আমাদের নাট্যভূমি এবং নাটক উদ্বাস্তুর চারশতক : মাজহারুল হক পিন্টু

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

03

নাটক উদ্বাস্তুর একটি দৃশ্য

১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শেষে নাট্যজগত তখন ব্যস্ত নতুন ভাবনার খোঁজে। নাট্যাঙ্গন তখন সহস্র নাট্যকর্মীর পদভারে মুখর। নাট্যকর্মীরা তখনো বানিজ্যিক মনোভাবে ডুব দেয়নি। নাট্যকর্মীদের আন্তরিক আড্ডা তাই বিস্তৃত টিএসসি থেকে বেইলি রোড, টিএসসি থেকে পুরনো ঢাকা। আমি তখন দল ভাঙ্গাগড়ার ঘূর্ণিপাকে পড়ে গণছায়া হয়ে শিকড় চলচ্চিত্র কর্মশালা, কমিউন থিয়েটার হয়ে থিয়েটার ইউনিট নামক নাট্য সংগঠনে যুক্ত। এখানে চার বছর কাজ করার পর মত পার্থ্যক্যের কারণে বেরিয়ে এলাম। আমার সাথে বেরিয়ে এলো পুরনো সহকর্মীদের মধ্যে জয়শ্রী গোমেজ ও সেলিম খান বাবু। সাথে এলো বেশ কিছু নতুন টগবগে নাট্যকর্মী। এরপর কোনো নাট্য সংগঠন করব কিনা বা কোনো সংগঠনে কাজ করব কিনা অথবা এ জগত থেকে সরে যাব। এই ভাবনার শেষ প্রান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র বারান্দায় বসে প্রতিদিনই নাটক নিয়ে চলে আলাপ আলোচনা। সবার ভেতরই ইচ্ছে আছে নতুন সংগঠন করার। আবারা ভয়ও আছে, যদি না টেকে? অবশ্য ইচ্ছারই জয় হয় শেষপর্যন্ত। ১৯৯৪ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি জন্ম নিলো নতুন নাট্য সংগঠন ‘ইউনিভার্সেল থিয়েটার’।

শুরু থেকেই চিন্তাভাবনা ছিলো এমন একটা কিছু করার যাতে আমাদের কার্যক্রমটা নিয়মিত হয় কারণ নাটক করতে গিয়ে আমাদের উপলব্ধি হচ্ছে এ এক বিশাল অভিজ্ঞতার জগত। যে এর সাথে যুক্ত না হয়েছে তাকে সেটা বোঝানো অসম্ভব।
সবচে মজার বিষয় ছিলো মহড়া করার বিষয়টি। তাদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা ছিলো না। দলের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলগুলো এবং ব্যাঙের ছাতার মত আবৃতি সংগঠনের আবির্ভাবের কারণে টিএসসিতে রুম পাওয়া সহজ ছিলো না। তাহলে আবার মাস্তানি করতে হতো। অনেক সংগঠনই যেটা করেছে। সুতরাং আমাদের জায়গা ছিলো টিএসসির সুইমিংপুল, গ্যারেজের বারান্দা। আবার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো অনুষ্ঠান থাকতো তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা রমনা পার্কের উন্মুক্ত প্রাঙ্গন।
02
এভাবেই একদিন রমনা পার্কে সন্ধ্যাবেলা মহড়া করতে গিয়ে শতায়ূ অঙ্গন মঞ্চটি আমাদের চোখে পড়ে। পাকিস্তান আমলের কোনো একসময় রানী এলিজাবেথ ঢাকা এসেছিলেন। তাঁকে সম্বর্ধনা জানানোর জন্যই রমনায় মঞ্চটি নির্মাণ করা হয়। তখন এর নাম ছিলো এলিজাবেথ মঞ্চ। এই মঞ্চটি আমাদের পথ চলার প্রত্যাশা যেন আরো বাড়িয়ে দিলো। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রতি শুক্রবার এখানে নাটক করব। যেই কথা সেই কাজ। ১৯৯৪ এর জুন মাস থেকে শুরু হলো আমাদের অসীম পথচলা। দলের প্রথম পথনাটক ‘অন্তর বাজাও’ অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঝলসে ওঠা এক বাউলের কথকতা। বেশ জনপ্রিয়তা পায় নাটকটি।  রমনা পার্কে ছুটির দিনে বেড়াতে আসে নানা পেশা এবং নানা শ্রেনীর মানুষ। এই নিয়মিত সাপ্তাহিক বিনোদন তারা গ্রহণ করেন সানন্দে।

এ এক অন্যরকম প্রাপ্তি আমাদের। উদ্দেশ্যের সফলতা ছিলো আমাদের কাছে অনেক বড় যে কারণে প্রচারনার দিকে খুব একটা উৎসাহ আমাদের ছিলো না। তারপরও সংগঠনের কর্মী সাংবাদিক আরিফ আহমেদ, বন্ধু সাংবাদিক ম. আ সালাম স্বত:প্রণোদিত হয়ে প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত একটানা প্রতি শুক্রবার আমরা নাটক প্রদর্শন করে এসেছি রমনা পার্কের ছায়াঘেরা মঞ্চ শতায়ু অঙ্গনে।

জীবিকার তাগিদে দলের কর্মীরা যখন নানা পেশায় যুক্ত হলো তখন আর নতুন কর্মী তৈরি না হওয়ায় অনিয়মিত হয়ে পড়লো এ কার্যক্রম। ৯৪ সাল থেকেই দলের কর্মীদের উৎসাহে প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার পার্কে একটা স্কুল খোলা হলো। যে সব টোকাই ছেলেমেয়ে নাটক দেখতে আসতো ওদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো। বছর দুয়েক চলার পর অর্থসংকটের কারণে বন্ধ করে দিতে হয় স্কুল। কিন্তু নাটক চলতে লাগলো।

১৯৯৫ এর অক্টোবরে আমরা শুরু করলাম মঞ্চনাটকের মহড়া। চিররঞ্জন দাশের এক অনবদ্য রচনা ‘পৃথিবীর জন্যে’ নাটকটি দিয়ে শুরু হলো আমাদের মঞ্চনাটকের যাত্রা। তারপর একে একে ‘অন্তর বাউল’ বিষক্ষয়, ধূসর তীর্থ। তবে সবসময় পথনাটকই ছিলো আমাদের ভালো লাগার জায়গা।

১৯৯৮ সালে শতায়ু অঙ্গনে দলের প্রথম পথনাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার অনেকগুলো নাট্যদল তাতে অংশগ্রহণ করে। তবে স্মরণযোগ্য নাট্যোৎসব ছিলো ২০০১ সালে একদিনের নাট্যোৎসব। ‘অবিরাম পথনাট্যের অর্ধযুগ অতিক্রান্তে’ শ্লোগানে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আয়োজিত এ উৎসবের উদ্বোধন করেন নাট্যবিদ সাঈদ আহমেদ। সে সময় বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকবার আমরা তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। চমৎকার একজন মানুষ। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।

‘উদ্বাস্তু’ নাটকটি দলকে টিকিয়ে রেখেছে বহুদিন। এ পর্যন্ত দলের সবগুলো নাটকের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক প্রদর্শনী হয়েছে এ নাটকটির। কোনো এক পার্ক। দুই ছিন্নমূল মানুষের গভীর সম্পর্কেও বন্ধন এই পার্ক ঘীরে। তাদেও এই বন্ধনে কীভাবে চিড় ধরায় একজন উচ্চ শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধি। এাঁই এ নাটকের উপজীব্য। এ নাটক এমনও হয়েছে যে, বহুবার দর্শক দেখেছে তারপরও আগ্রহ নিয়ে বার বার দেখেছে অনেকে।

সেই কবে গোড়াপত্তন হয়েছিলো রাজধানী ঢাকার। আজ তার বয়স চারশ’ বছর পূর্ণ হতে চয়েছে। সময়ের শকটে চড়ে পার করে এসেছে কত ঘটনা, রটনা, ক্ষমতার পালাবদল, বেঁচে থাকবার সংগ্রাম। এখনও টিকে আছে সে। চারশ’ বছরের পুরনো এই গর্বিত নগরীর বুকে শত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমরাও টিকে আছি। আমাদের সাথে আছে ‘উদ্বাস্তু’। যার চারশ’ তম প্রদর্শনী হয়ে গেল। একটা কথা আমরা সবাই জানি যে, কোনো কিছু ভাঙা সহজ কিন্তু গড়া কঠিন। মুহুর্তের মধ্যে কোনোকিছুই গড়ে ওঠে না। সময় লাগে পরিকল্পনা লাগে। রাজধানীর বুকে একটি নাট্য সংগঠন গড়ে তোলা এবং টিকিয়ে রাখা কত কঠিন, যারা করে তারা বোঝে। হুট করে বললেই হয়ে যায় না। পাড়ার নাটক করতেও তো সময় লাগে। সিদ্ধান্ত নেয়া, লোক যোগাড় করা, নাটক বাছাই করা এমন বহু পদ্ধতি পার হয়ে তারপর একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। সেখানে নিয়মিত নাটকে অংশগ্রহণ করা তো আরো কঠিন বিষয়। তারপরও যারা অনেক কষ্ট স্বীকার করেও নাটক করেন তাদের প্রতি রইল আমার সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

ইউনিভার্সেল থিয়েটার নামক একটি নাট্যদল যার হয়তো ব্যাপক কোনো পরিচিতি নেই বা এ নিয়ে দল কখনো মাথা ঘামায়নি। কাজটা করতে পারাই আনন্দের। যাদের জন্য নাটক করা সেইসব সাধারণ মানুষেরা নাটক দেখে। দলের কর্মীরা সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। সংগঠনের সেই কৃতিকর্মী রমিজ মালিক, শওকত আলী মনসুর রিয়াদ. স্বপন চন্দ্র দাস, আজিজুল পারভেজ, আরবি রাজাসহ আরো কিছু সক্রিয় কর্মী যারা দীর্ঘ সময় ধরে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সংগঠনের জন্য। উদ্বাস্তুকেও যারা এতদুর টেনে এনেছেন আন্তরিকভাবে। এই সহকর্মী এবং বন্ধুদের  প্রতিও আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

লেখক : মাজহারুল হক পিন্টু, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!