ময়মনসিংহের কবি ও কবিতা : নজরুল হায়াত

অতিথি লেখক

Sharing is caring!

ময়মনসিংহের কবি ও কবিতা

নজরুল হায়াত

ok pic

ময়মনসিংহের কোরায়শী প্রাঙ্গনের কবি ইয়াজদানী কোরায়শীসহ সাহিত্য বাজার উৎসব কমিটি।

ময়মনসিংহের সাহিত্যে কবি শিরোনামটি খুবই গোলমেলে। ময়মনসিংহের কবি কারা? এই মুহূর্তে ছ’টুকরোর এক টুকরো ময়মনসিংহে জন্ম নিয়েছেন যে সব কবি তাঁরা? না কি ‘জন্ম হোক যথাতথা ….’

যারা এখন স্থায়ী কিংবা অস্থায়ীভাবে ময়মনসিংহে বসবাস করছেন সে সব কবি? না কি বিভক্তি পূর্ব ময়মনসিংহে জন্ম নিয়েছেন যারা, তারা?

বলার অপো রাখে না প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ময়মনসিংহকে শুধু ছ’টুকরোই করেনি, ময়মনসিংহের কবিদেরও কেটে ছ’ভাগে ভাগ করেছে। ফলে একসময় যারা ময়মনসিংহের বাসিন্দা বলে গর্ববোধ করতেন, এর যে কোনো অঞ্চলের মানুষের সৃজনকর্মের সাফল্যে আবেগ মথিত হতেন, এখন সেখানে তারা ভূগোলখণ্ডের টুকরায়নের সাথে সাথে আত্মপরিচয়ের ক্ষুদ্রায়নের শিকার হয়েছেন। ফলে তাদের সম্মিলিত আনন্দের, গর্বের আর অহংকারের জায়গাটি ধূলিসাৎ হয়ে সেখানে এক ভয়ংকর রক্তরণের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের পে আর সম্ভব হচ্ছে না একই সূতোয় গাঁথা ফুল-মালার নিবিড় ঐক্যের অনুভূতিতে প্লাবিত হওয়া। বরং যেন এক ক্রমাগত বিচ্ছেদের বেদনাভার তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। ফলে একসময়ের ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ খ্যাত আদিম সর্বপ্রাণবাদীয় মটিফ সমৃদ্ধ লোক-পালাগুলোতে ফুটে ওঠা ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল বলে পরিচিত নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চলের লোক-জীবনের সহজ-সরল, গাঢ়-গভীর জীবন চিত্র, আবেগ বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও শিল্প সম্ভারের জন্য অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দারা আর গৌরবে ভরে উঠতে পারছেন না। পারছেন না ঐ সব সমৃদ্ধ সাহিত্যকে নিজেদের সাহিত্য বলে পরিচয় দিতে। অথচ এখনো অনেকেই জন্মগত বাসিন্দা না হয়েও নিজেদের ময়মনসিংহের কবি-লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। তাঁদের অনেকের সাথে ময়মনসিংহের এখনো নিবিড় যোগাযোগ। সামান্য সুযোগ পেলেই, একটুখানি ডাক পেলেই তাঁরা খুবই দ্রুততায় ছুটে আসেন ময়মনসিংহে।

index

সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক যতীন সরকার

তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একমাত্র লোকসাহিত্যের সমৃদ্ধ অঙ্গনটি বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে বর্তমান ময়মনসিংহের অবদান খুবই সামান্য। বর্তমান ময়মনসিংহের একমাত্র প্রাচীন কবি কানা হরিদত্ত। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, তাঁর সময়কাল দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক। জন্মস্থান নান্দাইলের সিংরৈল গ্রাম। রচিত গ্রন্থ ‘মনসা দেবীর গীত’। ‘ময়মনসিংহ গীতিকার’ কোন কবির সাক্ষাৎ বর্তমান ময়মনসিংহে পাওয়া যায় না। না গেলেও ময়মনসিংহ এলাকায় এক জাতীয় কবির সাক্ষাৎ পাওয়া যায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই এক ধরনের ছোট ছোট মৌখিক বা বাচন কবিতা লিখে এ এলাকায় গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারগুলোতে নেচে নেচে, গেয়ে গেয়ে শুনিয়ে আসছেন। এঁরা লোক কবিরই অন্তর্ভুক্ত। বিশিষ্ট সমালোচক যতীন সরকার তাঁর ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্য দর্শন’ গ্রন্থে ইউনুস আলী নামের এরকম একজন কবির প্রসঙ্গ উল্লেখ্য করে তাঁর অসাম্প্রাদায়িক চেতনা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছেন। এসব কবিদের কবিতার পাঠক, শ্রোতা ও রসপিপাসু হচ্ছেন গ্রামের অজ্ঞ, অশিতি, সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। এ জাতীয় কবিতার বিষয়বস্তু, শব্দ, ছন্দ ও উপমা, অলংকার প্রায় একই রকমের। প্রধানত প্রেম কিংবা গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা এসব কবিতার প্রধান অবলম্বন। হয়তোবা ‘ময়মনসিংহ গীতিকার’ মতো কোনো লোককাব্য এ এলাকায়ও লেখা হয়ে থাকবে, উপযুক্ত সংরণের অভাবে সেগুলো হারিয়ে গেছে অথবা এখনো তা আবিস্কৃতই হয়নি। তবে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এলাকার দু’জন বাউল সাধক জালালুদ্দিন খাঁ ও সিরাজউদ্দিন কাশিমপুরীর সাথে ময়মনসিংহের যোগাযোগ বেশ নিবিড় ছিলো।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটালে তার প্রভাব ময়মনসিংহেও এসে পৌঁছায়। এ এলাকার কিছু কিছু কবি তখন এ ধারায় কাব্যচর্চা শুরু করেন। এঁদের রচনার স্টাইল আধুনিক আঙ্গিকের হলেও কাব্য শিল্প রসোত্তীর্ণতার দাবী রাখে না। এসব কবিদের মধ্যে গোপেশচন্দ্র দও, মনোমোহন সেন, পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য, অজিত কুমার নিয়োগী প্রমূখের নাম উল্লেখ করা যায়। অন্য জেলার কিছু কবিও এ সময় ময়মনসিংহে কাব্যচর্চা করেছেন। এঁদের মধ্যে রজনীনাথ চট্টোপাধ্যায়, দীনেশ চরণ বসু, নবীন চন্দ্র সেন, আনন্দমোহন মিত্র, সুকুমার রায়, খলিলুর রহমান, অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, অন্নদা শঙ্কর রায়, কাজী কাদের নওয়াজ, রওশন ইজদানী প্রমূখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। প্রধানত চাকুরী উপলইে এঁরা তখন ময়মনসিংহে অবস্থান করেছেন। এঁদের কেউ কেউ বাংলা সাহিত্যে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী।

ময়মনসিংহে ত্রিশোত্তর কাব্যচর্চার সূত্রপাত প্রায় হাল আমলে। যদিও প্রথম মহাযুদ্ধের ধংসযজ্ঞজাত অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মতো ময়মনসিংহের জনজীবনেও আঘাত হানে, তবু এখানকার কবিরা সে ঢেউয়ে বিধ্বস্ত হতে একটু সময় নেন। অথচ বাংলা কবিতায় তখন প্রচণ্ড নাস্তি, হতাশা ও গ্লানি ভিড় করেছে। কবিদের চোখের সামনে ইউরোপীয় রেঁনেসা ও শিল্পবিপ্লব সৃষ্ট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিবর থেকে বেরোনো শেলী, কীটস, বায়রণ, ওয়ার্ডস ওয়ার্থের রোমান্টিক সৌন্দর্যের জগৎ ভাঙ্গতে শুরু করেছে। ফলে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবন থেকে তাদের পূর্বসূরি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ ও চিবায়ত মূল্যবোধ ধ্বসে গিয়ে সেখানে এক নি:সীম শূন্যতার গহ্বর ভেসে উঠেছে। স্বভাবতই কবিরা দাঁড়িয়েছেন এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এরই ঘূর্ণাবর্তে বাংলা কবিতার আকার ও প্রকরণ, ভাব ও বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ ও উপমা-অলংকার পাল্টে যেতে শুরু করে। জন্ম নেয় নানা তত্ত্বের, নানা মাত্রার। রিয়ালিজম, স্যুররিয়ালিজম অধিবাদ, অস্তিত্ববাদ। পলায়নী মনোবৃত্তি কাব্যজগতকে আক্রান্ত করে। আমাদের কবিরা ভীষণভাবে আলোড়িত হন এসব চেতনায়। অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁদের গুরু হয়ে উঠেন বোদলেয়ার আর ধিংঃব ষধহফ এর কবি টি.এস.এলিয়ট। এঁদের প্রভাবে কেউ হন ঘোর নন্দনতাত্ত্বিক, কেউ নিখিল নাস্তির অনুসারী, আবার কেউবা পরাক্সমুখ জীবনের দীর্ণ চেহারা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে আত্মকুন্ডয়নে মগ্ন হন।

পাশাপাশি বাংলা কবিতায় সংগ্রাম, আশাবাদ, জীবন চেতনা, বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আশ্রিত স্বতন্ত্র ধারার একদল কবির ও আবির্ভাব ঘটে এসময়ে। এঁদের গুরু কালমার্কস ও লেনিন। ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া রাশিয়ার সমাজ বিপ্লব তথা শ্রমিকশ্রেণীর মতারোহন এঁদের অন্যরকম সাহিত্য রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। তাঁরা পুরাতন সামন্ততন্ত্রী, আধা পুঁজিতন্ত্রী শাসন ও অর্থব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে সাম্যবাদী ও সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর হন। এঁরা সাহিত্যকে নিছক নন্দনতত্ত্বের অথবা হতাশা ও গ্লানির আখড়া না বানিয়ে শোষণ, অত্যাচার ও নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে চান।

ময়মনসিংহে এ প্রোপটে পৌঁছাবার আগে আমরা কিছু কিছু কবির সাক্ষাৎ পাই, যাঁরা বাংলা সাহিত্যের বিলীয়মান লোক কবিতার ধারারই উত্তরাধিকার বহন করছিলেন। এঁদের রচনায় একই সাথে পুরোনো লোকসাহিত্যের আঙ্গিক ও বিষয়-বৈশিষ্ট্য আবার জসীমউদ্দীনের পল্লী জীবনকেন্দ্রীক আধুনিক গীতি কবিতার মিশেল ল্য করা যায়। এ ধারার কবিদের মধ্যে সৈয়দ নুরুল আমীন এবং আব্দুল হাই মাশরেকীর নাম উল্লেখ করা য়ায়। সৈয়দ নুরুল আমীনের কবিতায় লোকসাহিত্যের ধারাটিই প্রবল। তাঁর রাখাল বন্ধু, ময়মনসিংহ জারির পালা, ঝরনা, ভাণুমতি ও নদের চাঁদ গ্রন্থসমূহ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একই ধারায় তিনি ঘাটু, ভাটিয়ালি, জারি-সারি ইত্যাদি নানা ধরনের গান ও রচনা করেছেন। তাঁর কিছু ব্যঙ্গকবিতাও ল্য করা য়ায়। এ সময়ের আরেকজন বিশিষ্ট কবি আব্দুল হাই মাশরেকী। লোকজ ঐতিহ্য, গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির স্বচ্ছন্দ ব্যবহার করে তিনি তাঁর কবিতায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। প্রথমদিকে তিনি ও জসীমউদ্দীন, বন্দে আলী মিয়াদের উত্তরাধিকার বহন করেছেন। পরে তাঁর কবিতায় চল্লিশ দশকীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং পাকিস্তান পন্থাও ল্য করা যায়। শেষপর্যন্ত তিনি সে জায়গা থেকে সরে আসেন এবং মানবিক ও ঐতিহাসিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন। এমনকি মৃত্যুর একেবারে আগে আগে তাঁর মধ্যে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দানা বেঁধে উঠেছিলো। পাশাপাশি ময়মনসিংহের কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ত্রিশোত্তর কাব্যাঙ্গিক ব্যবহার করেন। নিচের উদ্ধৃতিগুলো তারই প্রমাণ বহন করছে।

১. ইতিহাস চেতনা:

গুহা-মানুষের সাংকেতিক ধ্বনি-তরঙ্গের সীমা

আজো বয়ে নিয়ে আসে যোগসূত্র এক কবিতার

দূর পূর্ব পুরুষের …

(ভাষা একটি কবিতা)

২. ত্রিশোত্তর কাব্যাঙ্গিক ও জাতীয় চেতনা:

খণ্ড কবিতায় মুখ খোলে বোদলেয়ারের

নীড়ি টেপে। হাড় গুনে দ্য ভিঞ্চির চোয়ালের

উন্মনা শিল্পীর মতো উস্কু চুলে শাম্পু মেখে…

পশ্চিমের গোর থেকে এই সব অপচ্ছায়া

আসে চুপি, কথা বলে বাঁধানো কঠিন দাঁতে

(উটপাখি কবুতর)

 

এ সময় আরও যে ক’জন কবি ময়মনসিংহে কাব্যচর্চা করেন তাঁদের মধ্যে গোলাম সামদানী কোরায়শী ও আশুতোষ পালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। গোলাম সামদানী কোরায়শী মূলত গবেষক, গদ্যলেখক। অনুবাদে তিনি সৃষ্টিশীলতার স্বার রেখেছেন পাশাপাশি তিনি সামান্য কবিতা চর্চাও করেছেন। এর মধ্যে তাঁর মানুষ কবিতাটি সুধীমহলের দৃষ্টি কাড়ে। আশুতোষ পাল সত্যিকার অর্থেই এ সময়ের একজন শক্তিমান কবি। প্রধানত তিনি সনেটকার হিসেবেই পরিচিত। বিচিত্র বিষয়াবলম্বী তাঁর সনেট সমূহে শব্দ ও ছন্দ ব্যবহারে খুবই কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষত শব্দের ওপর তার দখল ঈর্ষণীয়। প্রকৃতি, প্রেম, মানবিকবোধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবই তিনি তাঁর সনেটের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে সনেট যেহেতু সীমাবদ্ধ আঙ্গিকের কবিতা, কবির স্বাধীনতা সেখানে অনেকাংশেই খর্ব। কবির পওে তাই সনেটে আধুনিক বোধের ব্যবহার খুবই কঠিন। আশুতোষ পালও সেটা পারেননি বিধায় তিনি ত্রিশোত্তর কবিতার প্রবল ঢেউয়ের অংশীদার না হয়ে মাইকেল, রবীন্দ্র যুগের কবি হয়েই থেকেছেন। তবে তাঁর সনেট রচনায় শক্তিমত্তার বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই।

যথার্থ অর্থেই ময়মনসিংহে ত্রিশ দশকীয় কবিতাঙ্গিক ও কাব্য বিষয়ের প্রথম রূপকার মুশাররাফ করিম। এর আগে যদিও আব্দুল হাই মাশরেকীয় মধ্যে ত্রিশোত্তর কবিতার ঢংটি ফুটে উঠেছে, তবু তিনি সত্যিকার অর্থে ত্রিশোত্তর বৈশিষ্ট্যের সামগ্রিকতার কবি হয়ে উঠতে পারেন নি। ত্রিশোত্তর কবিতাতো শুধু গদ্য ছন্দের কবিতা মাত্র নয়, যুদ্ধ ও রুশবিপ্লব জনচিত্তে যে জটিল আবর্তের সৃষ্টি করেছে তার ও যথার্থ প্রকাশ। যুদ্ধ মানুষকে যে বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে তা তার হৃদয় ও চোখকে পাল্টে দেয়। ফলে সে হারায় তার যাবতীয় সরলতা। উৎকেন্দ্রীকতা, দিপ্তী ত্রিপাঠীর ভাষায় অনিকেত মানসিকতা তার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠে। ফলে কবিতার পংক্তি আর পংক্তি মাত্র থাকে না, হয়ে উঠে ঊর্ণনাভের ঘুর্ণিজাল। কবিতা হয়ে উঠে অনেকাংশেই দুর্বোধ্য, দূরুহ এবং সেন্সের প্রকাশ মাত্র। কবি এবং পাঠক উভয়ের ক্ষেত্রেই তা মেধা, মনন ও পরিশ্রমের বিষয় হয়ে উঠে। বিশেষত উপমা, প্রতীক, অলংকারের ব্যবহার এবং চিত্রকল্প সৃজনের চিরকালীন ও চলমান মাত্রাটি নতুন হয়ে উঠে। ফলে কবিতা একটি নতুন অবয়ব ও চারিত্র্যে প্রকাশ পায়।

যেমন – জীবনানন্দ দাশের- ‘শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,’ ফরিদ আহমদ দুলালের- নদীর ওপার থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ভোর আসে, সাব্বির রেজার- মোল্লা বাড়ির ষাঁড়ের মতো একা একাই লড়ে যাবো’। এসব পংক্তিতে বা অংকিত চিত্রের অর্থভিন্নতাটি লণীয়। নারীর মুখ, সৌন্দর্য এবং চুলের কৃষ্ণতায় উপমাগুলো একেবারেই নতুন। মুশাররাফ করিমের মধ্যেই এসব প্রবণতা প্রথম প্রকাশ প্রায় বলেই ময়মনসিংহে তিনিই প্রথম ত্রিশোত্তর ধারার কবি। ষাটের দশকের শেষদিকে তার যাত্রারম্ভ।“নোনা পানির অমৃত স্বাদ” দিয়ে শুরু, তার সবশেষ কাব্য ‘সকল বাড়ি তোমার জন্য আকুল’। এখনো লিখছেন তিনি অবিরাম।

Kobi-boron-mymensingh-2

কবি ও গল্পকার মুশাররাফ করিম

সত্তর দশকে সমকালীন আধুনিক কবতায় একদল শক্তিমান ঘোড়া বেরিয়ে আসে ময়মনসিংহে, আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের লিটলম্যাগ ও মুশাররাফ করিমের ‘তিলোত্তমা’ ‘মহুয়া’, শফিকুল ইসলাম সেলিমের ‘কবিতা’, সুধাংশু সরকারের ‘উত্তরীয়’, মোয়াজ্জেম হোসেন আজাদেব ‘শুভ্রশিখা,’ সালিম হাসানের ‘সম্মোহনী’, এসব লিটলম্যাগের হাত ধরে। কাব্যকলায় এঁরা কেউই ঢাকার কবিদের থেকে পিছপা ছিলেন না। এসব কবিরা হচ্ছেন – নজরুল হায়াত, শামসুল ফয়েজ, নুরুল ইসলাম মানিক, আহমেদ ফখরুদ্দিন, রইস মনরম, মান্নান আকন্দ, মোয়াজ্জেম হোসেন আজাদ, মামুন মাহফুজ, নাজমুল করিম সিদ্দিকী, আশরাফ মীর, আতা সরকার, শফিকুল ইসলাম সেলিম, ফরিদ আহমদ দুলাল, যুগল দাস প্রমুখ। এঁদের মধ্যে রইস মনরম অন্য জেলার বাসিন্দা। মোয়াজ্জেম আজাদ ইত্যেমধ্যে অকাল প্রয়াত। নুরুল ইসলাম মানিক, নাজমুল করিম সিদ্দিকী, আহমেদ ফখরুদ্দিন ও মামুন মাহফুজ কালেভদ্রে লেখেন। সেলিম ঢাকায় থাকেন কিন্তু লেখেন না। আতা সরকার ও সালিম হাসান কথা সাহিত্যে নিয়ে ব্যস্ত। মান্নান আকন্দ কোথায় তা কেউ  জানেন না।

এঁদের অগ্রবর্তী তিনজন কবি যথাক্রমে নির্মলেন্দু গুণ, প্রণব চৌধুরী ও আলতাফ হোসেনের কথা এ প্রসঙ্গে বলতে হয়। প্রণব চৌধুরী নেত্রকোনার কবি, পরবর্তী সময়ে ছড়াকার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন, এখন দেশে নেই। নির্মলেন্দু গুণের জন্ম ময়মনসিংহে, বাড়ি নেত্রকোনায় আর থাকেন ঢাকায়। নিজেকে ময়মনসিংহের কবি বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। আলতাফ হোসেনের সাথে ময়মনসিংহের যোগাযোগ তেমন নিবিড় নয়। তাছাড়া নির্মলেন্দু গুণ ও আলতাফ হোসেন জাতীয় মাত্রার কবি। তাদের আলোচনা আলাদা হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সামনে কবি শামসুল ফয়েজ

ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের সামনে কবি শামসুল ফয়েজ

সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে অন্যতম শামসুল ফয়েজ এখনো খুবই সক্রিয়। তিনি বিদেশী কবিতার অনুবাদে খুবই সিদ্ধহস্ত। তিনি একইসাথে অনেকগুলো দেশের ভাষায় কথা বলতে পারেন, লিখতে পারেন। আড্ডারু, বোহেমিয়ান এবং মানুষের সাথে মেশার অসম্ভব মতা সম্পন্ন এ কবির প্রচুর কবিতা ইতোমধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ইতিমধ্যে তার একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে। তীব্র বাস্তবতাবোধ, নাগরিক বৈদগ্ধ এবং জীবনাকাঙ্খা তারঁ কবিতার প্রধান উপাদান। নগর মানুষের যান্ত্রিক আচরণ তার মধ্যে দ্রোহের জন্ম দেয়। যখন তিনি বলেন –

এই সব লোহা লক্করের মুখ

আমি আর দেখতে চাই না …। তখন ক্রোধ তাকে উত্তপ্ত করে, উচ্চারিত হয় প্রচণ্ড আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্রুদ্ধধ্বনি –

এইসব মুখ দেখলে আমার গলায়

গন্ডারের আওয়াজ উঠে

কেরেল্লা বালুতে দা ঘষার

শব্দ উঠে’…।

বস্তুত শামসুল ফয়েজের একটি নিজস্ব শব্দভুবন আছে, ব্যঁঙ্গ মিশ্রিত তীè ধারালো বাক্যরীতি আছে, আছে সৌন্দর্য নির্মাণের আলাদা ভাষা। সে সব দিয়েই তিনি তৈরি করেন কবিতার সোনালি অবয়ব।

আশরাফ মীর সূক্ষ্ন অনুভূতির কবি। মানব চরিত্রের নিগূঢ় রহস্য কিংবা প্রকৃতির সুঠাম শরীর দুই-ই তার প্রিয় কাব্যানুপ্রেরণা। শহর থেকে খানিকটা দূরে নদীর ওপারে থাকেন বলে যেমন অবলীলায় পাঠ করেন প্রকৃতির গূঢ় ভাষা, তেমনি পান করেন অন্তর্লীন সৌন্দর্য। চিত্রধর্ম এবং সঙ্গীতিক দ্যোতনা পাশাপাশি বসত গড়ে তার কবিতায়। যখন বলেন – ‘তোমার চেতনায় ঘুড়ি হতে পারে পাখির সখা/মেঘ হতে পারে নিরবধিকাল প্রণয়/ এই যে, স্থির হয়ে বসে আছো অলৌকিক হাওয়ায়/সম্মিলিত সুন্দর ফুটে আছে/ এখানে মৌতাত হতে পারে আলিঙ্গনের যথার্থ অনুভব।’

সাত্যিকার অর্থেই মীর শক্তিমান রোমান্টিক কবি। দৃশ্যের ভেতর থেকে তিনি বার করেন অন্তহীন সঙ্গীতের ধ্বনি ও সুরতরঙ্গ। প্রথমে প্রবেশ করেন দৃশ্যে, পরে বিচ্ছিন্ন করেন এবং শব্দমালায় সাঁজিয়ে তুলেন দৃশ্যের ভেতর যাবতীয় বস্তুর অনু ও সমুদয় ধ্বনি ও সুর।

সত্তর দশকের শেষদিকে ময়মনসিংহের কাব্যাঙ্গনে পা রাখা আরেক শক্তিমান কবি ফরিদ আহমদ দুলাল। কবি সে আপাদমস্তক, যদিও অন্যবিধ পরিচয় আছে তার। তবে সে সব ছাপিয়ে তিনি কবি-ই। তার কবিতার প্রধান বিষয় প্রেম আর প্রকৃতি। অন্যবিধ বিষয় যেমন দেশ, জাতি, সমাজ, রাজনীতি, সামাজিকতা, বন্ধুত্ব, বস্তুজগত এসব ও তার কবিতার উপাদান হয়। প্রকৃতিকে তিনি নিটোল স্বাস্থ্য আর উত্তুঙ্গ শৈল্পিক আবহে উম্মোচন করেন। যখন বলেন – ‘নদীর ওপার থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ভোর আসে,’ তখন তার দৃষ্টির সূèতা পাঠককে সূè অন্তদৃষ্টি এবং প্রকৃতির ওপর আরোপিত মানবিক আচরণের অনুভূতিতে আবিষ্ট করে। বৃ, ফুল, পাখি, প্রজাপতি আর নারী তার কবিতার প্রিয় অনুষঙ্গ।

নিভৃতচারী কবি যুগল দাস, একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থের জনক হলেও কবিতা উৎপাদনে সিদ্ধহস্ত। কাব্যকৃষিতে লাঙ্গল চষছেন দীর্ঘকাল। হতাশা-ম্লান, বেদনা-ভুতগ্রস্ত এ কবির চোখে মানুষ আর মানব জীবন যেনো নদীর মতো। সে নদী ছিঁড়ে যায় মাঝে মাঝে জীবনাবর্তের ঘূর্ণিপাকে। যখন তিনি বলেন – ‘নদী ছিড়ে যায় স্রোতের ভেতর’ এবং অনুভব করেন ‘নদীর ভেতর নেই কোনে জলগান’ তখন হৃদয়ে শূন্যতা অপ্রাপ্তির বেদনা, হাহাকার আর মানবিক প্রেমের অভাবই প্রকট হয়ে ওঠে। তখন তিনি বলেন – ‘অবলীলায় ভেঙ্গে পড়ে বিশ্বাসের বাঁধ।’ নদীতো তাঁর কাছে শুধু জলের সমূহতা নয় বরং আত্মহননের প্রবল ইচ্ছাক্রান্ত অবাধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অসংখ্য ‘নাম না জানা অবোধ রাধার সলিল সমাধি’। সে জন্য তিনি নদী থেকেই, জল থেকেই খুজঁতে চান আত্মপরিচয়। আর এভাবেই তিনি মহাভারতের ঐতিহ্যকে সমকালীন ব্যবহারে সমৃদ্ধ করতে চান। একই কারণে ঐতিহ্য হিসেবে ব্যবহার করেন লোকসাহিত্যের ‘মহুয়া’ পালার কাব্যকৌশল –

তুমি হও জলের গহীন

আমি হই টান…।

আবার কখনো ভিয়েতনাম, মেসোপটেমিয়া, ইথিওপিয়ার মানুষের দুঃখ আর নেত্রকোনার মানুষের দুঃখ আর অনুভূতিকে এক করে ফেলে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠেন তিনি। বলেন –

পিছু ডাকে ভিয়েতনাম সামনে দাঁড়ানো মেসোপটেমিয়া…

নেত্রকোনায় বেঁধেছি কালোরাত…।

আশি, নব্বই এবং চলতি শতকের শূন্য দশকে আরও একঝাঁক তরুণ কবি বেরিয়ে আসে ময়মনসিংহে। যারা সমকালীন চেতনা ও আঙ্গিকে সমৃদ্ধ। এরা উত্তরাধুনিকতা এবং আরও নানা চেতনায় উদ্বুদ্ধ। বিষয় সেই পুরোনো হতাশা-আশাবাদ, বিপ্লবাকাঙ্খা, সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি। এদের কারো কারো রচনা সম্ভাবনার অঙ্গীকারে উত্তুঙ্গ। সমকালীন বা সাম্প্রতিক কবিতাঙ্গনের পুরোধা না হলেও এরা সমযাত্রী ও সহযাত্রী। এদেরই ক’জন সাব্বির রেজা, আমিনুর রহমান সুলতান, গাউসুর রহমান, মাহমুদ আল মামুন প্রমূখ। এদের মধ্যে সাব্বির রেজা পাবনায় জন্ম নিলেও ময়মনসিংহে স্থায়ীবাস গড়ে তুলেছেন, সেই সুবাদে ময়মনসিংহের কবি। ইতোমধ্যে ‘মাধবী লতায় বৃষ্টি ও কষ্টের উঠোনে রৌদ্র’ নামে তার দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। আমিনুর রহমান সুলতানের কবিতায় রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। ওর রাজনীতি পর্বের কবিতাগুলো আরো বেশি রূপকাশ্রয়ী এবং কিছুটা দূরূহতার শিকার। সাধারণ পাঠকের খোরাক নয় সেগুলো। ওর কবিতায় প্রেম, কাম, দেশাত্মবোধ, শৈশব, কাঁচামাটিয়া নদী, বাবা-মা, মেঘ-বৃষ্টি, চাঁদ জোছনা এবং ঐতিহ্য ইত্যাকার বিষয়ও স্থান পায়। যেমন চমৎকার নির্মাণ – “ঝাউ আর জোছনার আনন্দ ছিলো/ তুমি কি এখন শানবাঁধা ঘাটের সিড়িতে বসে/ জলের আয়নায় খুঁজে পাও আমার শরীর”।

গাউসুর রহমান আশির দশকের আরেক তুখোড় কবি। অনেকটা আত্মমগ্ন, আত্মসত্তার স্বরূপ অন্বেষনে ব্যস্ত। রোমান্টিকতা ওর কবিতার প্রধান উপকরণ হলেও তা নিতান্তই আবেগের সমাহার নয় বরং মননশীল ও বুদ্ধির দীপ্তিতে ভাস্মর। সাধারণত বুদ্ধিদীপ্ত কবিরা শব্দচয়নে খুঁতখুঁতে। গাউসও তা থেকে মুক্ত নয়, কারণ ও জানে সুনির্বাচিত শব্দই কবিতাকে শিল্পের আলৌকিক বন্দরে পৌঁছে দেয়। যেমন- ‘বালুচরি শাড়ির মত আমার কাছে তুমি/খরায় দগ্ধ শস্যের জননী’ ॥ গাউস শুধু কবিই নন, সাহিত্যিক এবং মননশীল ও চিন্তামূলক বিশ্লেষণী গদ্যরচনায়ও সিদ্ধহস্ত।

অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখেন এমন একজন কবি সোহরাব পাশা। তবে তিনি ময়মনসিংহের কবি নন। যদি ও চাকুরিজনিত কারণে দীর্ঘদিন ময়মনসিংহে থেকে কাব্যচর্চা করছেন। তাঁর আছে একটি শব্দ, উপমা ও অলংকারের ভুবন এবং কবিতার আলাদা ভাষা। সেখান থেকে তিনি রাত্রি, পাথর, মেঘ, জল, স্পর্শ, আঙ্গুল এরকম অনেক শব্দে মানুষের ব্যর্থতা, গ্লানি, হাহাকার ও মনোকষ্ট-উদ্দীপনার চিত্র আঁকেন। সমাজচেতনা ও দেশাত্মবোধ তার কবিতার অন্যতম উপাদান।

মাহমুদ আল মামুন ও বাইরের জেলা থেকে আগত, কিন্তু এখন ময়মনসিংহের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি সময়ের কবি। যন্ত্রণাুব্ধ কিন্তু স্বপ্নচারী। ভালোবাসার বাগান বানাতে চান সংসার আঙ্গিনায়, বানাতে চান মানবিক প্রেমের বাগান। সে বোধ তিনি তুলে ধরেন তার কবিতায়। রাজনীতিও তার কাব্যের বিষয়।

সেলিম মাহমুদ গল্পকথনের কবি। গল্প বলার ভঙ্গিটি চমৎকার। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ, পরিচিত পরিবেশ, মানুষ, নিসর্গ গ্রাম, নগরের মেলবন্ধন ওর কবিতার প্রধান আকর্ষণ। সেলিমের কবিতারও একটি নিজস্ব স্টাইল আছে।

অন্যদিকে মরণ যাকে অকালে তুলে নিয়েছে সেই কবি মনতোষ ঘোষ ছিলেন বিপুল সম্ভাবনাময় রোমান্টিক মননের কবি। একই ধারার কবি সাজাহান সিরাজী খুবই কম লিখলেও এ কবির শক্তিমত্তা অনস্বীকার্য। সিরাজীর কবিতা মানুষের অন্তর্দেশকে তুলে ধরে। আশিক সালাম ও সৌরভ জাহাঙ্গীর একই গোত্রের কবি। ওদের কবিতায় মানুষের মনোজগৎ উম্মোচনের প্রচেষ্টা থাকে। আশিক ও সৌরভ শব্দ বুননেও পারদর্শী। সৌরভের কবিতায় রাজনৈতিক অঙ্গীকারও লক্ষ্যণীয়।

সাধারণত মহিলা কবিদের কবিতায় এক জাতীয় জড়তা থাকে। এককালে মহিলাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় “বেগম” পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাগুলো এর যথার্থ উদাহরণ। তবে আমাদের অনেক কবিই যেমন সুফিয়া কামাল, খালেদা এদিব চৌধুরী, কাজী রোজী, সুরাইয়া খানম এবং সাম্প্রতিক অনেক কবিই এ জড়তা থেকে মুক্ত। ময়মনসিংহের মহিলা কবিরা এ ধারারই উত্তরাধিকার। এদের মধ্যে শুধু ময়মনসিংহ নয় সারা বাংলাদেশে এবং সারা দুনিয়ায় ঝড় তোলা তসলিমা নাসরীন অত্যন্ত সফল কবি। নারীবাদ তথা নারীর স্বাধিকার অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাঁর কবিতার প্রধান অবলম্বন। রোমান্টিকতার পাশাপাশি সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা, অম্প্রাদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গী তসলিমার কবিতার প্রধান উদাহরণ। তসলিমা অত্যন্ত শিল্পসফল কবিও। তলোয়ারের চাইতে ধারালো, তীক্ষ্ন শব্দে রক্তকলম হাতে তিনি রুখে দাঁড়ান পুরুষের আধিপত্যের, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আবার কখনো কোমল গীতল শব্দে উপস্থাপন করেন নারীর অন্তরের সৌন্দর্য। এ ধারার আরেকজন কবি ময়মনসিংহে নিজের আসন তৈরির চেষ্টা করে চলেছেন। তিনি নাজমা মমতাজ। জড়তাহীন, রোমান্টিক ও বক্তব্যধর্মী শিল্পসফল কবিতা লেখায় তিনি যথেষ্ট সাবলীল।

তরুণদের মধ্যে সম্ভবনাময় মুজিব মেহেদী। শব্দের ওপর ওর আধিপত্য যেমন প্রবল, তেমনি ও শব্দকে ঝনৎকার বাজিয়ে তুলতে পারদর্শী। ওর কবিতায় বুদ্ধিমতা, সূক্ষ্ম কারুকাজ লণীয়। আরও সম্ভাবনাময় কবিদের মাঝে ইয়াজদানী কোরায়শী, মেহেদী ইকবাল, মোস্তাক বিবাগী, আলী ইদ্রিস, আলী ইউসুফ, অতনু তিয়াস, বিল্লাল মেহেদী, সফেদ ফরাজী, মশিউর রহমান খান, স্বাধীন চৌধুরী, মনো জসীম, আশিক আকবর, শাবিহ মাহমুদ প্রমুখদের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। এদের কেউ কেউ এ জেলার কবি নন।

সংেেপ এই হচ্ছে ময়মনসিংহের কবি ও কবিতা। এ আলোচনা নিতান্তই সংপ্তি ও অসম্পূর্ণ। ময়মনসিংহের সাহিত্য বা কবিদের যযার্থ মূল্যায়ন এতোটা অল্প পরিসরে সম্ভব নয়। প্রকৃতপে এটা মূল্যায়নধর্মী রচনাও নয়। কোন ভুল বা অভিযোগ থাকলে লিখে পাঠাবেন। আমরা শুধরে নেব।

লেখক : কবি ও গবেষক নজরুল হায়াত, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!