পথনাটক : পথে নামার সময় অসময়

মাজহারুল হক পিন্টু

Sharing is caring!

0342013182955poth-1

পথনাটক শুধুমাত্র বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ভূত এক ধরনের নাট্যশৈলী তা নয়। নাটকে কি বলতে চাইছি, কেন বলতে চাইছি, কাকে বলতে চাইছি এগুলি পথনাটকের উৎস এবং ভিত্তি। সেই কারণেই পথনাটক শুধুমাত্র গবেষণাগারপ্রসূত একটা অভিনব নাট্যশৈলী নয় এটা পথে মাঠে ঘাটে পরীক্ষিত যুগের ও সমাজের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এক আন্দোলন।

প্রসেনিয়াম থিয়েটার প্রগতিশীল মূল্যবোধ প্রচার করলেও তার উপস্থাপনার কারণে সে সীমাবদ্ধ থাকছে চার দেয়ালে। অর্থাৎ কৃষক মজুর শ্রমজীবি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে সেটা পৌঁছে না। এরকম অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের আন্দোলনের চেষ্টা হয় নাট্যের মারফত আমাদের কাঙ্খিত বক্তব্য প্রকাশ করবার, যাতে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের কাছে নাটকের বক্তব্য পৌঁছায়। এই আদর্শ এবং লক্ষ নিয়ে এগিয়ে চলে বাংলাদেশের ‘পথনাটক’। বাংলার সমাজ রাজনীতি শ্রেণী সংগ্রাম এ বিষয়গুলি তাই নাট্য বিষয় হয়ে আসে বারবার পথনাটকে। যদিও পৃথিবীর থিয়েটারের ইতিহাস, উৎস রিচ্যুয়াল থেকে। আমাদের দেশের লোক আঙ্গিকের নাট্যক্রিয়াগুলি আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। সেক্সপিয়ারের প্রসেনিয়াম নাট্যায়ণ, ব্রেশ্ট এর ক্লাসিক এপিক বা ইবনেসেন এর আধুুনিক প্রয়োগ নাট্যরীতি বিভিন্ন ভাবে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত এবং আমাদের দেশের থিয়েটার আন্দোলনেও যার বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তবুও এগিয়ে চলে সময় এগিয়ে চলে মানুষ। সময় পাল্টায় তার সাথে পাল্টায় মানুষের প্রয়োজন। এই প্রয়োজনকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের পথনাটক সরাসরি রাজনৈতিক ভূমিকা বা দায়বদ্ধতা হাতে তুলে নিয়ে নেমে যায় মাঠে। ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’, ‘ফেরারী নিশান’, ‘জাগে লক্ষ নূরহোসেন’ পথনাটক গুলির মত আরোও কিছু পথনাটকের কথা যখন এ দেশের মানুষ সারাজীবন মনে রাখে তখন থিয়েটার শুধু আর বিনোদন থাকেনা থিয়েটার হয়ে ওঠে সচেতন মানুষের প্রতিবাদী শিল্প মাধ্যম।

‘থিয়েটার’ কথাটা আমাদের মতো নাট্যর্কমীদের মনে যে এক বিশেষ ধরণের ছবি তৈরী করে সেটা হচ্ছে ইট-পাথর-কংক্রীটের একটি আধুনিক স্থাপত্য যার ভিতরে অভিনীত হবে নাটক সাহিত্যের ক্রিয়ারূপ উপস্থাপনা যাকে আমরা বলি নাট্য। আয়োজনের পশরা থেকেই বুঝে নিতে পারি যে এটি সর্বসাধারণের জন্য কি না। একটি প্রবেশপত্র যা আমাকে দেয়া হয়েছে একটি নিদৃষ্ট মূল্যের বিনিময়ে এবং কতোটা দিয়েছি, তার উপর নির্ভর করবে কোথায় আমার আসন। বেশী দিলে সামনে, যতো কম দেবো ততো পেছনে। আসনটি আমার একার একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। বেল বাজলো, হল অন্ধকার হলো, পর্দা সরে যেতে অন্ধকার আর নৈঃশব্দের আড়ালে দ্যাখা গেলো কাঙ্খিত অভিনয়। এই অন্ধকার হল, মঞ্চ, অভিনয়, সেখানকার মানুষগুলি, কারোও সঙ্গে আসলে আমার কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। তারা যেমন সব ‘অন্য’ মানুষের রূপ ধরেছে অভিনয়ের সার্থে, আমিও সেইরকমই একজন অন্য মানুষ অন্ধকারে লুকিয়ে, নিঃশব্দে, বসা একা ! এ সকল নাট্য ক্রিয়া বা চর্চা সবই ঐ একটি নির্দিষ্ট মঞ্চের মধ্যে, ঘটনা আর বিষয় উপস্থাপনার মধ্যে গ-িবদ্ধ ! কিন্তু যখন প্রশ্ন ওঠে গণচেতনার, যখন বিষয় হয় শ্রেণী শোষনের মুক্তি, নিজস্ব ঐতিহ্যের অনুসন্ধান, তখন একজন প্রগতিশীল নাট্যশিল্পীর ভাবনায় স্থান পায় নতুন সৃষ্টির। একজন সচেতন নাট্যকর্মী বা নাট্যকার অথবা নির্দেশক চিন্তা করে গণমানুষের জীবন সংগ্রাম নিয়ে, তার ভাবনায় স্থান পায় তার দেশ-জাতি, শিল্প-সংস্কৃতি, রাষ্ট্র-রাজনীতি। তখন সে প্রকাশ ভঙ্গিটাও হতে হয় গ্রহনযোগ্য কোন আদলে ? আর বিষয়টি যাদের মুক্তির জন্য তাদের নিয়ে তাদের মাঝে উপস্থাপন করাটা যদি উদ্দেশ্য হয় তবে দায়িত্বটা তখন বড় আকার ধারণ করে। শিল্পের স্বভাব অনুযায়ী তাগিদটা তখন একটা কেবল নির্দিষ্ট গ-িতে সীমাবদ্ধ থাকে না, এক নতুন সৃষ্টির উদ্দিপনা নিয়ে সে এক নতুন পথের সন্ধানে অনুপ্রেরণা যোগায়। এদেশের অধিকার বঞ্চিত লাখো মানুষের মুক্তির লক্ষে আমরা তাই সন্ধানে ফিরি মুক্তমানুষের মুক্তনাটক এর। আর তখনই বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলনের বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই পথনাটক।

মানুষ এবং মানুষের জীবন তার শরীর, মন বাক্য ক্রিয়া প্রতিফলিত হয়ে তার সাহিত্যে ও শিল্পের বর্ণনায়। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম গুলির তুলনায় নাটক জনপ্রিয় বেশী এজন্যই যে সেটি অভিনয় প্রধান। এখানে মানব জীবনের বিভিন্ন রূপ অভিনয়ের অর্থাৎ নাট্য ক্রিয়ার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। নাটক এবং সমাজজীবনের এই ঘনিষ্ট সম্পর্ক সমাজের উপর নাটকের প্রভাব বিস্তৃত। সমষ্টি চেতনাকে উদ্দিপিত করতে চিরকাল এই নাটক এবং নাট্যক্রিয়া প্রধান হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহৃত হয়েছে। আর যদি সে নাট্য ক্রিয়াটি হয়ে থকে সাধারণের জন্য, তাদের নিয়ে তাদেরই মাঝে?

সময়ের চাহিদায় আজ মানুষ যখন তার রাজনৈতিক সামাজিক বা অর্থনৈতিক চেতনার সম্পর্কে আরোও বেশি দায়বদ্ধ তখন নাটক শুধু শিল্প নৈপুণ্যের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখবেনা এটাই স্বাভাবিক এবং তাই ঘটেছে বাংলাদেশের পথনাট্যচর্চার ক্ষেত্রেও। নাট্যশিল্পকে শুধু মাত্রই বিনোদন যারা ভাববেন তাদের জন্য নয় এই নাট্যক্রিয়া কারণ এই ক্রিয়া বা থিয়েটার জনগনের থিয়েটার, গণমানুষের মুক্তির সাথে সম্পৃক্ত তার প্রয়োগ চিন্তা, গল্পের বিষয়বস্তু। যে নাট্যক্রিয়া থেকে রাষ্ট্রের বড় অংশ গণমানুষ পায় মুক্তির বানী। কারণ এটি পথনাটক।

পথনাটক বিষয় বিবেচনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিনোদন কিংবা শিল্প নৈপুণ্যে প্রদর্শিত হয় বা হয়েছে এবং হচ্ছে, বাংলাদেশেও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে গণআন্দোলনের ধারায় মুক্ত বা পথনাট্য প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্নতর। যদিও পৃথিবীর থিয়েটারের ইতিহাস প্রতিটি দেশেই শুরু হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে নানা দেবদেবীর অর্চনা আরাধনার মধ্য দিয়ে। কি গ্রীস অথবা মিশর কিংবা জাপান অথবা চিন সব দেশে একই ধারা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের নাট্যকলার ইতিহাসেও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি। লোকনাটক পালা কীর্তন-এর বিষয়গুলিতো তারই সাক্ষ্য বহন করে ? কিন্তু আজকের আধুনিক নাট্যধারার স্রোতটি বাংলাদেশে শুরু হয়েছিলো মূলত ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্র ধরে। অর্থাৎ মুক্তিসংগ্রামের চেতনা শক্তিকে ধারণ করে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের থিয়েটার এনেছিলো এক বিরাট পরিবর্তন। কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা এক ঐক্যে শুরু করেছিলো এই স্বাধীনতা সংগ্রাম। যার হাত ধরেই আজকের বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলন।

হাতের কাস্তেটাকে শান দিয়ে যে কিষাণ ঝাঁপিয়ে পড়তো ফসল কাটার উৎসবে, একদিন তাকে সেই ধারালো কাস্তেটাকেই বাগিয়ে ধরতে হয়েছে প্রভুদের বিরুদ্ধে জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে। কারণ এ শতকের শুরুই হয়েছিলো সামন্ততান্ত্রিক শোষণের মধ্য দিয়ে। ফলে বিদেশী সামন্ততান্ত্রিক প্রভূ এবং তাদের এদেশীয় দালালদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ আর দুর্গতি  দেশের মানুষকে তাই সচেতন করে তুলেছিলো। ফলে এ সময় ঘনিয়ে ওঠে বৃটিশ শাসক শোষকদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান।
-কামাল লোহানী

‘আলোর পথযাত্রী’ রাস্তায়, মাঠে এবং সিলেটে ধানের ক্ষেত্রে পর্যন্ত অভিনীত হয়েছিলো গণমানুষের চেতনার হাতিয়ার হিসাবে। ইতিহাস এটাই বলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পথনাট্য বা মুক্তনাট্য একটি শক্তিশালী এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিন অঙ্কের নাটক কে এক অঙ্কে পরিণত করা হয়েছিলো বৃটিশ সরকারের প্রচলিত অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য এমন কি নাট্যকারের নামটিও সেদিন গোপন করা হয়েছিলো কারণ তিনি ভারতীয় ছিলেন বলে। মুখ্য ছিলো নাটকটি নাট্যকার বা আঙ্গীক নয়।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতীয় চেতনা, রাজনৈতিক আন্দোলন যাই বলি না কেন পথনাটকগুলিতে শোষণ আর শাসক শ্রেণীর ভেতরের চেহারা তাদের অত্যাচারের রূপটাই প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়ে। একদিকে জোতদার, মজুতদার, ব্যবসায়ী মালিক অর্থাৎ শাসক শ্রেনী অন্যদিকে চাষী মজুর সর্বহারা শোষিত শ্রেনী। যার কারণে পথনাটকের নামকরণ থেকেও প্রকাশ পায় শ্রেনী আন্দোলনের চিত্র।

অভিনয় পদ্ধতি, নাট্য আঙ্গিক সৃষ্টি, মঞ্চায়ণ কৌশল এই বিষয়গুলি ৮০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে বিবেচ্য হয়ে আসছিলো। কিন্তু আবার ৯০’র দশকে যার প্রয়োগ ঘটেছে বেশী। এই দশকটি বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কেননা বৃহত্তর জনজীবনের স্বার্থে সত্যিকারের বিকল্প ধারার নাট্যচর্চার পথনাট্য বা মুক্তনাট্যের মহান প্রয়োগ ঘটেছিলো এই সময়ে। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথনাটক ও মুক্তনাটক সাফল্যের এক নব দিগন্ত দেখিয়েছিলো এদেশের সাধারণ মানুষকে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে শুধু নয় এদেশের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মকা-েও পথনাট্য তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যূত্থানে সারা দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ নাট্যকর্মীরা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরীর লক্ষ্যে পথনাটককে ছড়িয়ে দেয় দেশের আনাচেকানাচে। আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ করতে এ সময় তৈরী হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জোট। এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নাটক সব সময়ই গণমানুষের কথা বলে এসেছে আর পথনাটক প্রসঙ্গে ‘গণমানুষ’ কথাটি যুক্ত হয়েছে তার কারণ ‘পথনাটক’ বিষয়টিই বলে দেয় তার অবস্থানটি কোথায়।

এই যে মুক্ত বা পথনাটক এবং গণমানুষ তার অধিকার অর্থাৎ শোষণমুক্ত একটি সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের যে সংগ্রাম তার একটা বড় অংশ জুড়েই নাট্য বিষয়টি সম্পৃক্ত আর এই নাট্য আন্দোলনেরই আরো একটি শক্তিশালী অংশ বাংলাদেশের মুক্ত ও পথনাট্যচর্চা। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে গণমানুষের চেতনাকে আরো সংঘবদ্ধ, শক্তিশালী এবং আন্দোলনমুখর করতে পথনাট্যচর্চা হয়ে উঠে একটি অপরিহার্য শক্তিশালী বিষয় যা এখনো প্রবাহমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বৈর সরকারের শাসন আমলটি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তার সূত্র ধরে ৯০-এর গণ অভ্যূত্থান বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটি বড় বিষয়।

১৯৯০ এর সারা বাংলাদেশ ব্যাপি স্বৈরাচারী সরকার পতনের সংগ্রামে নাট্য আন্দোলনটি হয়েছিলো একটু ভিন্ন। পথনাটক এই সময়টাতে নাট্যকর্মীদের যতটুকু সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে গড়ে উঠেছিলো, মঞ্চনাটকে দু-একটি উল্লেখযোগ্য নাটক ছাড়া সেরকম কোন বিষয় তখন প্রতিবাদে গর্জে উঠেনি। রাজপথে বুকে পিঠে শ্লোগান লিখে নেমেছিলো ৯০-এর সবচাইতে বড় প্রতিবাদী একটি মানুষ। সবচেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো একটি কন্ঠস্বর সে নূর হোসেন। স্বৈরাচার সরকারের একটি গুলি হয়তো সাময়ীক ভাবে তখন স্তব্ধ করে দিয়েছিলো সেই প্রতিবাদ কিন্তু থামাতে পারেনি আন্দোলন। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এটা হয়তো নতুন কোন বিষয় হিসাবে উঠে আসবে না। তবুও এটাই ৯০-এর গণঅভ্যূত্থানের মূল কেন্দ্রবিন্দু। নূর হোসেনের মতো ডাঃ মিলনকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলো সেদিন সেই সময় যখন আন্দোলন হয়ে উঠেছিলো আরো প্রতিবাদ মুখর। গণমানুষকে সেদিনের আন্দোলনে আরো প্রতিবাদী হতে তাদের মাঝে সেদিন কারক নাট্য সম্প্রদায় উপস্থাপন করেছিলো পথনাটক “জাগে লক্ষ নূর হোসেন”। রাস্তায় শহীদ মিনারে মুক্তাঙ্গনে গ্রুপ থিয়েটারের দল থেকে শুরু করে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীগণ সে সময় পথনাট্য রচনা এবং উপস্থাপনা করেছিলো। বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাসে তা স্মরণীয় ঘটনা হিসেবেই যুগ যুগ থেকে যাবে। একটি দেশের রাজনীতি সে দেশের নাট্যকর্মীদের প্রভাবিত করে ফলে তৈরী হয় ৯০ এর মত একটি ইতিহাস যা ঘটেছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসেও।

নাটকের সংজ্ঞা নিরুপণ নয়, নয় বিশেষ কোন দর্শন, শুধূ গণমানুষের বক্তব্য তাদের অধিকারটাই তখন বিষয় উপস্থাপনার মূল উদ্দেশ্যে হয়ে উঠে। বিচার হয় না যে নাটকের উপস্থাপনাটি শৈল্পিক নয়, নাট্যপ্রয়োগ রীতির কৌশলগুলি ঐ উপস্থাপনায় অবর্তমান কিংবা, সেটি একটি নির্দিষ্ট রীতির অন্তর্গত নয়। সংগ্রামটাই তখন প্রধান লক্ষ্য হিসেবে সবার সামনে ধরা পড়ে, দলমত নির্বিশেষে হাত মেলায় স্বৈরাচারের পতনে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালি দর্শককে রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন করতে পথনাট্যের ভূমিকাকে তাই আজ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। গণনাট্য চর্চার মূল লক্ষ্য, বিষয় নির্বাচন এবং পথনাট্য রীতির এই সহজ মাধ্যমটি উপস্থাপনার সহজতর রূপের কারনে নাট্যকর্মীদের কাছে তার গ্রহনযোগ্যতা গড়ে তুলেছে।

বাংলাদেশে গণমানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত যত রাজনৈতিক আন্দোলন তার প্রত্যেকটির প্রধান ভূমিকায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন লক্ষণীয় এবং নাট্য বিষয়টি রয়েছে যার প্রধান ভূমিকায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যে সচেতন নাট্যকর্মীরা একত্রিত হয়েছিলো তাদের নায্য দাবীতে সেদিন এদেশ থেকে তাড়িত হয়েছিলো পাকিস্তানি অপশক্তি শেষ হয়েছিলো পাক-শাসকের আগ্রাসন। ১৯৯০ এর গণ অভ্যূত্থানে সেই নাট্যকর্মীরাই প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পতন ঘটিয়েছে স্বৈরাচার সরকারের। ১৯৭১ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যূত্থান পর্যন্ত এবং আজও তাই গণমানুষের সংগ্রামী হাতিয়ার এই পথনাটক।

আজ বলছি পথ হারিয়েছে বাংলাদেশের পথনাটক। অর্থাৎ পরিবারের যে সন্তানটির উপর র্নিভর করে আমার পথচলা সেই সন্তানটিই হারিয়েছে তার গতিপথ ! সত্যি, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সমাজ যেহেতু কতগুলি জীবন নির্ভর একটি গোষ্ঠীর সমষ্টিগত রূপ তাই সমাজটিই এখানে জীবন, আর এ জীবনের অর্থই সংগ্রাম প্রকৃতির সাথে জীবনের, জীবনের সাথে জীবনের অস্তিত্বের টিকে থাকার এই নিয়মিত সংগ্রামে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবনের অন্যায় অবিচার কে প্রতিহত করতেই জন্ম নেয় প্রতিরোধ। শিল্পরূপ মাধ্যমটি প্রতিরোধের রূপে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে গণমনের বিক্ষোভকে জাগাতে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে, পুজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিবাদ করে নেমে আসে রাস্তায় পথ নাট্যক্রিয়ার রূপে নাট্যক্রিয়ায় যেহেতু অভিনেতা আর দর্শকদের মাঝে ঘটে সরাসরি যোগাযোগ যেহেতু ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়াটি ঘটে প্রত্যক্ষ ভাবে সেহেতু এখানে অশুভের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সূচনাটিও ঘটে সরাসরি। তাই বুকে সাহশ মনে বল কণ্ঠে শক্তি নিয়ে চিৎকার করে বার বার বলতে চাই -আমার যে মন্ত্রটিতে রয়েছে রাক্ষস দমনের অস্ত্র কোন কিছুর বিনিময়েই আমি তাকে র্দুবল হতে দিতে পারি না !

লেখক : মাজহারুল হক পিন্টু

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!