বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর কথা : যতীন সরকার

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

CHANDRABOTI-PICবাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি : চন্দ্রাবতীর কথা
যতীন সরকার

বনে অনেক সময় এমন ফুল ফুটে, রাজোদ্যানেও তাহার তুলনা মিলে না, সে-বনফুলের সৌন্দর্য্য কেহ উপলব্ধি করিতে, কিংবা সে-সৌরভ কেহই ভোগও করিতে পারে না, বনের ফুল বনে ফুটে, বনেই শুকায়। চন্দ্রাবতী এই রূপ একটি বনফুল, ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে, একসময় এই সুরভি কুসুম ফুটিয়াছিল।”
এভাবেই ময়মনসিংহ থেকে কেদারনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকায় (ফাল্গুন ১৩২০ বঙ্গাব্দ/ ফেব্র“য়ারি ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ) চন্দ্রকুমার দে তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘মহিলা কবি চন্দ্রাবতী’ শুরু করেছিলেন। এর আগে ‘শিক্ষিত’ সমাজের কেউ ‘ময়মনসিংহের নিবিড় অরণ্যে’ প্রস্ফুটিত চন্দ্রবতী নামের এই ‘সুরভি কুসুমটি সর্ম্পকে অবহিত ছিলেন না, অবহিত হওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। অথচ চন্দ্রাবতীর স্মৃতি-বিজরিত মন্দিরটি কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারের গ্রামে আজও বিদ্যামান। দীর্ঘকাল ধরেই চন্দ্রাবতীর কাহিনীর সঙ্গে সেকালের পূর্ব ময়মনসিংহের লোক সাধারণের ছিল নিবিড় পরিচয়। সেখানকার পল্লীবালাগণের কণ্ঠস্থ ছিল চন্দ্রাবতী-রচিত রামায়নের বিভিন্ন অংশ। চন্দ্রকুমারের অননুকরণীয় ভাষায় –
“যাঁহার কবিতা লোকের প্রাণের মধ্যে মনের মধ্যে সর্বদা প্রিয়জনের স্মৃতির ন্যায় ঘুরিয়া ফিরিয়া, ভাসিয়া ভাসিয়া বেড়ায়, ছোট বড় নাই, স্থান-অস্থান নাই, মুখে মুখে ফেরে, তিনিই সাধারণের প্রাণের কবি। চন্দ্রাবতী পূর্ব ময়মনসিংহের সর্বসাধারণের প্রাণের কবি ছিলেন। বহুদিন হইতে শুনিয়া আসিতেছি – সেই অপূর্ব মনপ্রাণ মাতান সঙ্গীত। মাঠে কৃষকের, শিশুর মুখে মুখে, আঙ্গিনায় কুলকামিনীদের মুখে, ঘাটেবাটে, মন্দিরে, প্রান্তরে, বিজনে, নদীর পুলিনে সেই সঙ্গীত; বিবাহে, উপনয়নে, অন্নপ্রাশনে, ব্রতে, পূজায় সেই সঙ্গীত ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া কানে আসিয়া বাজে, মরমের ভিতর প্রবেশ করে, — প্রায়ই শুনি চন্দ্রাবতী ভনে, চন্দ্রাবতী গায়।
শ্রাবণের মেঘভরা আকাশতলে ভরা নদীতে যখন বাহকগণ সাঁঝের নৌকা সারি দিয়া বাহিয়া যায়, তখন শুনি সেই চন্দ্রাবতীর গান, বিবাহে কুলকামিনীগণ নব বরবধূকে স্নান করাইতে জলতরনে যাইতেছে আর গাইতেছে সেই চন্দ্রাবতীর গান, তারপর ক্ষৌরকার বরকে কামাইবে তার সঙ্গীত, বরবধূর পাশাখেলা, তার সঙ্গীত সে কত রকম !”
সেকালের পূর্ব ময়মনসিংহের লোকসমাজে এমন ব্যাপক পরিচিতি ছিল যে- চন্দ্রাবতীর, যিনি ছিলেন ‘সর্ব সাধারণের প্রাণের কবি’, ‘শিক্ষিত’ সমাজের মানুষেরা কেন প্রায়-অনবহিত ছিলেন তাঁর সম্পর্কে ?
এ প্রশ্নের জবাব নিহিত আছে ‘সর্বসাধারণে’র সঙ্গে তথাকথিত ‘শিক্ষিত ও অসাধারণ’ মানুষদের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে। ‘শিক্ষিত’ মানুষদের তো ‘কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়।’ লোকসমাজের একেবারে ভেতর থেকে উঠে এসে সারা জীবন সে-সমাজেরই মানুষ হয়ে থেকেছিলেন যে-চন্দ্রকুমার দে, তিনিই ‘শিক্ষিত’ মানুষদের কেশের আড়ালে লুকিয়ে-থাকা পাহাড়টির অস্তিত্ব সকলকে জানিয়ে দেয়ার প্রয়াসী হয়েছিলেন, তিনিই বিচ্ছিন্নতার যবনিকা ভেদ করে চন্দ্রাবতীর পরিচয় সর্বসমক্ষে উদঘাটন করেছিলেন। চন্দ্রকুমারের লেখা পড়েই আমরা জানলাম: চন্দ্রাবতীই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি।
চন্দ্রাবতীর পিতা ষোড়শ শতকের প্রখ্যাত মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ রচয়িতা কবি দ্বিজবংশী দাস। জন্মস্থান কিশোরগঞ্জ শহরের অদূরবর্তী পাতুয়াইর গ্রাম। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে – পিতা ও কন্যা একত্র হইয়া মনসা দেবীর ভাসান (১৫৭৫খৃঃ) রচনা করিয়াছিলেন।” জয়ানন্দ নামে প্রতিবেশী এক ব্রাহ্মণ-কুমারের সঙ্গে বালিকা চন্দ্রাবতীর প্রণয় সঞ্চার ঘটেছিল। চন্দ্রকুমার লিখেছেন – প্রণয় যখন গাঢ় হইয়াছিল, চন্দ্রাবতী তখন মনে মনে তাঁহার প্রাণের দেবতার পদে সমস্ত জীবন-যৌবন ঢালিয়া দিলেন। বিবাহের কথাবার্তা এক রূপ স্থির হইয়া গেল, এমন সময় এক বিষম অনর্থ ঘটিল। অলক্ষ্য হইতে নিদারুণ বিধাতা কল ঘুরাইলেন। মূর্খ যুবক এক মুসলমান রমণীর প্রেমে আত্মবিক্রয় করিয়া ধর্মান্তর গ্রহণ করিল। সে বুঝিল না কি অমূল্য রত্নই হেলায় হারাইল!!”
অদৃষ্টের সেই ঘাত প্রতিঘাতে চন্দ্রাবতীর কোমল হৃদয় ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি বহুদিন পর মনস্থির করিয়া শিবপূজায় মনোনিবেশ করিলেন। তিনি স্নেহময় পিতার চরণে দুইটি প্রার্থনা জানাইলেন, একটি নির্জন ফুলেশ্বরী তীরে শিবমন্দির স্থাপন, অন্যটি তাঁহার চিরকুমারী থাকিবার বাসনা। কন্যাবৎসল পিতা উভয় সংসারের সুখ-দুঃখের অনিত্যতা বুঝাইয়া দিলেন। চন্দ্রাবতী কায়মনোবাক্যে শিবপূজা করিতেন ও অবসরকালে রামায়ণ লিখতেন। তাঁহার এই রামায়ণ এ অঞ্চলের মুখে মুখে গীত হইয়া থাকে – মুদ্রিত হয় নাই।”
চন্দ্রবতী তাঁর রামায়নের ‘সীতার বনবাস’ রচনার পরপরই — আর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়া গেল। চির অনুতপ্ত চন্দ্রাবতীর সেই প্রণয়ী যুবক তুষানলে পুড়িয়া পুড়িয়া, দুর্বিষহ জীবনভার সহ্য করিতে না পারিয়া, চন্দ্রাবতীর উদ্দেশ্যে একখানা পত্র লিখিয়া তাঁহার সাক্ষাৎ কামনা করিল।
চন্দ্রাবতী পিতাকে সমস্ত জানাইলেন। পিতা অসম্মতি প্রকাশ করিয়া বলিলেন, তুমি যে দেবতার পূজায় মন দিয়াছ তাহারই পূজা কর। অন্য কামনা হৃদয়ে স্থান দিও না। চন্দ্রাবতী যুবককে একখানা পত্র লিখিয়া সান্ত্বনা প্রদান করিলেন এবং সর্বদুঃখহারী ভগবান শিবের চরণে মনপ্রাণ সমর্পণ করিতে উপদেশ দিলেন। অনুতপ্ত যুবক পত্র পাঠ করিয়া তৎক্ষণাৎ চন্দ্রাবতীর স্থাপিত শিবমন্দিরের অভিমুখে ছুটিল। চন্দ্রাবতী তখন শিবপূজায় তন্ময়, মন্দিরের দ্বার ভিতর হইতে রুদ্ধ। হতভাগ্য যুবক আসিয়াছিল চন্দ্রাবতীর কাছে দীক্ষা লইতে, অনুতপ্ত দুর্বিসহ জীবন প্রভুপদে উৎসর্গ করিতে। কিন্তু পারিল না, চন্দ্রাবতীকে ডাকিতেও সাহস হইল না। আঙ্গিনার ভিতর সন্ধ্যামালতীর ফুল ফুটিয়াছিল, তারই দ্বারা কবাটের উপর চার ছত্র কবিতা লিখিয়া চন্দ্রুাবতীর নিকট, বসুন্ধরার নিকট, শেষ বিদায় প্রার্থনা করিল।
পূজা শেষ করিয়া চন্দ্রাবতী দ্বার খুলিয়া বাহির হইলেন। আবার যখন দ্বার রুদ্ধ করেন তখন সেই কবিতা পাঠ করিলেন, পাঠ করিয়াই বুঝিলেন – দেবমন্দির কলঙ্কিত হইয়াছে। চন্দ্রাবতী জল আনিতে ফুলিয়ার ঘাটে গেলেন, যাইয়া বুঝিলেন, সব শেষ হইয়া গিয়াছে, অনুতপ্ত যুবক ফুলিয়ার স্রোতধারায় নিজের জীবনস্রোত ভাসাইয়া দিয়াছে।
বনফুল শুকাইয়া উঠিল। ইহার পর চন্দ্রাবতী আর কোন কবিতা লিখেন নাই, এইরূপে রামায়ণ অপরিসমাপ্ত রহিয়া গেল। তারপর একদিন শিবপূজার সময় তাঁর প্রাণবায়ু মহাশূন্যে মিলাইয়া গেল। আমরা যে উজ্জল কোহিনূর রতœ চিরদিনের তরে হারাইলাম তাহা আর পাইলাম না।”
শুধু রামায়ণ নয়, চন্দ্রকুমার সংগৃহীত ও ‘ময়মনসিংহ গীতিকায় সংকলিত ‘দস্যু কেনারামের পালা’ এবং সম্ভবত ‘মলুয়া’ ও ‘দেওয়ান ভাবনা’ও চন্দ্রাবতীরই রচনা।
‘কেনারামের পালা’ যে চন্দ্রাবতী রচিত এতে কোনোই সন্দেহ নেই।এই পালার প্রায় প্রথমেই আছে চন্দ্রাবতীর ভনিতা –
চন্দ্রাবতী কয় শুন গো অপুত্রার ঘরে
সুন্দর ছাওয়াল হইল মনসার বরে।

এরপর একাধিকবার আছে চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজবংশী দাসের উল্লেখ। যেমন –
১. ভাসান গাইতে পিতা যান দেশান্তর।
পথে পাইয়া কেনারাম আগুলিল তারে ॥
২. যখন গাইল পিতা বেউলা হইল রাড়ী।
কেনারামের চক্ষে জল বহে দড়দড়ি ॥
৩. পয়ার প্রবন্ধে ভনে দ্বিজবংশী সুতা।

কেনারাম ছিল দসু্যু। সেই দস্যু শুধু পথিকের বা গৃহস্থের ধনসম্পদই লুন্ঠন করতো না, যে-কোনো মানুষকে অনায়াসে সে হত্যা করতে পারতো। তার নিজের কথায় –
পাই বা না পাই কিছু ইতে নাই দুখ।
মানুষ মারিয়া আমি পাই বড় সুখ॥
দ্বিজবংশী যখন তাকে স্মরণ করিয়ে দেন – ‘নরহত্যা পাপ/নরকে যাইবা তুমি না পাইবা মাপ’

তখন – হাসিয়া হাসিয়া তবে কহে দস্যুপতি।
“সাত পাঁচ ভুলাইতে চাহ অল্পমতি ॥
মানুষ মারিয়া মোর গেল তিনকাল।
শুনিব তোমার কাছে ধর্মের আলাপ ॥
মানুষ মারিয়া মোর মনে নাহি দুখ।
যত মারি তত যেন পাই মনের সুখ ॥
পাপ পূণ্য নাহি জানি মানুষ মারিব।
তোমার কাছেতে ঠাকুর ধর্ম না শিখিব ॥

কিন্তু অবশেষে ঠাকুরের কাছে ধর্র্ম তাকে শিখতেই হয়। বংশীদাসের গান দস্যুর চরিত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে, দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঘরে মনসার গান শুনিয়ে সে তার জীবনের অপরাহ্নকাল অতিবাহিত করে।
‘দেওয়ান ভাবনা’ বা ‘মলুয়া’র পালা যে চন্দ্রাবতীরই রচনা, এ- বিষয়ে পুরোপুরি নিঃসংশয় হওয়া যায় না হয়তো। তবু এ দুটো পালাকেও চন্দ্রাবতীর রচনা বলে গ্রহণ করার পক্ষে অনেক অভ্যন্তরীণ যুক্তি-প্রমাণ আছে। সে-সব যুক্তি-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই অনির্বাণ রায় চৌধুরী লিখেছেন –
‘পালাদুটির মধ্যে নারী চরিত্রের স্বাধীন-চিত্ততা, সতীত্ববোধ ও একনিষ্ঠতার পরিচয় রয়েছে এবং পালার নায়িকারা যে রকম জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করেছে ও ব্যর্থ প্রণয়ের জ্বালায় দগ্ধ হয়েছে, তাকে অনুধাবন করলে এগুলোর মধ্যে যে কবির জীবনের ব্যক্তি অনুভূতি ধরা পড়ে, তাতে এগুলিকে চন্দ্রাবতীর রচনা বলে ধরলে বোধ হয় অন্যায় হয় না।
আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন এক সময় সহজিয়া চন্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী রামীকে আমাদের সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর এই মত শেষ পর্যন্ত সর্বজন গ্রাহ্য হয় নি। চন্দ্রাবতীই যে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি, সে ব্যাপারে বর্তমানে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অন্তত তাঁর ‘অপরিসমাপ্ত’ রামায়ণের আনুপূর্বিক পর্যালোচনাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি শুধু ‘প্রথম মহিলা কবি’ই নন, প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবিও তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!