আবৃত্তির নয়া দিগন্ত : তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদ

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

IMG_20131129_192800658

কণ্ঠশীলন এর নরেন বিশ্বাস পদক প্রদান অনুষ্ঠনের একটি দৃশ্য।

আবৃত্তির নয়া দিগন্ত-
তারিক সালাহউদ্দিন মাহমুদ

আবৃত্তি শিল্পের ইতিহাসটি যেমন অতিপ্রাচীন তেমনি এর বৈভব বিচিত্র গভীর এবং অসাধারণ। মানুষের বাকপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার মধ্য দিয়েই বস্তুত আবৃত্তিকলার যাত্রা শুরু। অতপর আদিম সাম্যবাদী সমাজ ধর্মীয় স্বর্ণযুগ এবং হালে বর্জুয়া সমাজের ভিতর দিয়ে আজকের আবৃত্তি শিল্পের আত্মপ্রকাশ। তার অত্যশ্চার্য কথা এই যে, প্রাণশক্তি নিয়ে আদি আবৃত্তির যাত্রা শুরু তা জগতের লোক আবৃত্তি একটি ীণ অবশেষ রা করলেও আধুনিক আবৃত্তিতে তা পুরোপুরি লোপ পায়। ফলতঃ আধুনিক আবৃত্তি আর শিল্প নয় বরং কণ্ঠ উৎসারিত কবিতা মাত্র। এতে নেই ভাব আবেগ এবং শিল্পের অন্যান্য প্রয়োজনীয় গুণাগুণ। যেন আবৃত্তি আজ দিনগত পাপয় করে চলেছে। অবাক এই শিল্পের আজ এই হাল দশার কারণ কি? আর কিভাবেই বা এতে আমরা অতীতের বিস্ময়কর আবৃত্তির একটি আধুনিক রূপ দিতে পারবো সেটাই আমাদের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।
পৃথিবীর সর্বত্র যে আধুনিক আবৃত্তি তা কবিতার ফর্মকে মাত্র আবৃত্তি করে। কবিতার বিষয় যা কিনা শিল্পকলার ভিত্তি তা আবৃত্তি কালে লোপ পায়। একারণে বিষয়হীন সুতরাং বিষয়গত ভাব আবেগ ভাষা অলংকরণহীন এক বৈর্বব্যজনিত আবৃত্তিকে আজ আমরা সম্মুখে দেখছি। তা কদাচ শিল্প নয় শিল্প হতে পারে না।
আধুনিক আবৃত্তি কেন শিল্প নয় তার একটা সংপ্তি ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। আধুনিক আবৃত্তি কবিতার সাধারণ ভাষার যান্ত্রিক ব্যবহার কবিতার ছন্দ এবং শব্দ সংগীত একান্ত বিষয় জ্ঞান করে বলে আবৃত্তিকার কবিতার বিষয়বস্তুকে স্পর্শ করতে পারেন না। যেহেতু আবৃত্তিকার বিষয়ে যেতে পারেন না সেই হেতু বিষয় জনিত ভাব আবেগ মনে সৃষ্টি হয় না যা Communication এর উপায়।
বস্তুত আধুনিক আবৃত্তিতে Communication বা আত্মীয় সংযোগের কোন উপায় নেই। যা কিনা শিল্পকলার প্রধান শর্ত- বিষয়গত ভাব আবেগ চিন্তা চেতনা ইত্যাদি। অপরদিকে প্রকৃত আবৃত্তির ধরণটি  কি? তা প্রাচীনকালের আবৃত্তির একটি উদাহরণ যোগে ব্যাপারটি উপলব্ধি করা যাক –
“যখন আমি দুঃখজনক কোন কিছুর বর্ণনা করি
তখন  আমার দুচোখে অশ্র“তে ভরে যায়
যখন ভয়ংকর বা অদ্ভূত কিছু বলি তখন
আমার চুল খাড়া হয়ে যায় এব বুক
ধুকধুক করতে থাকে যখন আমি পাটাতন থেকে
দর্শকদের দিকে তাকাই তখন দেখি তারা
যা শুনছেন তাতে তারা ভাবাবিষ্ট হয়ে কাঁদছেন।”

এ হ’ল আদিকালের আবৃত্তির একটি ধরণ। এরকম সংখ্যাতীত আবৃতির খোঁজ পাওয়া যাবে যা প্রাচীনদের আনন্দযোগে স্বজ্ঞান সচেতন করে তুলতো। আমরা একালে এবম্বিধ আবৃত্তির কথা ভাবতে পারি? কল্পনাতেও? যা কিনা শ্রোতৃমন্ডলীকে মংগলে আসক্ত অমঙ্গলে বীতস্থত করতো।
আজ এই অবয় আক্রান্ত কাল বেলায় মানুষকে জাগাতে সেই পুরান দিনের আবৃত্তির পুনরাবৃত্তি বিকাশ প্রশ্নাতীত আবশ্যক। সেটা কি সম্ভব?
শাস্ত্র বলে- “আবৃত্তি সর্বশাস্ত্রানাং বোধাদপি গরিয়সী”
সকল শাস্ত্রের চেয়েও আবৃত্তির গৌরব অধিক। এতে কোন সংশয় নেই। আমরা যদি যথার্থ আবৃত্তি সৃষ্টি করতে পারি আদিকালের আবৃত্তির মত এবং দিতে পারি তার উপর একটি নতুন মাত্রা তবে অতি অবশ্য আসকর দিনে পেছনে পড়ে যাওয়া আবৃত্তি শিল্প সম্মুখ সারিতে এসে দাঁড়াতে পারবে। আমরা নেতার নেত্রীকরণ এই তত্ত্ব যদি আবৃত্তিকলায় প্রয়োগ করি তবে এমন একটা ফল লাভ করবো যা আদিকালের আবৃত্তিকেও অতিক্রম করে আবৃত্তি জগতে ঐতিহাসিক একটি নতুন মাত্রা লাভ করবে। একথা বস্তুবাদী আবৃত্তি তত্ত্ব বইতে বিশদভাবে বলা হয়েছে, কি না আধুনিক আবৃত্তির খোল নলচে সাকুল্যে পাল্টিয়ে ফেলতে হবে এবং পত্তন করতে হবে বস্তুবাদী বাদ্বান্বিক বস্তুবাদী আবৃত্তির।

আধুনিক আবৃত্তির সংকট এর ভাষা সমস্যাজনিত। আধুনিক আবৃত্তির নিজস্ব কোন ভাষা ব্যবস্থা নেই। তা কবিতার ভাষায় কাজ করে। এতে এমনকি কবি বাণীও তার সার্থকতা হারায়। আধুনিক আবৃত্তির যেহেতু ভাষা নেই সেই হেতু এতে মনের ভাব আবেগ চিন্তা চেতনা ইত্যাদি প্রকাশ পায় না। কেননা ভাষাহীনতার কারণে সত্ত্বার প্রকাশ কি করে সম্ভব? এ জন্যেই কবিতার বিষয়বস্তু আবৃত্তি কণ্ঠে এসে নিস্ফল হয়ে যায়। আধুনিক আবৃত্তিতে যা কিছু শুনি তা বিসয় সম্পর্কহীন মনগড়া শূন্যগর্ভ কৃত্রিম ভাব প্রবাহ। সেই হেতু তা লোকের মনে ক্রিয়া করে না তাই কাজের কাজ লোকজাগরণ সম্ভব হচ্ছে না।
অন্যদিকে বস্তুবাদী আবৃত্তির ভাষা সমস্যা নেই কবিতার শৈলী  জনিত কোন প্রতিবন্ধকতাও নেই তাই তা ভাব আবেগ চিন্তা চেতনা সবলীলায় প্রকাশ করতে পারে। বস্তুবাদী বা নতুন কালের উপযোগী নতুন ধারার আবৃত্তির ভাষা ব্যবস্থাটি কি আকারের হবে তা এবার দেখা যাক।
মনে রাখা দরকার যে আধুনিক আবৃত্তির ভাষা উচ্চারণ অনুক্রিয়া বাদী। তাতে সচেতনভাবে উচ্চারণ করা হয় না। তার আধুনিক আবৃত্তির ছন্দ কবিতারই ছন্দ আর ভাব আবেগ হয় কৃত্রিম।
কিন্তু বস্তুবাদী আবৃত্তির বা নতুন ধারার আবৃত্তির উচ্চারণ হয় সচেতন ভাবে এর আবেগ নৈসর্গিক এবং ছন্দ আবৃত্তির নিজস্ব ছন্দ। সুতরাং সচেতন উচ্চারণ আবেগ এবং আবৃত্তির নিজস্ব ছন্দকলা যোগে সৃষ্টি হয় আবৃত্তির ভাষা। এই ভাষা নিখুঁত ভাবে মনের ভাব প্রকাশে পারংগম। আর আবৃত্তির যদি স্বাধীন নিজস্ব ভাষা থাকে তার অথর্ৎ যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে ভাবাবেগ প্রকাশ করা যাবে আদিকালের আবৃত্তির মত।
বস্তুবাদী বা নতুন ধারার আবৃত্তির আরো নানা কথা আছে তা আমরা ক্রমে প্রকাশ করবো। আজ এই ছোট পরিসরে আর তেমন কথা বলছি না। তা হ’লে কথা দাঁড়াল আমাদের আবৃত্তির ইতিহাস বিস্তৃত ও বৈভবপূর্ণ। কিন্তু আধুনিক আবৃত্তির কোন জ্যোতি নেই। তা আমার ভিত্তিহীন নতুন ধারার আবৃত্তি পত্তন করতে হ’লে ঐতিহাসিক আবৃত্তির পুনরাবৃত্তি বিকাশ ঘটাতে হবে, যা আমরা আবৃত্তির ভাষার মাধ্যমে সম্ভব করতে পারি। তা হ’লে দুনিয়া জোড়া আবৃত্তি এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। তাতে সমাজ জেগে উঠবে এবং কবি  কথা সার্থক হবে।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!