কবিতা-অকবিতা : ছন্দহীন কবিতা-ছড়া ও গান!

শাহ আলম বাদশা

Sharing is caring!

নাসরীন জাহানের কিছু গল্প নামের এই বইটি আমাদের প্রথম প্রকাশনা।

নাসরীন জাহানের কিছু গল্প নামের এই বইটি আমাদের প্রথম প্রকাশনা।

ছন্দ, মাত্রা, তাল-লয় না থাকলে কিসের কবিতা? মুক্তছন্দের নামে অন্ত্যমিলবর্জিত কবিতাও যে ছন্দহীন কবিতা নয়–তা বোঝেনা আজকালকার অনেক তথাকথিত কবি। আসলেই আবৃত্তির অযোগ্য কবিতা কখনোই ভালোকবিতা হতে পারেনা। ভালো কবি মানেই ভালো গীতিকার- এটাও সত্য। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখি, যারা যতোবেশি ছন্দে পণ্ডিত, তারা ততোবেশি ভালো ছড়াকার। আর পারদর্শী ছড়াকাররাই মূলতঃ মানোত্তীর্ণ ছড়া-কবিতা ও গানলেখায় পটু হয়ে থাকে।  প্রকৃত মানোত্তীর্ণ কবিতার আবৃত্তিও সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী হতে বাধ্য; আবার ছন্দহীন অকবিতার আবৃত্তি সুন্দর হতেই পারেনা। জোর করে আবৃত্তির চেষ্টা যতোই করা হোকনা কেনো?

ছন্দবিহীন কবিতা অনেক আগেও ছিল-একজনের এমন কথা শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম! আসলে ছন্দ কী, আগে আমাদের তা বুঝতে হবে? তার কথায় মনে হলো–ছন্দসম্পর্কে তার সঠিক ধারণা নেই। ছন্দছাড়া কবিতা-ছড়া-গান হয়না, হতেই পারেনা; এটা অনেকেই বুঝতে চাননা।

অনেকেই হয়তো অন্ত্যমিলকেই ছন্দ বলেন। কিন্তু কবি মধুসুদন দত্ত বলেছেন–শব্দে শব্দে বিয়ে (অন্ত্যমিল) হলেই কিন্তু কবিতা হয়না। এটাও সঠিক কথা। শুধু অন্ত্যমিল থাকলে তাকে বড়জোর পদ্য বলা যেতে পারে।

কবিতার ভাষা বা শব্দ ও বাক্য হতে হয় সহজ-সাবলীল। তবে কবিতায় কঠিন শব্দ থাকতেই পারে। কিন্তু তা হতে হয় ছান্দিক বা ঝংকৃত বা রিদমিক অথবা শ্রুতিমধুর শব্দ, যা কবিতার ছন্দসৃষ্টিতে সহায়ক হয়। যেমন- আধুনিক শব্দটা খুব শ্রুতিমধুর না হলেও এটি অন্ত্যমিলযুক্ত বা অন্ত্যমিবিহীন উভয় কবিতায় ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু আধুনিকতা  শব্দটা আদৌ কবিতার জন্য উপযুক্ত নয়। এ জাতীয় শব্দকে কবিতা-ছড়া বা গানে অবশ্যই  পরিহার করা দরকার। এজাতীয় শব্দ গদ্যের জন্য উপযুক্তমাত্র। নজরুল বা রবীঠাকুরসহ নামীদামী কবিদের কোনো ছন্দহীন কবিতা ছিলোনা। তবে গদ্যকবিতা বা মুক্তছন্দের কবিতা তাদের আছে, যা আবার ছন্দোবদ্ধতো বটেই।

আসলে ছন্দ জিনিসটা উপলদ্ধির বিষয়, দেখার জিনিস নয়। ছন্দের সাথে ভাষার ব্যাকরণেরও কোনো যোগ নেই। সুন্দর ও সাবলীল ধ্বনি, শব্দ এবং বাক্যের সাথে মাত্রা, তাল, লয়, উৎপ্রেক্ষা, রূপকতা ইত্যাদি মিলিয়ে গঠিত হয় ছন্দ। আর কবিতা-ছড়া-গান আবৃত্তি করলেই কানে অনুরণিত হতে থাকে একপ্রকার রিদম বা সুর যা হৃদয়কে ভাল্লাগায় নাচাতে থাকে–এটাই মূলতঃ ছন্দ। আবার ছন্দের আছে সুনির্দিষ্ট ও সুগঠিত একটা ব্যাকরণ বা নিয়ম।

একটা উদাহরণ দিলে ছন্দের ধারণা পরিষ্কার হবে-পিচঢালা মসৃণ রাস্তায় গাড়িচালাতে খুব আরামবোধ হয়, কোনো ঝাঁকুনি না থাকায় ঘুমও পায় যাত্রীর। এই যে আরামবোধ বা সুখানুভূতি-এটাই ছন্দ। এজন্যই গানের সুরে অনেকের ঘুম পায়। আবার এবড়োথেবড়ো, ভাঙ্গাচোরা বন্ধুর পথে গাড়ি চালিয়ে কি আপনি সেই সুখানুভূতি বা ছন্দ পাবেন? আপনি চরমভাবে বিরক্তিবোধ করবেন। এমনকি ঘুমালেও ঘুমভেঙ্গে গেলে রেগে যাবেন অবশ্যই।ছন্দহীন কবিতাপাঠেও পাঠকের তেমন বিরক্তি আসেই।  

আমরা ছন্দ না জেনেই অনেকেই কবিতা লিখতে গিয়ে অকবিতা লিখি, যা পাঠককে বিভ্রান্ত করে; কবিতাবিমুখ করে তোলে। এতে কবিতার দোষ নেই, দোষ হচ্ছে তথাকথিত কবির, যারা পত্রিকার কলামের আদলে স্রেফ কিছু বাক্যসাজিয়ে কবিতা লিখতে চায়। ফলে তা আর কবিতা হয়না যদিও দেখতে কবিতার মতো। অথবা বেশ দুর্বোধ্য শব্দসম্ভারে ভারী করে তোলে কবিতার শরীর, যা পড়তে ও বুঝতে চাইলে ডাকতে ইচ্ছে করে সেই কবিকেই।

আসলে ছড়া আর গানের ক্ষেত্রে কেউ কিন্তু ছন্দ বা ছন্দহীনতার প্রসঙ্গ কখনো আনেনা। সাক্ষর-নিরক্ষর সবাই যেনো জানেই যে, ছড়া ও গান বা সঙ্গীত ছন্দছাড়া হয়না। কিন্তু কবিতা শব্দটি এবং এর ইতিহাসের মধ্যেই ছন্দের বাধ্যবাধকতা এবং অপরিহার্যতা থাকলেও আমাদের পূর্বসূরি কিছু কবিই গদ্যছন্দ-গদ্যকবিতা বা মুক্তছন্দের আবিষ্কার করায় ঘটেছে এই বিভ্রাট।

যদিও তারাও কখনো বলেননি যে, গদ্যকবিতা হবে ছন্দহীন;তবুও আমাদের এই বিভ্রান্তির কারণে আজ কবিতার কোনো কদর নেই। অথচ একসময় আমরা দেখেছি হাটে-ঘাটে-বাজারে পয়ারছন্দে রচিত গেঁয়ো কবিদের কী হৃদয়গ্রাহী প্রেম বা লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনাসম্বলিত পদ্য? তারা তা ছাপিয়ে আবৃত্তি করেকরে বিক্রি করতো এবং তাদের ছন্দোবদ্ধ সেই কবিতার হৃদয়গ্রাহী আবৃত্তি শুনে আমরাও কিনে নিয়ে তা পড়তাম। এটা খুব বেশিদিনের কথা নয়, অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা। আর আজ সেই ছন্দের এবং কবিতার কী দুর্দিন! জানিনে কতদিন আর কবিতার ওপর চলবে এমন অন্যায়-অবিচার!!

আবার গদ্যকবিদের অনেকেরই বানানের দশা দেখে খুব হাসি পায় আমার। যারা ভাষা জানেনা, বাক্যগঠনে বেশ দুর্বল এমনকি শুদ্ধবানানসম্পর্কে উদাসীন, তারা কোন সাহসে কবিতা লিখতে আসে-এটা আমার বোধগম্য হয়না।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!

About the author

৮০ দশকের কবি, ছড়াকার, গীতিকার বিশেষত; শিশুসাহিত্যিক। ৬টি প্রবন্ধ সংকলন, ৩টি গল্প সংকলন, ১টি শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ, ৭টি অডিও-ভিডিও এলবাম প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশ রংপুর কর্তৃক ‘‘উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ ছড়াকার’’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ১৯৮৬ সালে সিলেট ছড়া পরিষদ কর্তৃক ছড়ায় অবদান রাখার জন্য পুরস্কৃত। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে সাংবাদিকতাছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা যেমন; লালমনিরহাট থেকে ত্রৈমাসিক চলমান, ত্রৈমাসিক ব্যতিক্রম, ত্রৈমাসিক দারুচিনি, ত্রৈমাসিক কিশোরকন্ঠ, ত্রৈমাসিক প্রজাপতিসহ (অধুনালুপ্ত) বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক এবং লালমনিরহাটের প্রথম প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক জানাজানি’র প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। শাহ আলমা বাদশা’র প্রকাশিত অডিও-ভিডিও এলবাম এবং গ্রন্থসমূহঃ ১। ভোরের পাখিরা [অডিও-ভিডিও এলবাম-১৯৮৯] ২। শিহরণ ১ ও ২ [অডিও এলবাম-১৯৯৩] ৩। শিহরণ ২ [অডিও এলবাম-১৯৯৩] ৪। প্রত্যয় [অডিও এলবাম-১৯৯৪] ৫। প্যারোডি গান [অডিও এলবাম-১৯৯৫] ৬। তথ্য পেলেন কাশেম চাচা [নাটিকার ডিভিডি-২০০১৪] ৭। তথ্য কমিশনের বিচারিক কার্যক্রম [প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি-২০১৪] ৮। কিশোকন্ঠ গল্প সমগ্র-১ [যৌথ গল্পগ্রন্থ-২০০১] ৯। মা ও শিশু [যৌথ প্রবন্ধগ্রন্থ [১খণ্ড)-২০০৬] ১০। মা ও শিশু [যৌথ প্রবন্ধগ্রন্থ [২খণ্ড-২০০৭] ১১। মা ও শিশু [যৌথ প্রবন্ধগ্রন্থ [৩খণ্ড-২০০৮] ১২। মা ও শিশু [যৌথ প্রবন্ধগ্রন্থ [৪খণ্ড-২০০৯] ১৩। স্বপ্ন দিয়ে বোনা [যৌথ গল্পগ্রন্থ-২০১৩] ১৪। মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য গল্প [যৌথ গল্পগ্রন্থ-২০১৫] ১৫। দুরছাই ধুত্তোরী ছাই [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৫] শাহ আলম বাদশা’র প্রকাশিতব্য গ্রন্থসমুহঃ ১। ইষ্টিপাখি মিষ্টিপাখি [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ] ২। ষড়ঋতুর দেশে [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ] ৩। লিন্তামনির চিন্তা [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ] ৪। ফুল-পাখি-নদী [কিশোর কবিতাগ্রন্থ] ৫। ফুলবনে হই-চই [কিশোর উপন্যাস] ৬। সানিনে অভিযান [[কিশোর উপন্যাস] ৭। কালো মুরগি [শিশুতোষ গল্প] ৮। বেওয়ারিশ লাশ [শিশুতোষ গল্প] ৯। কবিকবি ভাব ছন্দের অভাব [ছন্দপ্রকরণ-প্রবন্ধগ্রন্থ] ১০। বাংলাবানান এবং শব্দগঠনঃ ভুল শুধু ভুল [প্রবন্ধগ্রন্থ] ১১। আমাদের মুসলমানিত্ব এবং কামড়াকামড়ির রকমফের তিনি বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং এলএলবি'র ছাত্র। তথ্যমন্ত্রণালয়ে কর্মরত। ফোনঃ ০১৮১৭১১৭৯২৯/০১৫৫২৩৪২৪৪৯ Website: http://mediamaster1.blogspot.com/