আশরাফুর মোসাদ্দেক এর অনুপস্থিত শূন্য ও অন্যান্য হাইকু

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

haiku-cover‘শূন্য বৃন্তরা

কাঁদছে অর্কিড গাছ হতে

কিটেন টেলর নেই’

কিম্বা

‘অনুপস্তিত মালিক

প্রেম করে ঝুঁকিপূর্ণ

খেয়ালি কারখানা’

দুটো পঙতি। দুটোই হাইকু। ‘অনুপস্থিত শূন্য এবং অন্যান্য হাইকু’ নামের বইটি পেলাম ভাষামুখ প্রকাশনের টেবিলে। চমৎকার প্রচ্ছদ ও বাঁধাইয়ের শৈল্পিকতায় মুগ্ধ হয়ে বইটি হাতে নিতে বাধ্য হলাম। হাইকু সম্পর্কে শুনেছি, কিন্তু পড়া হয়নি। এটা কি জানিনা। তাই আগ্রহ নিয়ে পাতা উল্টালাম। সূচনাতেই পাঠকের জন্য এখানে লেখক আশরাফুল মোসাদ্দেক তুলে ধরেছেন হাইকুর সারসংক্ষেপ।

হাইকু-র সার সংক্ষেপ
হাইকু

হাইকু হলো অন্তমিলবিহীন ঋতুগত ধারণার বিষয়সহ এক প্রকারের জাপানি কবিতা যা পাঠকের মনে মানসিক প্রতিচিত্র স্থাপন করে। এটি তিন ধাপে ১৭ মোরায় বা পর্যায়ক্রমে ৫Ñ৭Ñ৫ মোরার পরিমাপের এককে গঠিত। এটি কিন্তু ১৭ সিলেবল নয়Ñ ১৭ মোরা। মোরা হলো একটু ভিন্ন ধরণের জাপানি ধ্বনির একক।  বৈশিষ্ট্যগতভাবে হাইকুতে কিগো বা ঋতুগত বরাত এবং কিরেজি বা কর্তন শব্দ থাকে।  সনাতনভাবে এতে কোনো রূপক বা হাস্যরস থাকে না এবং বর্তমান কালে রচিত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে জাপানি হাইকু একক উলম্ব চরণে লিপিবদ্ধ হয় কিন্তু জাপানি হাইকুর তিনটি বাক্যাংশের সমান্তরালে ইংরেজিতে সাধারণত তিন চরণে এটি আবির্ভূত হয়।
হাইকু একটি ছোট্ট জানালা যা দিয়ে অনেক বেশি কিছু দৃশ্য অবলোকন করা যায়। এটি হলো চিন্তাপ্রবণ কবিতা যা প্রকৃতি, রং, ঋতু, বৈপরীত্য এবং বিস্ময়কে তুলে ধরে। এটি কোনো বিশেষ মুহূর্তে প্রকৃতির কোনো অবস্থা, সংবেদন, ধারণা বা নাটকীয়তাকে প্রকাশ করে। হাইকু প্রায় সবকিছুই বর্ণনা করতে পারে যা পাঠককে সুপরিচিত কোনো বিষয়ে একেবারে নতুন কোনো অভিজ্ঞতার আস্বাদ দিতে পারে।
ইদো সময়ে (১৬০০Ñ১৮৬৮) মাস্টার যেমন মাতস্যুও বাশো (১৬৪৪Ñ১৬৯৪), ইওসা/তানিগুচি বুশন (১৭১৫Ñ১৭৮৩) এবং কোবাইয়াশি ইশা (১৭৬৩Ñ১৮২৭) একে হক্কু হিসেবে নির্দেশ করেছেন। দীর্ঘ কবিতা (রেংগা) শুরু হয় চমকলাগানো সূচনা দিয়ে (হক্কু) এবং জাপানি কবি মাতস্যুও বাশো এই সূচনাকে একটি স্বাধীন কবিতা হিসেবে বিকশিত করেন। তিনি যেন বৌদ্ধাদর্শের নৈতিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাইকুকে প্রায়শ হালকা আনন্দের জন্যে লেখা হাস্যরসাত্মক চরণ থেকে গভীর রূপে উত্তরণ ঘটান। ১৮৯২ সালে অন্য জাপানি মাস্টার মাসাওকা শিকি (১৮৬৬Ñ১৯০২) আনুষ্ঠানিকভাবে তংকা থেকে হক্কুকে আলাদা করেন এবং একক স্বাধীন কাব্য প্রকরণ হাইকুর জন্ম দেন।
হাইকুর ইতিহাস
নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে তংকা নামীয় জাপানি কবিতা জনপ্রিয় ও পরিশীলিত হয়ে ওঠে। ধর্মীয় বা বিনয়ী বিষয়ে ৫ লাইনে ৫Ñ৭Ñ৫Ñ৭Ñ৭ মোরা/সিলেবল কাঠামোতে প্রায়শই তংকা লেখা হতো। পঞ্চদশ শতাব্দীতে জাপানি কবিতার ধরণ রেংগা প্রস্ফুটিত হয়। রেংগা একটি কবিতা যা অনেকজন কবি যৌথভাবে রচনা করতেন। সদস্যরা পর্যায়ক্রমে ১৭ সিলেবল (৫Ñ৭Ñ৫ সিলেবল) এবং ১৪ সিলেবল (৭Ñ৭ সিলেবল) যুক্ত করতেন যতক্ষণ না তারা সাধারণত ১০০ চরণের কবিতা শেষ করতেন। ষোড়শ শতাব্দীতে হাস্যরসের কবিতা হাইকাই জনপ্রিয় হয়। হাইকাই এমন এক ধরণের কবিতা যা ১৭ ও ১৪ সিলেবল চরণে রচিত হতো রেংগার মতো কিন্তু তাতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে আধুনিক স্থূল হাস্যরসে সিক্ত হতো।
সপ্তদশ শতাব্দীতে মাতস্যুও বাশোকে প্রধান হাইকু কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রেংগা ও হাইকাই এর প্রথম চরণকে বলা হয় হক্কু। বাশোকে হাইকুর জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাশোর সময় হতে হক্কু স্বাধীন কবিতা হিসেবে আবির্ভূত হতে শুরু করে এবং হক্কুর সাথে গদ্য যোগ করে হাইবান এবং হক্কুর সাথে চিত্রকর্ম যোগ করে হাইগা প্রচলন হয়।
নোনোগুচি (হিনায়া) রাইয়ুহো (১৫৯৫Ñ১৬৬৯) হাইগার আবিষ্কারক। কিন্তু এটা বাশোর ভাবনার প্রকাশে একটা মূল অবয়ব হয়ে যায়। বুশন হাইগাকে আরো পরিশীলিত চিত্রকর্মের মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করেন। বাশো হলেন প্রাথমিক প্রখ্যাত হাইবান লেখক। তার সবচেয়ে বিখ্যাত হাইবান হলো ওকু নো হোসোমিচি অর্থাৎ দেশাভ্যন্তরের সরুপথ। ঊনিশ শতাব্দীর শেষভাগে মাসাওকা শিকি একে এর বর্তমান নাম হাইকু হিসেবে নামকরণ করেন। তিনিই হক্কুর নাম হাইকু রাখেন।
কিরেজি ও কিগো
জাপানি হাইকুতে কিরেজি হলো কর্তিত শব্দ এবং একে প্রকৃতভাবে সক্সগায়িত করা খুব কঠিন। এটি কবিতাকে দুটো ভাগে ভাগ করে। জাপানি হাইকুতে কিরেজি থাকা সুনির্দিষ্ট কিন্তু ইংরেজি হাইকুতে যতিচিহ্ন হিসেবে ছেদচিহ্ন বা শব্দ বর্জনকে এর সমতূল্য হিসেবে বিবেচনাপূর্বক ব্যবহার করা হয়। সাধারণত একই ধারণার প্রথম দুই চরণের সাথে হঠাৎ লাফিয়ে অন্য ধারণায় গিয়ে কবিতার সমাপ্তি টেনে বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি করা হয়। এই পদ্ধতিকে কর্তন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কিগো হাইকুর জন্যে আবশ্যক একটি শব্দ বা বাক্যাংশ যা কোনো ঋতুকে প্রকাশ করে। এটি হতে পারে কোনো প্রাণী, বৃক্ষ, ঘটনা, প্রথা অথবা অন্য কোনো ঋতু নির্দেশক শব্দ। রংও ঋতুর নির্দেশক হিসেবে ব্যবহারের জন্যে ফলপ্রসু উপাদান এবং আবেগ সৃষ্টিতে সক্ষম। সবচেয়ে জনপ্রিয় উল্লেখযোগ্য বরাতের জন্যে কিগোর বই হলো সাইজিকি যাকে চারটি ঋতুতে ভাগ করা আছে। সাইজিকি হলো এক ধরণের অভিধান যা লেখককে ব্যবহারযোগ্য কিগোর বর্ণনাময় শব্দাবলীর তালিকাভুক্ত করেছে।

আধুনিক হাইকু
আধুনিক হাইকু মৌল ৫Ñ৭Ñ৫ সিলেবল বা মোরার নীতিতে অবিচল থাকে না কারণ বিভিন্ন ভাষার ধ্বনিতত্ব বিভিন্ন ধরণের। সিলেবল সব ভাষায় একই দৈর্ঘ্যের হয় না এবং তাই তাকে সমন্বয় করা হয়। সনাতন জাপানি হাইকু কঠোর ধারণার ও পরিমাপের নীতির উপর দাঁড়িয়ে থাকলেও আধুনিক হাইকু সম্প্রসারিত করেছে কবিতার ধরণকে জীবন এবং সময়কে স¤পৃক্ত করতে। আধুনিক হাইকু কখনো সিলেবল গণনায় শিথিল বা দেখতে ছোট-বড় হতে পারে; অনেক সময় যার কেন্দ্রবিন্দু রূপক, হাস্যরস, অন্তমিলের কিংবা অপ্রকৃত চিত্রকল্প কেন্দ্রিকও হয়ে থাকে।
‘বাহুতে মশা
আঙ্গুলে ঘুরছে কী-র্বোড
সুশীতল শোষণ’

ইংরেজি হাইকু
জাপানি হাইকুর ইংরেজিতে অনুবাদ প্রথম থেকেই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। হাইকুর কঠোর ধরণ বা পরিমাপ ঠিক রেখে হবহু অনুবাদ অর্জন করা প্রায় অসম্ভব কারণ দুই ভাষার ধ্বনিতত্বের পার্থক্য এর কারণ। ইংরেজি ভাষায় কিরেজির সমতূল্য কোনো কিছু নেই, যা কিনা শব্দ কর্তন। ইংরেজি হাইকুতে কিরেজি যতিচিহ্ন হিসেবে ছেদচিহ্ন বা শব্দ বর্জনকে ধরা হয়। কিগো জাপানি সংস্কৃতিতে ঋতু ও প্রতীকী হিসেবে গভীরভাবে প্রসারিত আছে। ইংরেজি হাইকু লেখকরা সংযোজিত করেন তাদের নিজের সংস্কৃতি এবং স্থানীয় অবস্থা সমজাতীয় প্রভাবের জন্যে। পৃথিবীর সবস্থানেই ঋতু প্রায় একই ধরণের কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রতীক, ধারণা বা বৃক্ষ ও প্রাণীর প্রজাতির মধ্যে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের পার্থক্য রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হাইকু পশ্চিমে উপস্থাপিত হতে শুরু করে যেমন ফ্রান্সের লেখক পল লুইস কোচোদ তা করেন। ১৯৫০ এর দশকে পশ্চিমা পৃথিবীতে হাইকু      বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয় হেরল্ড জি হেন্ডারসন এবং আর এইচ ব্লিথ এর অনুবাদ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। বীট সময়ে আমেরিকায় আদি ইংরেজি হাইকু লেখা হয় বীট জেনারেশনের কবিদের দ্বারা যেমন জ্যাক কেরোয়াক এবং রিচার্ড রাইট। ১৯৬৮ সালে আমেরিকার হাইকু সমিতি গঠিত হয় এবং তার ১০ বছর পর জার্নাল ফ্রগপন্ড প্রকাশিত হয়। আমেরিকান হাইকু আর্কাইভ ১৯৯৬ সালে স্থাপিত হয় যা হাইকু কবিতার সবচেয়ে বড় পাবলিক আর্কাইভ এবং এ সম্মন্ধীয় বিষয়বস্তুর আধার হিসেবে পশ্চিমে পরিগণিত হয়েছে।

‘মগজে বন্দিু
এক প্রশ্বস্ত নটেওর্য়াক
মগজ বন্ধুত্ব’

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!