কণ্ঠশীলন প্রযোজিত নতুন মঞ্চনাটক ‘যাদুর লাটিম’র উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়ে গেল গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। নোবেল বিজয়ী মিসরীয় ঔপন্যাসিক নাগিব মাহফুজের ‘অ্যারাবিয়ান নাইট্স অ্যান্ড ডে’জ’ অবলম্বনে নাটকটির নাট্যরূপ দিয়েছেন রাফিক হারিরি। নির্দেশনায় ছিলেন কণ্ঠশীলন অধ্যক্ষ মীর বরকত।
‘যাদুর লাটিম’ এক কল্পিত শহরের ইফরিদ–কুফরিদ নামের দুষ্টু জিনের গল্প। এটি দুষ্টু জিনের গল্প হলেও নাগরিক বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। মানুষের শিরায়–উপশিরায় ঘুরে বেড়ানো ইফরিদ আর কুফরিদ মানুষের মনের মধ্যে সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বিষ ঢুকিয়ে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নগরজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে থাকে। জিনের ভেলকিবাজিতে একে একে খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার, রাহাজানি, প্রতিহিংসা দিন দিন বেড়ে যায়। যেন বর্তমান সময়েরই প্রতিচ্ছবি।
অলৌকিকতার আদলে নির্মিত প্রায় দেড় ঘণ্টার নাটকটি দর্শককে সত্যিকারার্থে আকৃষ্ট করেছে। জাদুময় আবহে দৃশ্যের পর দৃশ্য চলে গেছে চোখের সামনে দিয়ে। কখনো কখনো দর্শককে শিহরিত করেছে। কখনো প্রেমরসে আকুল করেছে। কখনো বা বীভৎসতায় ভীত করেছে। তবুও শেষ হতেই যেন মনে হলো– আহা! শেষ হয়ে গেল? মঞ্চনাটকের এমন জাদুময়তাই নাটকটিকে বিশিষ্টতা দান করেছে। যাদুর লাটিম সেটিই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
নাটকের অভিনেতা–অভিনেত্রীদের পরিবেশনার কথা আলাদা করে বলার কিছু নেই। বলতে গেলে প্রত্যেকেই চমৎকার অভিনয় করেছেন। দর্শকের চোখকে তীরের মতো বিদ্ধ করে রেখেছেন। এক তন্ময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন। তারপরও দু’একটি দৃশ্যে চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা আড়ষ্টতাও লক্ষ্য করা যায়। তবে দুই/একটি চরিত্রের এমন ছন্দপতন খুব বেশি দৃষ্টিকটু বলে মনে হয় না।
কাহিনি বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্য–সংগীত সহযোগ নাটকটিকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। গানের সঙ্গে নাট্যশিল্পীদের নৃত্যশৈলী আলাদা আবহ তৈরি করতে পেরেছে। আমার মতো সব দর্শককেই আনন্দ দিতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করি।
আঙ্গিকের ক্ষেত্রে সংলাপ এবং চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে খুবই পরিশ্রমী ছিলেন নাট্যকর্মীরা। কাহিনি বা চরিত্র বিশ্লেষণ করে সময়োপযোগী পোশাক পরিকল্পনা সত্যিই প্রশংসনীয়। সংলাপে সিরিয়াস কথাকেও হাস্যরসাত্মক করে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিল্পগুণের শিল্পীত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন প্রত্যেক অভিনেতা এবং সংলাপ রচয়িতা।
সেট ডিজাইনের ব্যাপারে খুব বেশি আড়ম্বরতার পরিচয় না দিয়েও মাত্র একটি আদলে পুরো পরিবেশকে তুলে ধরেছেন সেট ডিজাইনার। এ জন্য তাকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়। আলো প্রক্ষেপণে বিশেষ কোন ত্রুটি না থাকলেও মাঝে মাঝে দু’একজন অভিনেতাকে উপেক্ষা করেছে আলো। এটা আলোর সঙ্গে অভিনেতার সামান্য সমন্বয়হীনতার কারণেই হয়েছে বলে আমার মনে হয়। দু’এক জায়গায় সংলাপ প্রক্ষেপণে শব্দযন্ত্রের আংশিক ত্রুটি বা অভিনেতার ক্ষীণ কণ্ঠ দর্শকের শ্রবণেন্দ্রিয়কে পাশ কাটিয়ে গেছে।
তবুও প্রথম মঞ্চায়ন হিসেবে অতোটা ত্রুটিযুক্ত বলা যাবে না কখনোই। সব মিলিয়ে সার্থক একটি পরিবেশনা উপভোগ করেছে দর্শক। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে– মঞ্চনাটকের জন্য হাউসফুল শো একটি বিশাল ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে কণ্ঠশীলন সার্থক আয়োজনের দাবিদার। এ প্রদর্শনীর কল্যাণে আমরা আশায় বুক বাঁধতেই পারি যে, মঞ্চনাটকের সুদিন ফিরে এসেছে।
নাটকটির মঞ্চসজ্জা, পোশাক ও আলোক পরিকল্পনার জন্য ফয়েজ জহিরকে ধন্যবাদ জানাই। মনকাড়া সংগীত পরিকল্পনা ও সুর সংযোজনের জন্য শিশির রহমান, দৃষ্টিনন্দন কোরিওগ্রাফির জন্য আমিনুল আশরাফকেও ধন্যবাদ জানাই। গান দুটির জন্য রাফিক হারিরি ও মীর বরকতের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো।
সবশেষে বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করা রইস উল ইসলাম, মোস্তফা কামাল, একেএম শহীদুল্লাহ কায়সার, সোহেল রানা, সালাম খোকন, অনন্যা গোস্বামী, জেএম মারুফ সিদ্দিকী, নিবিড় রহমান, নাশাত আনান চৌধুরী বিন্তু, আফরিন খান, অনুপমা আলম, নিলুফা মিম, রাহনুমা ইসলাম রাখী, মো. আব্দুল কাইয়ুম, রুবেল মজুমদার, মো. ওয়ালিউল ইসলাম সাকিব, নিশরাত জেবিন নিশি, শেখ সাজ্জাদুর রহমান ও ফাহিম আবরারকে অভিনন্দন চমৎকার পরিবেশনার জন্য।
সবার জন্য শুভকামনা। কণ্ঠশীলনের সুদূর প্রসারী পথচলা অব্যাহত থাকুক। মঞ্চনাটকের ইতিহাসে ‘যাদুর লাটিম’ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকুক। আবারও নাটকটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শুভকামনা রইলো।