নির্বাচন মানেই কি টাকার খেলা? ভোট কেনাবেচার প্রতিযোগিতা? জাতীয় বা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে এ প্রশ্ন করলে প্রশ্নকারীকেই লোকে পাগল বলবে। কিন্তু সামান্য জেলা বা উপজেলার প্রেসক্লাব বা সাংবাদিক সংগঠনের নির্বাচনেও যদি টাকার খেলা চলে? তখন প্রশ্ন করলে কি অবস্থা হবে? অবশ্য তখন প্রশ্নকারীকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে তাড়িয়ে দেবে সকলে। বলবে প্রমাণ দেখাও! প্রমাণ দেখাতে না পারায় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় বিষয়টি। আর অসাংবাদিক বা হলুদ সাংবাদিকডা ক্রমশ ডালপালার বিস্তার ঘটায় সারাদেশে। কেননা, টাকার বিনিময়ে নির্বাচিত সাংবাদিক নেতার সহযোগী বা সহকর্মীরা কেমন সাংবাদিক হবেন? এদের কাছে বস্তুনিষ্ঠ সৎ সাংবাদিকতা কতটুকু আশা করা যাবে? এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখন। এমনকি চা দোকানী ও রিক্সাচালক পর্যন্ত অভিযোগ তুলে বলেন, বেশিরভাগ উকিল, পুলিশ আর সাংবাদিকের চরিত্র একরকম। এদের বিশ্বাস করা যায়না।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলা ও উপজেলার প্রেসক্লাবের নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ খুব কাছ থেকে দেখে হতবাক বিবেক।
গত ৬ সেপ্টেম্বর যশোর প্রেসক্লাব, ১ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর প্রেসক্লাবের নির্বাচন, ২৪ ডিসেম্বর বরিশাল আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রেসক্লাব এবং ২৫ ডিসেম্বর জয়পুরহাট প্রেসক্লাব সহ আরো বেশকিছু প্রেসক্লাবের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন সর্বত্র। নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই কোথাও। সবখানে চমৎকার উৎসবমুখর পরিবেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটা শতভাগ সত্য। তবে নির্বাচন পূর্ব প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ ও ব্যস্ততা প্রশ্নের জন্ম দেয় মনে।
একজন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবার সুবাদে বুঝতে পারলাম মাত্র ৭৪ ও ৮৭ সদস্যের একটি নির্বাচন কতটা ভয়ংকর হতে পারে। দিন নেই রাত নেই ছুটোছুটি ও উপঢৌকন বা নগদ টাকার বিতরণ ব্যবস্থা জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও হার মানালো এই জেলা উপজেলার প্রেসক্লাব নির্বাচন। সদস্যদের বেশিরভাগ অংশই কিন্তু সাংবাদিক। অর্থাৎ জাতির বিবেক তারা। কিছু লোক আছেন যারা অপেশাদার গণ্যমান্য নাগরিক।
জাতীয় সংসদ ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে টাকার খেলা প্রতিবেদন তৈরি এবং নিন্দা জানানোর দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিক যখন তার ঘরের নির্বাচনে টাকা দিয়ে ভোট কেনার প্রতিযোগিতায় নামেন তখন কিছু বলার ভাষা আদৌ থাকে কি?
যদিও এ অভিযোগ প্রমাণের কোনো উপায়ই নেই। তবে একদম যে নেই তা কিন্তু নয়। কোন্ প্রার্থী প্রেসক্লাবের কোন্ কোন্ সদস্যদের কাছে গেছেন। সেই সদস্যের পকেটে আগে কত টাকা ছিলো, আর প্রার্থী চলে আসার পর কত টাকা হয়েছে? একটু নজরদারি করলেই বের হয়ে আসবে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে এর একটি প্রেসক্লাবে মাথাপিছু সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকার লেনদেন হওয়ার গল্প শুধু সাংবাদিক নয়, চা দোকানেরও আলোচনার বিষয় হয়েছে বরিশালে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন অবশ্য সাবধান করে বলেছেন, প্রমাণ না থাকলে এ নিয়ে কথা বলা ঠিক হবেনা। ঢালাওভাবে এমন অভিযোগ আমার কানেও প্রায়শই আসে। কিন্তু প্রমাণ দিতেতো কেউই পারেনা। জেলা বা উপজেলার প্রেসক্লাবের নির্বাচন, সেখানের নির্বাচন কমিশনারের এক্তিয়ারে। তবে সাংবাদিকতার মাঠে এ জাতীয় অভিযোগ অবশ্যই নিন্দনীয়। এর প্রভাব পড়ে সৎ সাংবাদিকতার উপর।
গত ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বরিশাল প্রেসক্লাবের নির্বাচন নিয়েও সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি পদের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এমন ঢালাও অভিযোগ মাঠেঘাটে। এখানের নির্বাচনে সভাপতি পদে ৩ প্রতিদ্বন্দ্বী মানবেন্দ্র বটব্যাল, কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল ও মুরাদ আহমেদ সমান সংখ্যক ২৪ ভোট পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যোগ্যপ্রার্থী আজকের পরিবর্তন পত্রিকার সম্পাদক কাজী মিরাজ মাহমুদ দুইভোটে পরাজিত হয়েছেন। নির্বাচনে এসএম জাকির হোসেন ৩৭ ভোট পেয়ে সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী কাজী মিরাজ মাহমুদ ৩৫ ভোট পেয়েছেন।
এখানেও নির্বাচন কিন্তু সুষ্ঠু সুন্দর ও আনন্দঘন পরিবেশে হয়েছে। নির্বাচনে কোনো অনিয়ম অবশ্য কোনো প্রেসক্লাবেই কখনো হয়না। যেটা হয়, লোকচক্ষুর আড়ালে ভোট বেচাকেনা। যার প্রমাণ করা কঠিন।
বরিশালে সভাপতি পদে ৩ প্রতিদ্বন্দ্বীর সমসংখ্যক ভোট পাওয়ার বিষয়ে প্রেসক্লাব নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাইফুর রহমান মিরন বলেন, প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রে সভাপতি পদে দুইজন প্রার্থী সমসংখ্যক ভোট পেলে টর্চের মাধ্যমে চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারনের বিধান রয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী ৩ জন হলে পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে ফের ওই পদে ভোট গ্রহণের বিষয়টি গঠনতন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। নিয়মানুযায়ী পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে সভাপতি পদে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
এই নির্বাচনে প্রচুর টাকার বিনিময়ে ভোটকেনা বেচা হয়েছে। কিন্তু আমরা হয়তো তা কখনোই প্রমাণ করতে পারবোনা। কিন্তু প্রেসক্লাবের নির্বাচনে অংশ নেয়া বন্ধুরা? আপনার বিবেকতো আপনাকে সবসময় দোষী প্রমাণ করবে। আপনার জন্য নষ্ট হবে সৎ সাংবাদিকতা। জাতীয় বা ইউপি নির্বাচনে কিম্বা কোনো প্রশাসনিক দূর্নীতিতে আপনি কি করে প্রশ্ন তুলবেন? তিনটি আঙ্গুল আপনার দিকেই ইঙ্গিত করে বলবে- আগে নিজে ভালো হও তারপর….।