হাজার বছরের বাংলা সংগীত ও নন্দনতত্ত্ব : কমল খালিদ

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

Bf-khalidবেঙ্গল শিল্পালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সংগীত অবয়ব’ শীর্ষক কর্মশালায় ‘হাজার বছরের বাংলা গান – সংগীত ও নন্দনতত্ত্ব’ বিষয়ে (ধবংঃযবঃরপং ড়ভ সঁংরপ) দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন সংগীত গবেষক ও শিল্পী শেখ খালিদ হাসান (কমল খালিদ)।  তিনি বলেন, মাত্র নব্বই বছর আগেও বাংলার আদি গ্রন্থ সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিলনা। ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থাগার থেকে ‘চর্যাচর্য বিনশ্চয়’, ডাকার্ণব ও দোহাকোষ নামক ৩টি পূঁথি সংগ্রহ করেন। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে পূঁথি ৩টি একত্রে সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হয়। এই চর্যাচর্য বিনশ্চয় গ্রন্থটিই চর্যাপদ। ৯৫০-১২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে চর্যাপদ রচিত হয়ে থাকবে বলে অনুমান করা হয়। চর্যার ভাষা কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা অর্বাচীন, আলো অন্ধকারের মত। তাই এ ভাষা কে সান্ধ্য ভাষা বলা হয়।
খালিদ জানান, চর্যায় মোট ৫১ টি পদ রয়েছে। যার মধ্যে মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি  খুঁজে পাওয়া যায়। চর্যাপদের রচয়িতার সংখ্যা ২৩ জন। গীত রচয়িতারা প্রত্যেকেই ছিলেন সিদ্ধাচার্য। চর্যা সম্পর্কে বিশদ বিবরণের পর ক্রমান্বয়ে নাথগীতিকা-গোরক্ষনাথ ও মীননাথের কাহিনী, কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ঞ কীর্তন, বৈষ্ঞব পদাবলী, মঙ্গলগান, শাক্তগীতি, ব্রহ্মসংগীত, বাউল গান, পালাগান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেন তিনি।
এয়াড়াও তিনি সংগীতে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে ক্রমান্বয়ে মার্গ বা শাস্ত্রীয় সংগীত ও দেশি সংগীত সম্পর্কে আলেচনা করেন। এ্যাসথেটিকস অর্থ বোধ ও অনুভব। এ্যাসথেটিকস হল বিক্ষণ শাস্ত্র। সংগীত নান্দনিক শিল্প আর এ্যাসথেটিকস হল তার অন্ত:নিহিত তত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্যমূল্য, সুরের ব্যঞ্জনা, নির্ণয়ের বিক্ষণ শাস্ত্র। এ্যাসথেটিকস অন্য অর্থে  ড়হব যিড় ঢ়বৎপরবাব যিনি প্রত্যক্ষণ করেন।  সংগীতের অবয়ব, দৃশ্যপট, সংগীত ইমাজিনেশন ও শিল্পবোধ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন কমল খালিদ।
শেখ খালিদ হাসান বলেন, অসীম যেখানে সীমার মধ্যে সেখানে হয় ছবি, অসীম যেখানে সীমাহীনতায় সেখানে গান। এ সময় তিনি রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতের বাণীর বোধ ও বাংলা লোকসংগীতের পরিবেশ, ভাব ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে আলোচনায় বলেন, বাংলায় সূফিদের আগমন বাংলা সংগীতকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। সংগীতে এই আধ্যাত্মিক ভাব, দেহতত্ত্ব আর কোন দেশে নাই। মানুষ, মানবতা ও প্রেমই ছিল সূফিবাদের মূল দর্শন।  বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে শ্রেণী বৈষম্যের শিকার হয়েছে শতশত বছর ধরে নি¤œবিত্তের মানুষ। আমরা উচ্চবর্ণের হিন্দু হয়ে নি¤œবিত্তের হিন্দুকে ঘৃণা করছি। ক্রমান্বয়ে নিগৃহীত হতে হতে বৌদ্ধ সহজিয়া থেকে বৈষ্ঞব ও বাউল এসেছে। সূফিদের দর্শন ও ভালবাসায় মুগ্ধ হয়ে এই পতিত মানুষ সেদিন নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছিল যেখানে জাত-পাত, ধর্ম  কিছু নেই।
শেখ খালিদ সূফি দর্শন সম্পর্কে আলোচনায় খুলনা অঞ্চলের সূফি সাধক শাহ্ হাসান এর লেখনী তুলে ধরেন। যেখানে রয়েছে ধর্মের উর্দ্ধে প্রেমের জয়গান। ”মযহব মেরা হ্যায় মোহাব্বাত ম্যায় উসকো মাশুক বানা লিয়া।”, ঈশ্বর, আল্লাহ বা অধর চাঁদের সন্ধানে শাহ্ হাসান বলেন, ”খোদাকো ঢুঁন্ডনে ওয়ালে সুনো- ম্যযহার কাহা আল্লাহ্/ হাকিক্যত জিসমে আদম হ্যয় এহি- হ্যয় খাস ব্যায়তুল্লাহ্”  সূফি এই দর্শনই লালন সাঁইজির গানে রয়েছে – ”কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা দেখায় আসমানে- আপন মনে কে কথা কয়, না বুঝে আসমানে তাকায়”। রবীন্দ্রনাথের গানে ” আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি/ বাহির পানে চোখ মেলেছি আমার হৃদয় পানে চাইনি”। নজরুলের ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন খুঁজি তারে আমি আপনায়’। বাংলা গানে সূফি দর্শনের অনুপ্রবেশ বাংলা সংগীতকে করেছে ঋদ্ধ। নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে এই ভাব ও আধ্যাত্মিকতা বাংলা সংগীতকে দিয়েছে বিশ্ব সংগীতে অন্যতম স্থান।
বি:দ্র: কমল খালিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!