
নাই- এই একটি শব্দে আটকে আছে ঐতিহ্যের প্রতীক বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (শেবাচিম) এর সুচিকিৎসা। রোগী আছে। বেড আছে, নার্স আছে। ডাক্তার নাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নাই। পর্যাপ্ত বাথরুম, ওয়াশরুম নাই। পরিচ্ছন্ন কর্মী নাই, অত্যাধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি, – এক্সরে মেশিন, সিটিস্কান, রেডিওথেরাপি ইত্যাদি কিছুই নাই। তাহলে কীসের ভিত্তিতে সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা দেবেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ? এ প্রশ্ন সয়ং হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ সাইফুল ইসলামের।
আছে শুধু রোগীদের উপচে পরা ভিড় এই বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ( শেবাচিমে)। ভিড় সামলাতে বেড না থাকায় ফ্লোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা দিচ্ছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্স।
সরেজমিনে ১৩ ও ১৫ জানুয়ারী সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত অবস্থান করে শেবাচিম এর মেডিসিন ইউনিটসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা গেল ফ্লোরে বিছানা পাতা অসংখ্য রোগীর ছটফটানি দৃশ্য। মেডিসিন ইউনিট ৩ পুরুষ ওয়ার্ড ৭ এ নিজস্ব রোগী থাকার সুবাদে এ চিত্র চোখে পড়ে প্রতিবেদকের।
দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি মানুষের নির্ভরতা বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (শেবাচিম) এ প্রবেশ মাত্রই চোখে পড়ে ফাঁকা অনুসন্ধান কক্ষটি। অনেক খুঁজেও কাউকেই পাওয়া গেলনা তথ্য জানার জন্য। তবে ১৫ জানুয়ারী সকালে দুজনের দেখা পাওয়া গেলেও বেলা বারোটার আগেই উধাও তারা। রোগীর স্বজনকে ফোন করে চারতলার মেডিসিন ইউনিটে প্রবেশ মাত্রই দৃষ্টি কেড়েছে ফ্লোরের প্রায় পয়ত্রিশ / চল্লিশটি বিছানায় ছটফট করা রোগী ও তাদের স্বজনদের ডাক্তার ও নার্সের জন্য ছুটোছুটি । নার্স কক্ষে তখন দায়িত্বরত চারজন সেবিকা। প্রতি ওয়ার্ডে ১৫০ বেডসহ ২০০ এর বেশী রোগীর যত্নে চারজন নার্স কি পর্যাপ্ত?
১৯৬৮ সালে স্থাপিত এই হাসপাতালের দশ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউর সাথে ২০২০ সালে করোনা বিভাগ এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৮ টি আইসিউ শয্যা ও ১৫০ টি নতুন বেড নিয়ে। সবমিলিয়ে আইসিইউ এখন ২৮ টি এবং শয্যা সংখ্যা ১১৫০টি থাকার কথা। রাতে ডাক্তার কক্ষে অবস্থানরত চারজন ইন্টার্নি চিকিৎসক দেখছেন এই ১১৫০ বেড ছাড়াও ফ্লোরিং ও আইসিইউতে অবস্থান করা আরো প্রায় ৫০০ রোগীকে।
পর্যাপ্ত ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার অভিযোগ রোগীদের অনেকেরই। মহিলা ওয়ার্ডের অবস্থা আরো কঠিন। ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ায় চারতলার পশ্চিম দিকের সিঁড়ি রুমটিও এখন মহিলা রোগীদের দখলে। অহরহ পুরুষ স্বজনদের আনাগোনা। প্রাইভেসি নেই কোনো। একদল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের প্রভাব দেখা গেল সর্বত্র। রোগীদের সাথে এদের সম্পর্ক যেন শুধু টাকার। টাকা না দিলে কোনো সেবা দিতে রাজী নয় এরা। ব্যবহারতো পারলে ঘাড় ধরে বের করে দেয় রোগীদের। এদের একজন শহীদুলতো। ছবি তোলার অপরাধে সেতো প্রতিবেদকের উপরই চোটপাট দেখালো। পরে অবশ্য অনুযোগের স্বরে বলল, আমরা হাতেগোনা কয়েকজন কোনদিকে সামলাবো বলুন। জানাগেল, হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন কর্মীরাই আবার সামলাচ্ছে নিরাপত্তার দিক।
আবার এখানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে যেসব পরীক্ষানিরীক্ষা লেখা হয়, তার বেশিরভাগই হয়না শেবাচিমে। পপুলার, অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিকে করিয়ে আনার পরামর্শ সয়ং ডাক্তারদেরই। সিটিস্কান, এ্যানড্রোসকপি কিম্বা এক্সরে মেশিন নষ্ট বলে দাবী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের। তাদের কারো কারো সুপারিশ আশেপাশের ছোটো-ছোটো ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।
এদিকে রোগীর স্বজনদের অনেকে জানালেন, দুই সপ্তাহ আগে করানো সিটিস্কান, এ্যানড্রোসকপি ও এক্সরে নাকি এখন চলবেনা। নতুন করে আবার করাতে হবে। এতে কতগুলো টাকার ঢাক্কা বলুনতো। তাও আবার রোগী নিয়ে যেতে হবে কতদূরে? রোগীদের অনেকেরইতো সেই সক্ষমতা নেই। তাহলে সরকারি হাসপাতালে এসে কি লাভ আমাদের?
অন্যদিকে এখানকার ঔষধের দোকানগুলোতে চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা। অপ্রয়োজনীয় ঔষধ ফেরত নেয়না তারা। এ নিয়ে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি, এমনকি রোগীর স্বজনদের সাথে হাতাহাতি ঘটে হাসপালের সামনে জানালেন সয়ং নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন।
রোগীর স্বজনদের দাবী, একটা মহল কৌশলে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সুনাম ক্ষুন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এরা রোগীদের পপুলার, এ্যাপোলো ও বেল ভিউসহ প্রাইভেট হাসপাতালে রেফার করার কৌশলী চেষ্টা করছে। এরাই হয়তো সুবিধা নিয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি। বেশিরভাগ পরীক্ষাগুলো তাই বাইরে করার পরামর্শ দিচ্ছে।
অথচ শেবাচিম সবদিক থেকে সয়ংসম্পূর্ণ ছিলো- এ দাবী সয়ং হাসপাতালের পরিচালক ডাক্তার এইচ এম সাইফুল ইসলামের।

তিনি বলেন, এটা এশিয়ার গর্বিত একটি প্রতিষ্ঠান। পুরাতন ঐতিহ্য। যেকারণে প্রধান ভবনটির সংস্কার জরুরী। সিঁড়ি, ওয়াশরুম, লিফটসহ ভবনের অনেকস্থানে পলেস্তারা খসে পরছে। ১১৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও এখনো আমাদের লোকবলসহ মন্ত্রণালয়ের সাপোর্ট সব ৫০০ শয্যার আদলে দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সংকটের কারণে কলেজের শিক্ষা পর্যন্ত বিঘ্নিত হচ্ছে।
পরিচালক আরো বলেন, প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ ত্রিশ হাজার রোগীর আনাগোনা এই হাসপাতালে। এখানে চিকিৎসার অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সেগুলো মেরামতের উদ্যোগ নিতে গিয়ে দেখি, মেরামতের খরচ যা, তার তুলনায় নতুন কেনাই উত্তম হবে।