চলনবিলের চালিকাশক্তি কিম্বা সিংড়ার প্রাণ বলা যায় তাকে। নিজ এলাকার মানুষের পাশে থাকার প্রতিযোগিতা যদি করা হয়, তাহলে নীলফামারী সদরের আসাদুজ্জামান নূর এমপি আর নাটোরের সিংড়া থেকে নির্বাচিত সর্বকনিষ্ঠ সাংসদ জুনাইদ আহমেদ পলক এর নাম উঠে আসবে একই সারিতে। আর একইসাথে জনপ্রিয়তার কাতারে উঠে আসবে নাটোর ৪ গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম আসনের সাংসদ অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস এর নাম। যদিও বর্তমানে সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভাজন স্পষ্ট।
এটা কোনো তৈল বা তোষামোদ নয়। সরেজমিনে সাহিত্য বাজার জেলায় জেলায় সাহিত্য সংস্কৃতির তথ্য সংগ্রহের সময় নীলফামারী ও নাটোরের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত বক্তব্য। যদিও অভিযোগও কম নয় পলকের বিরুদ্ধে। তবে তা বেশিরভাগই বিরোধী পক্ষের বা সুবিধা বঞ্চিত দলীয় কর্মীর বলে দাবী পলক সমর্থকদের।
নীলফামারীর সদর ছাড়াও ডোমার ডিমলা বা জলঢাকা-কিশোরীগঞ্জ ও সৈয়দপুরে এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে আসাদুজ্জামান নূর এমপির পদচারণা নেই। এখানের মানুষের বক্তব্য প্রতি বৃহস্পতিবার স্বপরিবারে নীলফামারিতে চলে আসেন সাবেক সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার সহধর্মিণী ডাঃ শাহিনা নূর নিয়মিত ফ্রী রোগী দেখেন এখানে। আর এমপি নূর ঘুরে বেড়ান জেলার বিভিন্ন উপজেলায়। নিজ আসনের বাইরে যেয়েও নিঃস্বার্থ সেবা দেন তিনি। ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেশিরভাগ রোগী পাওয়া যাবে নীলফামারী ও রংপুর জেলার। যারা আসাদুজ্জামান নূর সাহেবে ও তার সহধর্মিণীর সাহায্য নিয়ে এখানে চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছেন। এমনটাই বক্তব্য নীলফামারীর সাধারণ মানুষের। প্রায় একই বক্তব্য পাওয়া গেল নাটোর এলাকায়।
এখানে সিংড়া উপজেলার বাইরেও সাংসদ পলকের যাতায়াত। এলাকাবাসী বলেন, লাভ ক্ষতির পরোয়া করেন না আমাদের সাংসদ। সমস্যা হয়েছে শুনলেই তিনি ছুটে আসেন এবং সমাধানের জন্য মরীয়া হয়ে পরেন। বিশেষ করে সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌসের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। ইউপি নির্বাচনের পর তিনি বলেছেন, এখানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ইউপি নির্বাচনে দৃষ্টি দিলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে। ১২টি ইউনিয়নের ৮টিতে আওয়ামী লীগের জয় হয়েছে। চারটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনে বিএনপি বা বিএনপি সমর্থিত কেউ অংশ নেননি। নৌকার বিরুদ্ধে যাঁরা বিদ্রোহী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন, তাঁরাও দলের কোনো না কোনো পদে রয়েছেন। তাঁরা সবাই স্থানীয় সাংসদ জুনাইদ আহ্মেদের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনীতি করেন। এখানে পলকের বিকল্প নেই।
তবে পলককে ঘীরে স্থানীয় আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্বও রয়েছে যা স্পষ্ট ইউপি নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত কমিটির একজন শীর্ষ নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ভুল ছিল। ফলে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিংড়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরোধের বিষয়টি আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।
জুনাইদ আহমেদ পলক একজন বাংলাদেশি আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদ তিনি। এছাড়া ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তরুণ এই রাজনীতিবিদ। তিনি পরপর চারবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন।
জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, এলাকায় কতটুকু কি করেছি তা এলাকার মানুষ বলবেন। আমার এলাকার ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য আর নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী যেতে হয় না। আওয়ামী লীগ সরকার সিংড়ায় তিনটি অনার্স কলেজ করে দিয়েছে। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। ৩২৯টি পৌরসভার রোল মডেল সিংড়া পৌরসভা। গত ১৩ বছরে সরকারের সব অবদান জনগণের কল্যাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছি আমি।
পলক বলেন, আমার এলাকার কোনো মানুষকে কোনো ভাতা নিতে ঘুষ দিতে হয় না। বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত সিংড়ার ৫ লাখ মানুষ। ঘরে বসে বিদেশি আইটি কোম্পানিতে কাজ করে অর্থ উপার্জন করছে এখানকার যুবকরা। যার অবদান পুরোটাই জাতীর জনকের সুযোগ্য উত্তরসূরী সজীব ওয়াজেদ জয়ের। ৩৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিংড়ায় হাইটেক পার্ক ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই শীতে জনগণকে রক্ষার জন্য কম্বল নিয়ে এসেছি। সিংড়া উপজেলায় ১৫ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে।
জুনাইদ আহমেদ পলকের জন্ম ১৯৮০ সালের ১৭ মে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার সেরকোল তেলিগ্রামে। বাবার নাম ফয়েজ উদ্দিন ও মা জামিলা আহমেদ। ১৯৯৫ সালে সিংড়া দমদমা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৭ সালে রাজশাহী ওল্ড ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন জুনাইদ আহমেদ। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজ হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এল.এল.বি ডিগ্রি অর্জন করে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
বাবা মরহুম ফয়েজ উদ্দিনের পদানুসরণ করে বিশ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের একজন সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগ দেন পলক। আটাশ বছর বয়সে ২০০৭ সালে সিংড়া নির্বাচনী এলাকা থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। তার স্ত্রীর নাম আরিফা জেসমিন কনিকা। পলক-কনিকা দম্পতির তিন সন্তান। তারা হলো অপূর্ণ জুনাইদ, অর্জুন জুনাইদ এবং অনির্বান জুনাইদ।
সিংড়া উপজেলার উত্তরে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলা, দক্ষিণে গুরুদাসপুর অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস এমপির এর নিজ উপজেলা। দীর্ঘ ৬০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অনেক ত্যাগ তিতীক্ষার সাক্ষী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাঁচবারের সাংসদ প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস বলেন, জুনায়েদ আহমেদ পলক সম্পর্কে কিছু বলার অযোগ্য আমরা প্রবীণরা। তিনি দুইবারের মন্ত্রী। তার অবস্থান আর আমাদের অবস্থান আকাশ-পাতাল ব্যবধান। সিংড়া উপজেলার পূর্বে রয়েছে সিরাজগঞ্জের তাড়াস উপজেলা, পশ্চিমে নওগাঁর আত্রাই উপজেলা। সিংড়া উপজেলা মোট আয়তন প্রায় ৫৩১ বর্গ কিলোমিটার। এ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ৪৩৯ টি গ্রাম রয়েছে এবং লোকসংখ্যা বর্তমান হিসাবে প্রায় সাত লাখ। ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ প্রায়। এখানকার চৌগ্রামের রাজবাড়ী, তিসিখালীর মাজার, চলনবিল ও গণকবর উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। আর এই চলনবিলের চালিকাশক্তি বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকে। কেননা, তার মতো করে কোমড় পানিতে নেমে সাধারণ মানুষের দুঃখ দূর্দশার খোঁজ আগে কেউ করেননি বলে জানান চলনবিলের বাসিন্দা হনুফা বেগম। এদিকে বগুড়ার নন্দিগ্রামের বাসিন্দা বন্ধু সালাম বলেন, আমাদের গ্রামটি বগুড়া জেলায় হলেও সিংড়ার বর্ডার এখানে। প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এখানেও সমান জনপ্রিয়। তার এ জনপ্রিয়তা মন্ত্রী হবার কারণে নয়, প্রতিমন্ত্রী হিসাবেতো সে সারাদেশের সব মানুষের জন্য কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে সে সাংসদ হবার আগেই ছাত্র জীবন থেকেই সকলের কাছে প্রিয়।
তবে ব্যতিক্রম জানা যায় সিংড়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব দাউদার মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীদের কাছে। তবে এরা ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষে কাজ করেছে বলে জানা যায়। উপজেলার বেশকিছু ইউনিয়ন সুকাশ, ডাহিয়া, ইটালী, কলম, চামারী, হাতিয়ান্দহ, লালোর, তাজপুর, চৌগ্রাম, ছাতারদীঘি ও রামানন্দ খাজুরা ঘুরে জানা যায়, এখানে আড়ালে আবডালে আইটি প্রতিমন্ত্রী পলককে ইন্টারেস্টিং প্রতিমন্ত্রীও বলা হয়। সবকাজেই এখানে তার জন্য একটা ইন্টারেস্টিং পার্সেন্টেজ রাখতে হয় বলেই নাকি কমিশন মন্ত্রী বলে উপাধি তার। এমন অভিযোগ যে ভিত্তিহীন শত্রুতা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
তবে সিংড়া পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কামরুল হাসান কামরান সহ আরো অনেকে প্রতিমন্ত্রী পলককের বিকল্প নেই বলে জানান। তারা বলেন, স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ এখানে প্রচন্ড শক্তিশালী এবং এটা মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের অবদান।
অন্যদিকে আইটি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বেও সফল এবং সমান জনপ্রিয় জুনাইদ আহমেদ পলক। আইসিটি সেক্রেটারি জিয়াউল আলম বলেন, প্রতিটি কাজে তিনি সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। আইটি সেক্টরে তার অবদানই তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য সন্তান ও তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দেখেছেন। বলা যায় তার পুরোটাই বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এর হাত দিয়ে।
অবশ্য এ বিষয়ে পলক বলেন, এটা সম্পূর্ণই সজীব ওয়াজেদ জয় এর উদারতা। তিনি আমাকে সুযোগ দিয়েছেন বলেই আমি কাজ করতে পারছি।