লাগলো। বনের ভেতর চলল সিংহদের দাপাদাপি। তখন সিংহদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে অন্যান্য পশুরা একজোট হলো, বললো, এভাবে থাকা যায় না। আমরা রাজার কাছে যাবো, সব কথা খুলে বলবো। সবাই মিলে তো একসঙ্গে কথা বলা যায় না, তাই ওরা ঠিক করলো বাঘ, ওদের হয়ে কথা বলবে। বাঘও রাজী হলো।

সিংহরাজার দরবার। শুধু সিংহরাই নেই। সেখানে আছে কিছু বাঘ, আছে শিয়াল, আছে হরিণ, গন্ডার, হাতি, ঈগল, বাজ। এদের সংখ্যা কম, এরা জী হুজুরের দলে তাই এদের কোন কথা কানে নেয় না সিংহ রাজা। দরবারে যে সব বাঘ, শিয়াল, হরিণ, গন্ডার, হাতি, পাখি আছে তারা সিংহের কথার কোন কথা বলে না। নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করতে চায় না তারা।

অত্যাচারিত, নির্যাতিত পশু পাখিরা যে বাঘকে তাদের প্রতিনিধি করেন দরবারে পাঠালো, সেই বাঘ, সবার হয়ে দরবারে ওদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়নের কথা বললো। কিন্তু সিংহরাজা শুধু বললো দেখবো! দেখবো! সব তো শুনলাম, সব দেখবো! কিন্তু কোন ফল হলো না। দিন দিন অত্যাচার, নিপীড়নের সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো পশু-পাখি।

একদিন গভীর রাতে সিংহরাজাকে মেরে ফেলে রাজা হলো রঙিলা শিয়াল। এই শিয়ালের কাহিনী আবার ভিন্ন রকম। ওই শিয়ালটা বেজায় চালাক। রাজাকে মারার আগে চুপিচুপি নদীর অপর পাড়ে, গ্রামের এক চিত্রকরের বাড়ি গিয়ে হাজির। চিত্রকরতো শিয়ালকে দেখেই তার পোষা কুকুরকে ডাক দিলো, আয়, আয় তু তু —।

পোষা কুকুরকে ডাকতে শুনেই শিয়াল তো লাফিয়ে গিয়ে পড়ল চিত্রকরের পায়ের ওপর। চোখের জল ঝরিয়ে অনুনয় করে বলতে শুরু করল, দোহাই চিত্রকর মশাই ডাকবেন না, ডাকবেন না আপনার পোষা কুকুরকে। আমি, আপনার মুরগী, হাঁস, কবুতর কিছুই নিতে আসি নি। আমি এসেছি নিজেকে একটু রাঙিয়ে নিতে। আপনি তো ভালো আঁকিয়ে, আপনি আপনার রঙ দিয়ে আমাকে একটু চিত্র-বিচিত্র করে দিন। আমি বনের রাজা হতে চাই।
চিত্রকর, শিয়ালের অনুনয় শুনে রাঙিয়ে দিলো শিয়ালকে। নিজেকে চিত্র-বিচিত্র করে বনে গেল। পশু-পাখিদের বলল, আমি, রঙিলা শিয়াল। সেই রঙিলা শিয়াল এখন বনের রাজা। সিংহ ছাড়া বনের অন্যান্য পশু-পাখি ভাবল, নতুন রাজা এলো, ওদেরও সুখের দিন আসবে।
মাস কয়েক ভালোই গেল। এর মধ্যে পশুপাখিরা ভাগ হয়ে গেল। নিজেদের ঐক্য ধরে রাখতে পারল না। সিংহরাতো ঐক্যবদ্ধ দল ছিল। সেই  ঐক্যবদ্ধতা ভেঙে দিতে ওই দলে ঢুকলো কিছু চালাক-চতুর পশু-পাখি। তারা তোয়াজ-তোষামোদে সিংহদের পিছুপিছু চলতে লাগল। তাদের মনে নেতা হওয়ার স্বপ্ন, রাজা হওয়ার স্বপ্ন। রঙিলা শিয়াল ভালোই রাজত্ব করছে। বনের নিরীহ পশুপাখি খুশী। খুশী নয় সিংহ, সিংহের তোষামোদকারীরা এবং নতুন নতুন যারা সিংহের দলে যোগ দিয়েছে তারা। সিংহ তো রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেই, সেইসঙ্গে রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে দলে নতুন ঢুকেছে যারা, তারা। তারা একটা সভা ডাকল।
সভা বসল। সভায় সিংহ, বাঘ, গন্ডার শক্তিশালী। হাতির শক্তি বেশী, আয়তনে বিশাল কিন্তু বুদ্ধি কম, তাই তারা হাতিকে গোনার মধ্যে না নিয়ে বলল, আমরা যা বলবো তাই হবে।
সিংহ, এক তোষামোদকারী বাঘকে ডেকে বলল, তুমি বলো, আমরা কী ছিলাম, কী চাই। বাঘ, সভায় আসা সকলের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা জানো যুগ যুগ ধরে এ বনের রাজা সিংহ। ওই রাজদন্ড ছিল সিংহের হাতে। কিন্তু সিংহরা বলেছে এখন বনের পশু-পাখিরা যাকে চায়, সেই হবে রাজা। তোমরা, আমাদের সঙ্গে আসো, ওই রঙিলা শিয়ালকে বের করে দেই বন থেকে। তোমাদের কোন অসুবিধা আর হবে না। পশুরা, যারা বাঘ-সিংহের পক্ষে ছিলো তারা সবাই সায় দিলো বাঘের কথায়। রঙিলা শিয়ালের পক্ষে যারা ছিল, তারা সংখ্যায় কম, তবুও ওদের মধ্যে বুদ্ধিমান ফিঙে গাছের ডালে ওপর থেকে বলল, শিয়াল রাজা তো মন্দ নয়, থাক না।
ফিঙের কথায় হুঙ্কার দিয়ে উঠল বাঘ। এই বাঘ সিংহের কথা বললেও তার মনের সুপ্ত আকাঙ্খা বনের রাজা হওয়ার। তার একটা দলও আছে। সেই দলের সবাই একচোটে দাঁড়িয়ে গেল। পাখিরা সকলে উড়ে গেল, পালিয়ে গেল শিয়ালের পক্ষের পশুরা।
একদিন,সিংহের তোষামোদকারি দলের পশুরা বন থেকে বের করে দিল রঙিলা শিয়ালকে। তারপর ওই পশু-পাখিরা বলল, রাজা হবে সিংহ। কিন্তু বনের অন্য পশু-পাখিরা বলল, এতোদিন আমরা সিংহ-রাজাকে পেয়েছি, এবার রাজা বদল হোক। সিংহ বলল, তা’হলে কে রাজা হবে, বাঘ, হাতি, গন্ডার না অজগর। সকলে বাঘের পক্ষে রায় দিলো। পশুর রাজা হলো বাঘ। বাঘের হাতে রাজদন্ড। বুক জ্বলে যায় সিংহের। আবার অরাজকতা শুরু হয় বনে। বনের দূর্বল পশু-পাখি, সবার মনে কষ্ট। কেউই তাদের মনের মতো নয়।
রাজা ছিলো সিংহ। তারপর রাজা হলো রঙিলা শিয়াল। এখন রাজত্ব চলছে বাঘের। কিন্তু ওদের দিন যে কে সেই। ওদের জীবনের কোন উন্নতি নেই। ওরা খেতে পায় না। ওদের খেতে হলে এ বন ছেড়ে অন্য বন কিংবা অন্য কোনখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া বেশীরভাগ সময় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়। ওদের জন্য গাছের ছায়া নেই, ঘাসের বন নেই। ওদের অবস্থা একটা চাদরে অনেকের শীত নিবারণের মতো। এদিক টানলে ওদিক আলগা হয়, ওদিক টানলে এদিক।
পাখিরা খুব একটা অসুবিধায় থাকে না। কারণ ওরা থাকে গাছের ওপর। অসুবিধা খরগোস, হরিণ, আর অন্যান্য দূর্বল প্রাণীদের। বর্ষাকালে বৃষ্টি, বন্যায় বনের ভেতর জল টলটল করে তখন ওরা বসবাসের জন্য উঁচু জায়গা পায় না। ওরা তখন উঁচু জায়গার খোঁজে বের হয়, তখন সবল পশুরা মেরে বের করে দেয়, না হয় খেয়ে ফেলে।
এই অবস্থা দেখে একদিন উড়ে এলো এক ফিঙে। ওইসব অত্যাচারিত পশুর কাছে এসে বলল, আমরা এভাবে মরতে চাই না, আমরা বাঁচতে চাই। সবার মুখে তখন ওই এক কথা, আমরা মরতে চাই না, আমরা বাঁচতে চাই। কথায় কথায় একসময় শ্লোগান হয়ে গেল কথাটা। আমরা মরতে চাই না, আমরা বাঁচতে চাই।
ফিঙের নেতৃত্বে শুরু হলো দিনবদলের কর্মসুচী। ওদের আশা, একদিন জয় ওদের হবেই হবে।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!