আনন্দ শোভাযাত্রায় আনন্দিত বরিশাল: গ্রামের বাজারে চলছে হালখাতা উৎসব

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি

Sharing is caring!

আনন্দ শোভাযাত্রায় আনন্দিত বরিশাল: গ্রামের বাজারে চলছে হালখাতা উৎসব 
বিশেষ প্রতিবেদক 
“বৈশাখী ঐক্যতান
ফ্যাসিবাদের অবসান ” শ্লোগানকে সামনে রেখে হাতি ঘোড়া, গাধা ছাড়াও জেলে, চাষী, কৃষাণী জীবন গাঁথার পাশাপাশি ঢেঁকি, পালকী সহ লোকজ উপকরণ তুলে ধরার চেষ্টা ছিলো এবারের বৈশাখী শোভাযাত্রার  প্রধান আকর্ষণ। আবার নগরীর হাটখোলাসহ গ্রামের বাজারের মুদি দোকানগুলোতে ছিলো হালখাতা খুলে মিষ্টি বিতরণের আয়োজন। পহেলা বৈশাখ সোমবার সকাল ৯টায় বরিশাল সার্কিট হাউসের সামনে থেকে লোকজ উপকরণ সহ বৈশাখী শোভাযাত্রাটি বের হয়ে সদর রোড হয়ে বিবির পুকুর পাড় থেকে একে স্কুল রোড ধরে বাঁধ রোড হয়ে বরিশাল ক্লাবের সামনে দিয়ে পুনরায় সার্কিট হাউসের ভিতর এসে শেষ হয় শোভাযাত্রাটি। প্রায় দেড়ঘন্টা সড়কে এই শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন। তিনি রীতিমতো জেলে সাজে নিজেই সড়কে জাল নিক্ষেপ করে অংশগ্রহণকারী ও দর্শকদের বিনোদন দিচ্ছিলেন। পালকী চড়া বউকে বাতাস করা, হল্লা গাওয়া ইত্যাদি আয়োজনের পাশাপাশি ঢেঁকি, পলকী, ডাল তৈরির যন্ত্র ইত্যাদি দেখে মুগ্ধ বরিশাল বাসী। তাদের অনেকেই বললেন, এবারের এই বৈশাখী শোভাযাত্রায় আমরা সত্যিকারের আনন্দ পেলাম। বরিশাল সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের যৌথ আয়োজনে এমন উৎসব সম্ভবত এটাই প্রথম বলে দাবী করলেন আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব খান। তিনি বলেন, বৈশাখী শোভাযাত্রা মানেই আনন্দের বিষয়। এ নিয়ে যারা মঙ্গল অমঙ্গল বিতর্ক করছে তাদের বলবো, মঙ্গল অমঙ্গল আপনার আমার কর্মফলের উপর নির্ভর। কোনো শোভাযাত্রা দিয়ে মঙ্গল হয়না, হয় আনন্দ হয়। আমরা বরিশালের মানুষ দীর্ঘদিন পর নির্মল আনন্দ পেয়েছি। তাই আনন্দ শোভাযাত্রা  নামকরণ সঠিক বলে দাবী করেন মাহবুব খান।
একইসময় বরিশাল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অন্যতম পরিচালক সাংবাদিক আজাদ আলাউদ্দিন বললেন, নতুন বাংলা বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আগে আমরা বলতাম – পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনেরে করি বরণ। এটা একটি ভুল ধারণা। পুরাতন আমাদের পাথেয়, আমাদের পথ নির্দশক। তাকে বিদায় দেওয়া যায়না। তার থেকে শিক্ষা নিয়ে ভুল ত্রুটি শুধরে নতুন পথে পা বাড়াতে হয়। আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ তৈরি হবে আমাদের অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিতে পারলেই।
জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাস বরিশাল দক্ষিণের আহ্বায়ক সাব্বির নেওয়াজ সাগর ধানের শীষ, কাস্তে ইত্যাদি উপকরণ নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আমারা চেষ্টা করেছি দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বরিশালবাসীকে আনন্দ দিতে। কিছু বাম ঘরানার প্রগতিশীল চিন্তার দাবীদার বাদে সবাই আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। নগরবাসী আনন্দ পেয়েছে এটাই এই আনন্দ শোভাযাত্রার সার্থকতা। এজন্য অবশ্যই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন এর প্রতি। একইসাথে ধন্যবাদ জানাবো বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওছারকেও। তাদের আন্তরিকতা এবং স্বশরীরে উপস্থিতি এই আনন্দ শোভাযাত্রাকে গতিশীল করেছে বলে জানান সাব্বির নেওয়াজ।
নগর প্রদক্ষিণ শেষে সার্কিট হাউসের আঙ্গিনায় তৈরি অস্থায়ী মঞ্চের সামনে জড়ো হন সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সেখানে বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে দুপুর পর্যন্ত। হয়তো আরো চলতো কিন্তু আচমকা বৈশাখী বৃষ্টি এসে সবাইকে বৈশাখী ভালোবাসায় ভিজিয়ে দিয়ে যায়। ফলে সার্কিট হাউস কেন্দ্রীক বৈশাখী উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। বিকালে বেলস পার্কে বৈশাখী মেলা এবং শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে পৃথক পৃথক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিলো বিভিন্ন সংগঠনের।
বরিশালের জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসেন বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। আমরা চেয়েছি দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেনী পেশার মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রচারণাও চালানো হয়েছে। লোকজ উপকরণ সংগ্রহ করতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পরিশেষে এই আনন্দ শোভাযাত্রায় বরিশালবাসী আনন্দ পেয়েছেন এটাই আমাদের সার্থকতা বলে জানান জেলা প্রশাসক।
এ বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওছার বলেন, বৈশাখী শোভাযাত্রা বা উৎসব কখনোই হাজারো বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতি নয়। এটি সম্রাট আকবরের সময়ে (১৬০০ সালে) হালখাতা উৎসব থেকে তৈরি। আর ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রা নামে এই শোভাযাত্রার সংস্কৃতি চালু হয়। হালখাতা উৎসব নিয়ে সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচশত বছরের ঐতিহ্য হতে পারে। এই উৎসব মানুষের মনে আনন্দ সৃষ্টির জন্য তৈরি হয়েছে। তাই আনন্দ শোভাযাত্রা নামকরণ সঠিক বলে জানান তিনি।
এদিকে বরিশাল নগরীর হাটখোলার বেশকিছু বড় ব্যবসায়ী ও আড়ৎদার তাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকমের মিষ্টি, ঘোলের শরবত দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন। তারা তাদের বাঁধাই করা হালখাতার বই খুলে কারো থেকে ৫০০, কারো থেকে হাজার টাকা বাকী আদায় করে তা নতুন খাতায় লিপিবদ্ধ করছেন। আবার কারো নাম একদম কেটে দিচ্ছেন। জয় ভাণ্ডার ও বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়ের ব্যবসায়ী জানালেন, এই হালখাতা উৎসবই বাঙালী সংস্কৃতির অংশ এখন। বাৎসরিক হিসাব নিকাষ চূড়ান্ত করে আগামী বছরের জন্য নতুন খাতা খোলা হয় এই বৈশাখে। পুরো মাস জুড়ে চলে আমাদের এই কার্যক্রম। আগে মিষ্টি ছাড়াও সন্দেশ, দানাদার, বাতাসা ইত্যাদি মিষ্টান্ন রাখা হতো। কারণ এলাকার ছোট ছোট কিশোর তরুণরা এসে ভিড় করতো। এখন আর তা হয়না বলে জানান বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়ের আলমগীর হোসেন।
এদিকে  বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার হলতা বাজার এবং বাহেরচর বাজারের অনেক ব্যবসায়ী এসেছেন হাটখোলার এই হালখাতা উৎসবে অংশ নিতে। তারা জানালেন, তাদের গ্রামের বাজারগুলোতেও একইভাবে হালখাতা উৎসব হচ্ছে। তবে তাদের কেউ কেউ শুধু জিলাপি দিয়ে গ্রাহকদের আপ্যায়ন করছেন। দানাদার, বাতাসা এখন আর পাওয়া যায় না বলে জানান তারা।
Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!