বাংলার সেরা কবিতাঃ কুড়ি গুণন তিন

সাহিত্য বাজার

Sharing is caring!

ফরিদ আহমদ দুলাল এর কবিতা

এক

নির্ভরতার মূল্য

নির্ভরতার মূল্য দিলাম জীবনের প্রতিদিন
গোপনে আকাশ পাঠালো মেঘের কিছু অশোধ্য ঋণ,
মেঘবালিকার কোমল সুষমা জড়ায় গ্রীবার বাঁকে
সে দৃশ্য দেখে পাহাড়-দুহিতা মুখ কালো করে থাকে;
নির্ভার নদী একা বয় স্রোতে ঢেউ দিয়ে কথা কয়
হৃদয়ের কথা অনুচ্চারিত তবু সন্তাপ নয়;
মনস্তাপের পরকীয়া পাপে আগুন যদিও জ্বলে
বুকের আগুন নেভাতে মনের আকুতিরা কেঁদে চলে;
নির্ভরতায় দিন কাটে যদি নিশি জাগরণ দায়
প্রণয়ের কথা আকুল পখিরা বলে ছুঁয়ে রাঙা পায়।

শর ছেঁড়া তীর হাতে অর্জুন কাছাকাছি আসে যদি
মিথ্যা-কুহকে ভয় পেয়ে ভুলে উজানে যায় না নদী
মেঘবালিকার অভিমান হয়ে বারিধারা ঝরে মনে
লজ্জাবতী সে পাহাড়-দুহিতা একাকী হারায় বনে
বনের নিরলে মন-বন্দনা মন-বিনিময় কলা
নির্ভরতার দু’চোখে দেখেছি স্বপ্নের ষোলকলা;
চৌষট্টিকলা স্পর্শানন্দ চায় শুভ বাতায়ন
স্বপ্নবাসর রচিবারে চায় পুষ্পিত চন্দন।

দুই

ক্ষমার অযোগ্য আমি

ক্ষমার অযোগ্য আমি তবু ক্ষমা চাই
রিপুর বাতাসে নড়ি লালসার গন্ধে ছুটে যাই
ভনিতার নির্মোহ প্রকল্প খুলে সুনাম কুড়াই
প্রয়োজনে পরিপার্শ্বে সামান্য ঋদ্ধির খুদ-কুড়া-খাবার ছড়াই
আলোয় বসত করি অধিকালোর সন্ধান পেলে দু’হাত বাড়াই
ক্ষমার অযোগ্য আমি তবু ক্ষমা চাই।
স্বার্থান্ধতা মোহ হয় মেকি বিভার আলোক-ফানুস ওড়াই
যজ্ঞের আগুন জ্বেলে প্রকাশ্য পাপের পুতুল পোড়াই
প্রণয়ের প্রতারণা দিয়ে প্রেয়সীকে ঘুড়ি করে আকাশে ওড়াই
ঘুড়িটি আকাশে ওড়ে গোত্তাখায় যত্নে রাখি গোপন নাটাই;
‘ক্ষমাই মহত্ত’ এ আপ্তবাক্যের সুষমা শোনাই;
ক্ষমার অযোগ্য আমি তবু ক্ষমা চাই।

অপেক্ষার ছিপ ফেলে বসে থাকি পুকুরের পাড়ে
সংবেদী পাতাকাঠিটি যদি মাছেদের কেউ নাড়ে
হঠাৎ উৎসবে জমে যেতে পারে মাছের শিকার
তৃষিত জীবনে জ্বলে বঞ্চনানল রিপুর নিত্য ক্ষুধা চিত্তের বিকার;
মাছ-পাখি-ভোগ্যপশু এবং নারীকে নিয়ে বার্বিকিউয়ে যাই
ক্ষমার অযোগ্য আমি তবু ক্ষমা চাই।

তিন

কামাসক্তি

শরীর যদি না জাগে কবি সৃষ্টিহারা
আত্মসংযমে শরীর কামকাতর হবে
কামান্ধতায় হবে না কভু দিশাহারা;
সৃষ্টির অমোঘ সূত্র কাম দয়িতার প্রতি টান
প্রত্যাখ্যানে জমে অভিমান বেদনায় আত্মহারা;
কাম অপবিত্র যদি যদি কাম পাপ
নদীরা অনাব্য হবে সৃষ্টির বাগানে ফোটে কি গোলাপ?
ভ্রমরের বুকে জাগবে শুধু কন্টকের মনস্তাপ।
সৃষ্টির মোহন বাঁকে কামসূত্রের পাঠ যত্নে রাখি
বীজসূত্র যদি না থাকে বৃক্ষের পৃথিবীটা ফাঁকি।

বুকের গহীন খুঁড়ে কবি তুলে আনে পঙক্তি স্বর্ণপিণ্ড-হীরে
অতঃপর আত্মার উত্তাপে সোনা পুড়ে পুড়ে হয় অলঙ্কার
হীরাতে কৌণিক দ্যূতি যোগ সুনিপুন শৈলী-মীড়ে
এবং এভাবে কাম-স্পৃহা দিয়ে তৈরি কবিতার উপহার;
কামাসক্তিতে শিল্পের বিকাশপর্ব রচিত হয়
কাঙ্ক্ষিত কামাসক্তিতে জাগুক হৃদয়।

 

  • তপংকর চক্রবর্তী এর কবিতা

এক

মানুষ যখন

মানুষ যখন যাচ্ছে চাঁদে
আমরা খুশী সে সংবাদে
কিন্তু কিছু মানুষ দেখি
আজগুবি সব গল্প ফাঁদে।
ঘুরবে মানুষ চন্দ্র-তারায়
যেমন ঘোরে পাড়ায় পাড়ায়
এই ছিল সে চন্দ্রলোকে
শুক্রে দেখি একটু বাদে।
ঘরের পাশে কিংবা ছাদে
কোন অচেনা বেড়াল কাঁদে
ইচ্ছে করে সারা জীবন
আটকে থাকি স্বপ্ন ফাঁদে।
মানুষ যেমন জঙ্গলে যায়
এখন তেমন মঙ্গলে ধায়
এ যেন ঠিক যাচ্ছে বিদেশ
মনের সুখে, কি আহ্লাদে।
কেউ ছুটেছে বৃহস্পতি
রকেট নিয়ে দারুণ-গতি
কিন্তু কিছু মানুষ দেখি
লিপ্ত থাকে বিসম্বাদে।
সৌরজগৎ জয় করে যে
মানুষ যাবে অন্যলোকে
আর কি কাঁদার সময় আছে
মাছের মায়ের পুত্রশোকে।
সে যেতে চায় দূর অজানায়
বিশ্ববাসীর বার্তা নিয়ে
জীবনটা তার করবে সফল
ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন স্বাদে।

দুই

অব্যক্ত

বলতে চেয়েও বলতে পারিনি কথা
বুকের ভেতরে উথাল-পাথাল ঢেউ
জানিনাতো তুমি ভালবাসো নীরবতা
আমাকে ভাবো না তোমার আপন কেউ।

ব্যাকুলতা দিয়ে বকুলকে যদি ডাকি
হয়তো সে ডাকে ফুলেরাও দেবে সাড়া
এতো ব্যাকুলতা কি করে যে ধরে রাখি
দু’চোখে ঘনায় সজল অশ্রুধারা।

এতটা কষ্ট, এতটা বেদনা সয়ে
তোমাকে দেখতে ছুটে আসি কত দূর
হয়তো তোমার নেই সে নির্ভরতা
তোমার হৃদয়ে বাজছে অন্য সুর।

আমরা দু’জন যেন দুই দ্বীপে থাকি
চারপাশে শুধু পাখিদের ডাকাডাকি।

০৩.০৩.২০১৯

তিন

অভিশাপ

নিত্য তুমি করছো যত পাপ
জানতে পেলে কাঁদবে তোমার বাপ্
ভয়েই বুড়োর বাড়বে রক্তচাপ
বলছি শোন, বলছি আমি সাফ
তোমার পাপের হয়না কোন মাফ
জানলে পুলিশ পড়াবে হ্যান্ডকাফ।

খাদ্যে তুমি দিচ্ছ ভেজাল ঠেসে
তার জন্যেই নানান অসুখ এসে
দেয় বাড়িয়ে হৃদপিন্ডের লাফ
বেঁচে থাকাই এখন ভীষণ টাফ।

নিত্য তোমার নানান রকম পাপে
এই পৃথিবী থরথরিয়ে কাঁপে
মানব তো নও দানব তুমি
কাঁদছে দ্যাখো জন্মভূমি
এমন হল কেমন করে
কাদের অভিশাপে!

 

গোলাম কিবরিয়া পিনু এর কবিতা

এক

প্রাণস্পর্শী

প্রাণস্পর্শী মানুষের খোঁজ পেয়ে যাই
হাঁড়িয়া মেঘের মধ্যে থেকে
কখনো কখনো।
সেই সুখস্পর্শ এখনো বাঁচিয়ে রাখে
হৃদয়কন্দরে স্বর্ণপুষ্প
মনের বন্দরে দীপপুষ্প,
কেতকীর খোঁজে অন্ধকূপ থেকে বের হয়ে পড়ি
বনপথে হাঁটি।

মুমূর্ষু-অবস্থা মাঝে মাঝে টেনে নেয়
অন্ধ-জরায়ুতে,
তারপরও মানুষের আকুলতা পেয়ে
পুনর্জন্ম হয়–জন্মপত্র হাতে পাই।

মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে কত রকমের সুর
দূর নভস্থল থেকে আসে
তারই আভা তার কাছে পেয়ে
মুগ্ধতা কাটে না,
ক্ষুব্ধ মন বীতরাগ থেকে বেঁচে ওঠে
শস্যহানির বেদনা ভুলে যাই।

প্রাণস্পর্শী মানুষের সৌন্দর্যে আরও একবার
আত্মজ্ঞান ফিরে পাই–দিব্যদৃষ্টি আমাকে নাচায়
প্রাণপ্রাচুর্যে আবারো বাঁচায়।

দুই

আমরা মানুষ

চোখের জলেও মানুষের ঐক্য হয়
অপরের চোখে জল দেখে
আমারও চোখে জল আসে
বেদনার মধ্যে মানুষের ঐক্য হয়
আর তখনই আমরা মানুষ!
সব ভেদাভেদ দূর হয়ে যায়
আর তখনই আমরা মানুষ!

আশ্রয় পুড়েছে–
আমরা আশ্রয়চ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেই।
সীমান্ত থাকে না–
উদারতায় নিমগ্ন হয়ে উঠি
যাতায়াতের দুষ্কর পথে অসহায় মানুষেরা
রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আসে
অনাহারী হয়ে আসে
আমরা শুশ্রুষা দেই
খাবারও তুলে দেই
আমরা একসাথে বৃহৎ ভূগোলের বাসিন্দা হয়ে উঠি
আর তখনই মানবতা জেগে ওঠে।

কি রাষ্ট্র, কি সরকার, কি শাসন
চুরমার হয়ে পড়ে
অর্থহীন হয়ে পড়ে
যখন নিজভূমে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জায়গা পায় না নবজাতক!
মা’য়ের ক্রন্দন কাঁপিয়ে তোলে পুরো সমুদ্রের জল
সমুদ্র তলদেশের উদ্ভিদও অনুভব করে
নাড়ি ও হৃদয়ছেঁড়া ব্যথা।
এ-ব্যথায় লুপ্তজ্ঞান ফিরে পেয়ে
আমরা মানুষ হয়ে উঠি।

গণহত্যা যখন চলে গণতন্ত্র থাকে না–
কূটনীতি ও কৌশলের কাছে হেরে যাবে
সাধারণ মানুষ?
পুঁতে রাখা বোমা মানে
সুপ্ত হিংসে ও অসূয়া!
মাইন বিস্ফোরণে দু’পা হারিয়ে যায়
ক্লান্ত শরীর ও পেটে ক্ষুধা নিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে গুলিবিদ্ধ হয়–
নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরে মানুষ
হয়ে যায় লাশ!
নদীতে নৌকায় দুলে ওঠে জীবন!
তিলে তিলে গড়ে ওঠা জীবন এখন ধূলিধূসরিত!
মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই
দিনের পর দিন গোসল নেই
শৌচকর্মের ব্যবস্থা নেই
খোলা আকাশের নিচে থাকে–
কি ঘূর্ণিপাক, কি দুর্বিপাক–আমরা তা দেখে অবাক!
অবাক হই বলে আমরা মানুষ
সমবেদনায় অংশী হয়ে উঠি!

ভেদবুদ্ধি নিয়ে ভেদাভেদ ও গড়ে ওঠা প্রাচীর
বার বার মানুষকে সমকোণ থেকে স্থূলকোণে নিয়ে যায়।
ছয় বছরের শিশুর কোমরের বাঁ পাশে গুলি ঢুকে
ডান দিক বের হয়ে যায়
সেই শিশু তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে
সে এখন আমাদের হাসপাতালের বিছানায়
হাসপাতালও অন্ধকারে দ্যূতিময় হয়ে ওঠে!

মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মরে পড়ে যায়–
সেখানে মাটিচাপা দিয়ে আসতে হয় সন্তানকে
তার পর হাঁটতে হাঁটতে আমাদের ভূমিতে–
তাকে তো দূরে ঠেলে ফেলে দিতে পারি না!
একাত্তরে আমরাও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম।
ডালিম গাছটি নুয়ে পড়েছিল সেদিন ক্রন্দনে।
আমরা এখনো সেই ক্রন্দন অনুভব করি
আর সংবেদনায় সমসংগীত গেয়ে উঠি।

তীরে ভিড়তে না পেরে বুকপানিতেই নেমে পড়তে হয়েছে
এক হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে সন্তান,
অপর হাতে স্ত্রী। মাঝখানে নাফ নদী।
শোকপ্রবাহ যেন চতুর্দিকে–কোথায় দাঁড়াবে?
কোথায় শান্তি? কোথায় সম্প্রীতি? কোথায় মর্যাদা?
কোথায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ?
শোধ নিচ্ছে হিংস্ররূপী দানবেরা!
মানবিক সংকটে অসহায় মানুষের প্রতি সংহতি
আমরাও জানাতে পারি।
সমবেদনার ভূমিতে নাড়িপোঁতা থাকে আমাদের।

কাকে করো নিশ্চিহৃ মর্মঘাতী সহিংসতায়?
মৃত্যু দিয়ে আটকানো যাবে না মানুষের শক্তি!
একাত্তরে পারেনি আমাদেরও আটকাতে
সেকথা মনে করিয়ে দেই ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন হয়ে
এই আমার কণ্ঠে।
হৃদয়ভেদী সময়ে–
ব্যথাতুর হই–ব্যাকুলিত হই–সংক্ষুব্ধ হই
আমিও মানুষ–আমিও মানুষ!

 

নজরুল হায়াত এর কবিতা

এক

অসুখ

 

তুমি বিষণ্ণ বসে আছো, তোমার শরীরে অসুখ
রৌদ্রালোক তোমাকে ছোঁয় না
সারাদিন ছায়ায় ছায়ায় ঘোরো
পাখিদের কলরবগুলি দূরে কোথাও উড়ে গেলে

তুমি দেখো খেলাপ্রিয় বালকেরা কেমন মৃত্যুতে মজে আছে;

চৌদিকে রণরঙ্গ, ধনুকের ছিলাগুলি মেতে ওঠে
মাটির পরত ভিজে রক্তের নুনলালসায়
তুমি রক্ত ভালোবাসোনা, তাই মৃত্যুতে ঝুঁকে থাকো
বসন্ত তোমাকে ঘিরে প্রহসনে মাতে;

তোমার সারাশরীরে অসুখ, দিনভর ধানাইপানাই করো
সারারাত কুহুধ্বনি শোনো, আর
নিজের সাথেই মেতে ওঠো রক্তমগ্ন আবীর খেলায়
যাপিত জীবন ঘিরে যতিচিহ্ন আঁকো।

 

দুই

একুশের কবিতা

আমার বিষণ্ণ একুশ আজ লজ্জানত ফুলভারে
অস্পৃশ্য পদপাত প্রতিদিন মাড়ায় তাহারে
বিশেষ দিবস এলে পরিপাটি মোহনীয় সাজ
সারাটা বছর ধরে অবহেলা-অভাবিত লাজ
উড্ডীন পাখির মতো নির্বিঘ্ন সারমেয় উঠে আাসে
নিঃশঙ্ক ঘুমন্ত তার অপূর্ব দেহবল্লরী ভাসে
নিশ্চিন্ত-আনন্দচিত্ত কেউ কেউ হিসি করে যায় বেদিমূলে
সবুজ ঘাসের বুকে ভারমুক্ত হৃদয় ওঠে দুলে
প্রায়শ বিদেশী ভাষায় কিছু লোক বাহারি বক্তৃতার নহর ছোটায়
বিজাতীয় সংস্কৃতির উন্মাদনৃত্যে মলিনতা-তমসা ফোটায়
কারো কারো অন্তরে নিভৃত খেলা করে সূক্ষ্মকুটিল কূটচাল
বানায় রভসে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু-আরবির বোলচাল
অফিসে অফিসে ইংরেজি ভাষার মোহন প্রতাপে দুঃখিনী বাংলার বর্ণমালা কাঁদে বেদনার তাপে
সদর দরোজায় কেউ কেউ ঔপনিবেশিক দাসখত লিখে রাখে
পরম মমতায় ব্যানার-ফেস্টুনে ভৃত্যমনন আঁকে
দারুণ কারিশমায় শহিদ-রক্তে মিশায় দুঃসহ অপমান
মুছে দিতে চায় ভাষার জন্য অমর জীবনদান,

একুশ-দিবসে গুচ্ছ গুচ্ছ পুষ্পমাল্য হাতে
কাকডাকা ভোরে পিচঢালা পথে প্রহসন কাজে মাতে,

এইসব দেখে শহিদের করোটিতে বিপ্লব ফুল ফোটে
কবরের নিচে মৃতবল্কলে আগুনের গোলা ছোটে,

রক্তে রক্তে রাজপথ আজ হোকনা আবার লাল
গর্জে উঠুক সারাবাংলায় ভাষা-শহিদের কাল।

তিন

যাকে ভালোবাসি

আমি তোমাকেই চাই
তবে কালিমামাখানো নয়,
তুমি অযথা মেখেছো ছাই
ছায়াকে পেয়েছো ভয়।

আমার প্রেমেতে ছিলো না তো কোনো খাঁদ
অবিশ্বাসের দোলায় তুমি পেতেছো জটিল ফাঁদ,
নিজের হাতেই বিদ্ধ করেছো নিজেকে
তীক্ষ্ণছুরির রক্ত মেখেছো শুভ্রসফেদ বিবেকে।

তুমি তো জানোই একবার যদি কলঙ্ক লাগে গায়
শত সাফ করে কোনোদিন কি তা মোছা যায়!

যতবার তুমি প্রণয়ের ভাষা বলবে
ততবার তুমি প্রতারক ছবি জ্বলবে।

 

হেনরী স্বপন এর কবিতা!!

এক

অর্ধেক সনেট : শিশ্নের প্রস্রাব

আবিরত ঝরে রতি, শরীর উর্বর শস্যে ভরা উরু
লাঙলে চাষের সব কলা বুঝি ? ওড়ে বাতাসের বুকে;
মুখগুঁজে শিখে নেবে, শ্রমজীবি রমণীর গন্ধ শুঁকে–
আলিঙ্গনে বাধ্য যিশুও, মেরী ম্যাগডোলিনের গুরু।
.
কৃতদাসী কামনা জ্বালায় প্রফেটের বুক কাঁপে ভুরু ;
তৃষিত কুয়োয় ঢেউ দেয়, মাতৃত্বের দৈব ঋতুস্রাব–
আঙ্গরাগে ঠুমরি শুনি, শৃঙ্গারে জ্বলে শিশ্নের প্রস্রাব।

দুই

একটি লোক প্রেমের কা

কই দেখি তো ? কেমন রূপের পান-সুপারি ?
পানের ঝালে ক্লান্ত।
.
খাঁচায় পাখির বন্দি মায়া ; ছোট্ট ঘরে– দুয়ার খোলা পাইয়া,
শিরীষ গাছের, ঝরে শীতল ছায়া…;
বাঘের ছায়া কা-কা গর্জায়, কাউয়া কি তা শুনতে পায় ?
.
তরীর বৈঠা ইঞ্জিন ছাড়া চলে…
.
কেমনে হরি, প্রেমের তুষ-বিচালি– জ্বালানি ছাড়াই জ্বলে…?

 

তিন

নির্জন রোহিঙ্গা শিবির… .

চারিদিকে ভিরু সৌন্দর্যের বিনয় ছড়াচ্ছে, পাপড়ির মতোন রঙিন
ব্লাউজের ঘ্রাণ ;
দুধের ফেনায় শুভ্র অসুখের রুগ্ন বৈভব গাছের ছায়ায় দুলছে–
দীর্ঘ অন্ধকার শুয়ে আছে সমুদ্রের পাড়,
হতাশার কিছু পালক মায়াবি আর্তনাদ ফেলে আসা
একঝাঁক দু:খ কাতর কৈতর, নীরবতা খেলে !
.
আচমকা নড়েচড়ে ওঠে সৌরভের অস্থিরতা, সুপ্ত আতরের মতো
আশ্রয় চড়াচ্ছে উঠোনের ঘাস,
চুলের মতোই খুলে রাখা, অচঞ্চল বাতাসের রাত ;
একপাল বিষাদের ঘোড়া ছুটছে আবেগ নিয়ে–
অরণ্য ও পাতাবাহারের কিছু আর্তনাদ পৌঁছে দেবে বলে…
.
বিপন্ন কামনা নিয়ে নির্জন আতঙ্ক ছুটছে রোহিঙ্গা শিবিরের খোঁজে ।

 

রহমান হেনরী এর কবিতা
এক

উৎসব

উপসাগরের রাতে,
মাছেরা উড়বে— জেলেদের জালে ভুলেও আসবে না;

আর কোনও জ্যোৎস্নাতে,
লখিন্দরের মৃতদেহ নিয়ে বেহুলা ভাসবে না।

যতিচিহ্নের পাশেই, বাক্য: স্বাতন্ত্র্যে দাঁড়াবে—
তোমার লেলানো বাঘের ক্ষুধা
তোমাকেই শেষে খাবে

জলে জলে ভেজা মৃতবৃক্ষের দাহ্যতা ঠিকই জানে:
আগুনের মুখ চুপ হয়ে আছে
ভূগর্ভে-আসমানে

গাছে গাছে এত লালাভ কুঁড়ি, জানো তো কল্পিকা,
চোত-বোশেখে ওরাই ফুটবে
জমদগ্নি-শিখা

উৎসব হবে: সমতলে আর পাহাড়ের জঙ্ঘাতে…
.
দুই

শহুরে

সন্ধ্যায়,
অন্ধকারের গুম্ফাতে উঁকি মেরে
ভীত, সন্ত্রস্ত লোকটা
রাজবাড়ির পাশ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে—

প্রত্যূষে,
সম্ভাব্য আলোর পথে উঁকি মারতেই
আবারও— সন্ধ্যাপাহাড়ের ছায়া;

তার চোখ থেকে খসে পড়ছে
আলো
হাত থেকে
সমুদয় ক্রীড়াচক্র

শহরজুড়ে
জারী থাকছে— ক্রমবর্ধিষ্ণু ভয়;

আ হা, ক্ষয়ে নিমজ্জিত লোকটা কারও কেউ নয়।
.
তিন
স্বত্বের বিড়ম্বনা

আগে
একতলা ছিলো ঘরদোর,
নিজেরাই পাহারা দিতাম—
এখন
বহুতল। পাহারাদারও আছে: কয়েক রকমের;

ওদের জন্য সুযোগসুবিধা খুলে দিতে দিতে
এখন শুধু নিজেদের পরনের কাপড় বাকি…
কিন্তু সুবিধা হচ্ছে না। অস্বস্তি বাড়ছেই।

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা এবং আরও সব নতুন নতুন
অযুহাতে, ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে
চৌকিদারগুলো।

ব্যক্তিগত কত কিছুই তো হারালাম,
স্বেচ্ছায়, ছেড়েও দিলাম অনেক—
ভাবছি: বাড়ির মালিকানাটাও, এবার, ওদেরকেই দিয়ে দেবো;
.

হাসান মাহমুদ এর কবিতা

এক

তুমি নিঃসঙ্গ রেললাইন

ওজন বা ভার থেকে কখনো আলাদা নও জানি। উদার জমিন থেকে
ঢালু কিংবা সমান্তরাল সব পথই চেনাজানা খুব…
গতিকে দেখছ সেই জন্মের আদি থেকে আকাশ অবধি

স্বপ্ন-মৃত্যু, জন্ম-সুখ সবই আছে নাগালে তোমার
রোদ ও বৃষ্টির নিখুঁত স্পর্শ এ জীবনে কে পেয়েছে তোমার সমান?

তবু হায়! তুমি আজ নিঃসঙ্গ বধির প্রান্ত এক
একা এবং একাই
যেন উদ্যানময় বহমান এক নিঃসঙ্গ রেললাইন…

দুই

আমার একাত্তর

বুকে সবুজ দৃষ্টিতে লাল আমার একাত্তর
বৃষ্টিতে নয় রক্তে ভেজা উঠোনমুখি দ্বোর
ঘরপালানো স্মৃতি আমার দেদীপ্যমান মাঠ
বাজার পোড়ার গন্ধ নাকে
শিশুকালের পাঠ!
চোখ মুদলেই ভেসে ওঠে বাবার শ্রান্ত মুখ
মির্জাকালুর গ্রামে ছিল শত্রুরা উন্মুখ!
অর্ধমৃত বাবা ছিল আমার শিশুকাল
শোকার্ত মা প্রার্থনাতেও ছিলেন উন্মাতাল!

কালীগঞ্জকে পুড়িয়ে দিল পাক-সেনা নাপাক!
জাগ্রত জনতা দিল নতুন দিনের ডাক
বাংলাবাজার, দেউলা জুড়ে কী যে হুলস্থূল
পাক-জানোয়ার বুঝল শেষে কোথায় তাদের ভুল!

যুদ্ধ শেষে বাবা পেল নতুন এক জীবন
একাত্তরের সাথেই আমার আজন্ম এই পন
যুদ্ধ হলো জীবনবন্ধু যুদ্ধ সহোদর
জীবন-মৃত্যু এক মোহনায় পথিক পরস্পর

জয় বাংলা ধ্বনিত হউক সারা বঙ্গময়
বাংলা মায়ের মুক্তিসেনা বিশ্বের বিস্ময়!

তিন
চর

আধভাঙা ঘুমে তোর জানালা ময়ূরী হয়;
পর্দারা নাচে যেন প্রতিমা-পরান
উপাখ্যানেই আছে বাহারী প্রণয়
ফসলি জমিই হয় রাধা উদ্যান।

কথারা কোলাজ রূপে সাজায় আকাশ
ভাজখোলা মন দেয় উজাড়-উড়াল—
কখনো কখনো তা পূর্ণ সর্বনাশ
অভ্যাসে মজে যাস এমন কাঙাল

জীবন নিংড়ে পেলি জল বুদ্বুদ
কথা ভেঙে যাপনের এইটুকু ঘর!
পুকুর জুড়েই শুধু মাছখেকো উদ
স্বপ্ন মানেই তোর সীমাহীন চর!

চর: চোখের মতো চিহ্নগুলো

 

 

খসরু পারভেজ এর তিনটি কবিতা

এক

 দহনকথা

আমি নীলঘাস ছুঁয়ে
জীবন নামের ভারি বোঝা টানতে টানতে
এখানে এলাম।

বুকের দুপাশে রঙিলা ক্ষরণ
ঝরাপাতা আর বয়সের মাটিগন্ধ ঘুম
দুহাতে জড়ানো রক্তমাখা পাণ্ডুলিপি
করুণ কালিতে লেখা নিয়তির প্যাপিরাস
নিজস্ব নদীর তুমুল ভাঙন
অগণন মিছিলের মৃত্যু
অদৃশ্য আগুনে পুড়তে পুড়তে
এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়, সুজনেষু !

তবুয়ো তো পৃথিবীর কাছে
মনে হয় একদিন মৃত্যুহীন হবে
আমার বেভুল ভালোবাসা।

যদি ডাকো যাবো
কী করে ফেরাবো তোমাকে !
—————————————-
৩ মার্চ ২০১৯, রাত ১১.৪০

দুই

দরোজার ওপারে

কেন ধাক্কা দাও?

দরোজার পেছনেই থাকে স্মৃতি এসো বারান্দায় বসি।

এসো আমরা সূর্যের সামনে দাঁড়াই,

এসো শিরিষের সাথে গল্প করি

স্মৃতিগুলো থাক দরোজার ওপারেই জ্বলজ্বলে

স্মৃতিগুলো সুখে থাক, সুখে থাক।

এসো উঠোনের কোণটাতে একটু দাঁড়াই

দক্ষিণ বাতাসে বুকের বোতাম খুলে দিই

ঝরাপাতা ঝরতে থাকুক।

কেন ধাক্কা দাও?

দরোজার পেছনেই আছে সময়ের শিলালিপি

ওখানেই লেখা আছে আমার অমর এফিটাফ।

 

তিন

বিভঙ্গ

খুব সহজেই ভেঙে পড়ি পাপরের মতো

অথচ আমার বাবা মাথা উঁচু করে দাঁড়বার কথা বলতেন

অধম সন্তান কিছূই শিখিনি আমি

কান্নার সমুদ্রে ভাসমান পিপীলিকা হয়ে ভাসি

বাবা বলতেন, জীবনটা ধনুকেরই ছিলার মতো সবসসময় ধরে রাখতে হয়

টানটান করে জীবনের অর্থ সেদিন কিছুই বুঝিনি আমি

বাবা বলতেন, শুকনো পাতার মতো কষ্টগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিবি

কত বৃষ্টি-যুদ্ধ -ঝড়-কারফিউ গেল কষ্টের পাহাড় ঠেলে বাবা পথ চলতেন

কখনো ভাঙতে দেখিনি–কাঁদতে দেখিনি…

 

নাসরীন জাহান এর কবিতা
এক

প্রিয় নাইটিংগেল

পরাণে ঠোঁটচাপা হাসি,
হুহু আসমানের নিচে তোকে দণ্ডায়মান দেখে।
পেছনে অরণ্য, উজ্জ্বল রোদ।
তোর চে্হারায় জমকাল ক্রোধ।
আতঙ্ক কষে কষে ডানা ঝাপটায়।

ওপরে ও কি উড়ে গেলো?
ফ্লাইং সসার?
রোদ্দুরে হেমন্তের মিশেলে
অরণ্য ক্যানভাসের পেইন্টিং হয়ে গেছে।

পকেট থেকে কি বের করছিস?
পিস্তল?
আমি মুহূর্তে কর্পুর হয়ে অরণ্যে মিশে গাছ হয়ে গেলাম

প্রহর অতিবাহিত হয় পা পিষে পিষে
বাতাস ঢেউ তুলেছে সমুদ্রের মতো।
ভোঁ ভোঁ চক্কর খাচ্ছিস তুই
একসময় তোকে আর দেখা যায়না।

কিন্ত গুলির শব্দ।
শেকড়ের কাছে উড়ে এসে রক্তের মধ্য তড়পাতে থাকে
আমার প্রিয় নাইটিংগেল!

দুই
মাটি

মাটিকে আমরা মাথায় তুলেছি,
হায়!আমরা গৃহ হারিয়েছি
আমরা হাঁটছি আকাশের পথ ধরে,
প্রেম আমাদের দুটো ডানা দিয়েছে।

আমরা যখন অন্ধকার মাঠ ধরে হাঁটছি,
আমাদের কন্ঠে ছিল এ জাতীয় কোরাস।
বাতাসে উল্টেপাল্টে যাচ্ছিলো পা,
কোটের পকেটে রাখা হাত অদ্ভুত গরম শীতের মিশ্রণে
হারিয়েছিল চেতনা।

আমরা সেই চেতনারহিত হাত আচমকা
চোখের সামনে বাঁকিয়ে,ঘুংগুরে শব্দ তুলে
পায়ের তলার মাটি কিংবা আকাশ কে চূর্ণ করে
হাত বাড়িয়ে মৌমাছি ধরতে চাইছিলাম,
আশ্চর্য হয়ে দেখি আমাদের হাত লম্বা হয়ে যাচ্ছে,
কুয়াশায় আমাদের আংগুল ভিজে যায়।

এর মধ্য আচমকা আসমান জমিন ফাটিয়ে শব্দ হয়।
আমাদের ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর ক্রমশ
শূন্যতায় ছিটকে ভিটকে যায়।

তিন

জলাতঙ্ক

সে বললো,চল জলে ঝাঁপ দিই।
সাঁতার না জানা আমি মহা জলের
বিস্তারিত টলমল দেখে কেঁচো হয়ে যাই।
চারপাশে থইথই জোসনা।
চাঁদ যেন দইয়ের বাটি উপুড় করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
এখন আসল চাঁদ জলের মধ্যে ফকফক করছে।

সাঁতার জানিস না? ভয় কি আমি তো জানি।
চল লাফ দিই ওয়ান টু থ্রি ।
ভয়ে কাঁপতে কাপঁতে বলি,জলে কি সুন্দর চাঁদ!
ওইটাই তো আমার দরকার।
বলতে বলতে আমার দু ডানা উড়িয়ে চাঁদ বরাবর আমাকে ফেলে দিয়ে বলে,
যা আমার জন্য চাঁদ পেড়ে আন গিয়ে।

 

সালাম সালেহ উদদীন এর কবিিতা 

এক

চলে যাবো বলেই

চলে যাবো বলেই তো
যাত্রা শুরু করেছি
তোমার কাছে রেখে গেলাম
রূপালী চাঁদ-জোছনা
অন্ধকারের হিম-শীতল নির্জনতা
নিষ্পাপ ভোর বাড়ন্ত রোদ
মায়াবী কুহক ঘোরলাগা সকাল
ঝুলন্ত নরোম সজনে ডাটা
কচি পাতার বাহার ফুলের মাদকতা
বাসন্তী রঙা শাড়ি কোকিলের বিরহ
নির্জন পথের কান্না পাখির কোলাহল
নদীর মরুময়তা নিরন্নের হাহাকার
আফসোস
অর্থ-বিত্তের দাপট হিংসা ঈর্ষা
আর ক্ষমতার নগ্ন মহড়াই কেবল
রেখে যেতে পারলাম না
ভালোবাসা যে টুকু রেখে গেলাম
অাঁচলে বেঁধে রেখো সযতনে
ভালোবাসাও এখন বিক্রি হয়
ফেরিওয়ালা পসারী সাজায় বারোয়ারি হাটে

দুই
প্রত্যাশা এমনই

আকাশ হতে চেয়েছিলাম
সেখানে কেবল অসীমতার খেলা
বাতাস হতে চেয়েছিলাম
জাগিয়ে তোলে অদৃশ্য ভয়
হৃদয়কে নদী বানাতে চেয়েছিলাম
নদীর ভেতর দেখি মরুময়তার দাপট
ফুল হতে চেয়েছিলাম সুবাস ছড়াবো বলে
সৌরভ কেড়ে নিয়েছে রাতের অাঁধার
ভালোবাসা চেয়েছিলাম ভালোবার কাছে
ভালোবাসা বললো বিকোয় পথে পথে
অবশেষে মানুষ হতে চেয়েছিলাম
আওয়াজ উঠলো তুমি তো মানুষ-ই

তিন
প্রাণহীন নিষ্ফল আবেদন

বিবেক মরে গেছে সত্তা ঘুমিয়ে পড়েছে
চোখ অদৃশ্য হয়েছে চোখের ভেতর
পা দুটো খসে পড়েছে ছায়াহীন পথে
রোমান্স-প্রিয় তীর্যক আঙুল হয়েছে অবশ
ঠোঁটের কারুকাজ এখন রেখাহীন নদী
প্রগাঢ় আলিঙ্গনাবদ্ধ বুক খরাপ্রবণ মাঠ
ক্ষমতার দাপট অর্থবিত্ত-ঘেরা ভালোবাসা
করুণা-পাগল প্রাণহীন নিষ্ফল আবেদন

রাশি রাশি শস্য ফলে চাঁদে
গড়িয়ে পড়ে তোমার ভয়াল মুখে
রাশি রাশি বরফ প্রেরণ করেছে অ্যান্টার্কটিকা
তপ্ত-শরীর শীতল হবে এবার নিশ্চয়ই
অদৃশ্য শাখা থেকে খসে পড়ছে ফল
অক্ষরেখা-বিষুবরেখা থেকে ধেয়ে আসছে শূন্যতা
মঙ্গল গ্রহ থেকে কী আসবে তোমার জন্য
জানতে পারিনি এখনো
তুমি রোবট-মানব অশরীরী এক
পৃথিবী তোমাকে ধারণ করতে অপারগ

 

 

মামুন মোয়াজ্জেম এর কবিতা

এক

অনন্ত প্রবাহ

 

সময়ের সাথে বয়ে গেছে কত রক্তক্ষরা নদী
হারিয়েছে বাঁক ধূসর পথের কেবলই ধূসর ধুলি
স্মৃতির পাতায় কিংবদন্তী মুখে মুখে তার নাম
গড়িয়েছে জল ভাটির টানে নদীও নিয়েছে টেনে

কেউ জানে না এই কোলাহল কোথা তবে মিশে যায়
স্মৃতি মুছে গেলে লোকালয় তবে কোথা হতে আলো পাবে
অনাদিকালের কর্মযজ্ঞ পাথর কাঠের কাজে
বিদ্যের জোর নদীর জলের নিরুদ্দেশ যাত্রা তবে

নদী বয়ে গেছে বয়ে গেছে সময় সাঁতড়ে গিয়েছে মানব
কিছু তার নেই নেই নদী সময় মানবের কঙ্কাল
স্বপ্ন দম্ভ আশা ভোজবাজির নিকেশ কোথায় স্থিত
প্রবাহের টানে শুধুই প্রবাহ অনন্ত প্রবাহ যেন !!

——
বরিশাল
৪ মার্চ ২০১৯

 দুই

সুখ জাগানিয়া ———

ওয়াটার বাসের খইফোটা উদগত জলের ছিটে
হাতে নিয়ে বলি- আমি অসুখী নই !

তরঙ্গায়িত সাদা ডানার উড়াল গাঙচিলের
বাঁকা কমলা ঠোঁটে রোদের ঝিলিকে
এবঙ জেলে নৌকোর জালের ভাঁজে ভাঁজে
নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে বলি-
আমি অসুখী নই ।

এত জলের উল্লাস, নেচে নেচে যাচ্ছে তরী
বাল্কহেড,ট্রলার বোট মাল্টিস্টোরিড লন্চের সাথে
আমিও ভেসে যাই-
জলজ শৈবাল ও নন্দিত কচুরিপানা হয়ে
জল ও আকাশ সীমায় ক্রমে জড়ো হই

যেখানে সূর্য ফোটার আগে পুতস্নান সাড়ে জেলেবউ
কিশোরী ছাগল দঙ্গল তাড়িয়ে মাঠে যায়
সারা রাতের ধকল ম্যাজম্যাজে শরীরের খোরাকে
চিৎপাত করে জেলে মরদ।
দন্ডকলসের সাদা ও রঙিন ফুলের কানে
ছোট্ট মধুমাছির ফুসমন্তর গুন্জরণে
আমি অসুখী নই

লিকলিকে লাউডুগি সাপের থিরথিরে কন্চিতে
আঁকড়ে বসে থেকে
ডিমপাড়া মাতৃপাখির ডানামেলার ফুরসতে
এবঙ নিলুয়া বাতাসের শীতল ঝাপটায়
আমি অসুখী নই

এত জলের ভীড়ে নানামুখী প্রবাহের খবরে
শুনি লোকালয়ের গান
সারসের কৌণিক আকাশ সাঁতার এবঙ
বিটলের শক্ত ডানার বাতাস ভাঙার শব্দের কোষে
আমি অসুখী নই-

আমাকে সুখ দেবে বলে অনর্গল পাথর ভাঙার শব্দে
ঘূর্ণমান চাকার কোরাসে খুটখাট আপলোড
ও ডাউনলোডের নেই প্রয়োজন
শিরায় বয়ে চলা সহজ জলের ভিটামিনে পাতার বিকাশে
আমি অসুখী নই !!

———-
বরিশাল
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 

তিন

ঘুমের ভাঙ্গা প্রহর

ঢেউয়ের অভিঘাতেই ভাঙে তার ঘুমের প্রহর

ওপাশে কীর্তনখোলা কালাবদরে বদর বদর করে
হাল ধরে কালা মাঝি-
নিঝুম রাতের ওপর আকাশের সন্তাপ
এই যে জললগ্ন জেলে নাল বাতি এঁকেছে
কোলাজ- তার দু:খে ঘুমায় না তারা।

কিছু কি ফেলে যায় ওই হাড় খাটুনির কালো লোকগুলো
মাছেদের সাথে দৌড়ে দৌড়ে যে এখন ছিপছিপে মাছ-
ঘুমের চোখের ভেতর স্বপ্নদেখা বধূরা দেখে
রূপোলী ইলিশ-
রাতের সোহাগগুলো যার চিরকাল শিকেয় ওঠানো
রূপোলী পর্দার রূপোর স্বপ্নগুলো নিয়ে ঘুম ভাঙে
এঁটো বাসন মাজার ইঁদারার পাশে শুনে রূপোলী খবর
অথবা ঘাটের ওপর বুক ভাঙে তার ।
ভোরের আকাশ ক্রমশ: গরম হয়ে
সমস্ত সংসার সোহাগ আঁচড়ে ফেলে দেয় !

কীর্তনখোলার সাদা জলে কোন স্বপ্ন নেই তার
জলের সাথে জীবন, জীবনের সাথে জল
ক্রমশ: কালো বলে স্বপ্নেরা জেগে ওঠে
জেলেদের নালবাতির জলজ কোলাজ ঘিরে !!

——— বরিশাল

 

 

ফয়সল নোই এর কবিতা

এক ওহঃ পরিশ্রম ; লোনাস্রোত

ওহঃ পরিশ্রম ; — লোনাস্রোত
ফয়সল নোই
১.
তোমার সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে
দেখা হওয়া প্রয়োজন

ভুলেছি যে কথা ,
ভুলে যাবো সব কথা

অদ্য বলে রাখা প্রয়োজন !

হৃদয়ে যে রেখা উথলায়
যে রেখা ভুলে যাবো

অদ্য এঁকে রাখা প্রয়োজন ।

ফিরে এসে দেখি —
মাণচিত্র আছে ,
চেনা অধিবাসী নেই

হাড়ে-কংকালে আগুন জ্বলে ;

সে আগুন
কতটুকু ভালো ,
জানার অধিক !

২.
একদিন দেখা হয়, কথা হয়
আমি বহু দিন মনে রাখি
আস্তর ওঠা ইটের দেয়ালে
প্রেমভরে স্মৃতি লিখে রাখি

হাতের চেটোয় জল , জেনে
পত্র লিখেছি
ওহ:পরিশ্রম ; – লোনাস্রোত

পিপাসায় অশ্রু পান করি ।

রচনা : ১৯৯৮

উৎসর্গ: প্রয়াত কবি বন্ধু অনন্ত জাহিদ

দুই

ত্রিসন্ধ্যা

বহু অঙ্গীকার পেছন থেকে হঠাৎ দাঁড়ালো কেউ

মানুষ দেখতে এসে সে এক আশ্চর্য ভ্রমণ

বজ্রাহত কৃষক জমানো যত ক্ষতি বুকে মাঠে পড়ে আছে

হাসপাতালে অচেনা মানুষ,
শিয়রের পাশে সে কি প্রবাস ফেরত সন্তান
তার পরিচিত লোক, সংসার !

ত্রিসন্ধ্যায় ঘুরে ঘুরে আসা দিন
বাইরে রেখে যারা —
কালো ইতিহাস থেকে উঠে আসা ডাইনোসরের পিছু পিছু হেঁটে
হেমিলনের শর্তসাপেক্ষ ইঁদুর হয়ে যায়;
বড় জোড় তাদের সঙ্গে হেঁটে থাকে অভিমানে

— কারো স্মৃতি কেউ মনে রাখবে না

রচনা: ১৩/০২/২০১৯ ইং

 

তিন

দুপুর বেলায়

জারুল ফুলে জারুল ফুলে
দৃষ্টি তখন আটকে ছিল

এমন তরো জীবন যাপন
রুদ্র তরী রুক্ষ খেলায়
খোল ফেঁসেছে
দুপুর বেলায়

ফিরতি পথে ঢেউ ছিল না
তবু কেমন অচিন লাগে

আঁচল জুড়ে গুল্ম কাটা
মেঘ হয়েছে কোমল দেহ
ক্ষীণ রেখা চোখের নেশায়
তেমনি হাসে জীবন যাপন

সংগোপনে প্রতিশ্রুতি
দুপুর বেলায় দুপুর বেলায়

 

 

মুজিব ইরমএর কবিতা

এক

পাঠ্যবই

অনেক লিখেছি আমি অপাঠ্য পুস্তক

এবার লিখিবো কিছু পাঠ্যবই

যদি দয়া হয় পাঠ করো

তুলে রাখো উন্নি গরম বুকে

তোমার নামের গুণে

তোমার দয়ায়

জানি আমি

এ পুস্তক অপাঠ্য রবে না আর

একদিন পাতাগুলো ভরে যাবে গুণে,

আগর চন্দনে।

 

দুই

নিন্দামন্দ

 

বৈদেশী ডাকিও না আর বুকে বড়ো বিঁধে!

টিটকারি দেবে যারা তারা দিক

নিন্দামন্দ

তামাশা করুক

দূরে চলে যাক

তুমি শুধু সেই নামে ডাকো

যেন আমি ডাক শুনে পার হতে পারি

ভাঙ্গা মন

ভাঙ্গা সাঁকু

দূরের হাকম…

কাকুতি মিনতি রাখো

লগ ছাড়িও না আর বুকে বড়ো বিঁধে

বৈদেশী ডাকিও না আর বুকে বড়ো বিঁধে!

 

তিন

আবারও নিন্দামন্দ

তুমি লগ ছাড়িও না, ফাউড়ি লাইও না!

কান্দা-কাছাত থাকিও তুমি

তুমি গেলে কে আর রাখিবে মনে

অধমের নাম

নামের সুনাম

নাম নাম করে আমি তোমারেই ডাকি

নাম নাম করে আমি তোমারেই আঁকি

নিন্দামন্দে ডুবে আছি

তুমি আর শরমিন্দা করিও না, লগ ছাড়িও না।

 

মানস বিশ্বাস এর কবিতা

  

কবি কথা বলো

কবি কথা বলো
এই তো তোমার ছলছল উচ্ছল সজল শান্ত নয়ন
এই যে পাতাপাতা আভা আভা গোলাপ গোলাপ ওষ্ঠ অধর
এই যে দুর্লভ দূর্গম গিরি শেষে
আমার মতো ধূলিমাখা মানুষের শান্ত শান্তির পথ ।

কবি চেয়ে দেখ
একবার চেয়ে দেখ শিশির জাগিয়েছে বাংলার প্রান্তর
আমাদের দুঃখমাখা স্বপ্নমাখা আর একটি দিনের পথ ।

কবি কথা বলো
এখন আধার রাঙ্গানো ভোর
দিগন্ত পাড়ে লাল লাল মেঘেদের কোলাহল
কবি ঐ যে তোমার প্রিয় নদী
নদীতে শান্ত ঢেউ
পাড়ে জাগা মানুষ
ঐ যে বাড়ি ,বাড়ির ভিতর কত রং

কবি কথা বলো
ঐ যে রোদেলা আকাশ
উঠোন ভরা শূন্য তার
এই যে তোমার নিথর নিঃশব্দ কন্কণ
এই তো পূজোর আসন ,বাসি ফুল, শূন্য সাঁজি
এই যে তোমার চন্দন বাটি ।

কবি কথা বলো
এই যে গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশ চাদর
সাজানো ড্রেসিং টেবিল,শূন্য খাট
তোমার অপেক্ষায় চেয়ে আছে।

কবি কথা বলো
একবার কথা বলো
আবার ব্যস্ত জনপথ
আগুনে ধূপের গন্ধ
চন্দনে লেগেছে আগুন
কবি একবার কথা বলো।

দুই

ভুলেছি

জেনেছি জীবন
ভেঙ্গেছি ঘর ।

ভুলেছি পথ
বুঝেছি সব
ধূ ধূ শূন্য
চরাচর ।

তিন

পড়ি

মেঘেরা লালদল, উড়াউড়ি ,হাসি হাসি
পুকুরে জলঢেউ, এই, এই যে বিন্দু
নেই ,এখন নেই ।
তারে ভেজা শাড়ি রিম ঝিম ,ঝিন ঝিন শব্দ
সোনা সোনা বিকেল ক্লান্ত
ওই যে পা ,আধো আলতা কাদা কাদা
মাটি ভালবাসা ।
উঠোন কিনারে ঘরদোর ,কাজবাজ
ধানক্ষেত দোলা দোলা
রাতের কালো জামা, খেজুর পাতা ঘুমঘুম
বিকাশ এল ,হাঁকডাক
পেটভরা ,বাজার সময়, দিনের ব্যর্থতা
পড়ার কন্ঠ ,মশাদের বাঁচামরা
শিশুর ন্যাংটো শরীর
শিহরণ-এ পাশ ওপাশ, চাঁদআলো
মেঘেরা এখন সাদাদল যুদ্ধবাজ ,শব্দহীন ।

 

জীবন নজরুল এর কবিতা
এক

মেটামরফসিস

একা হতে হতে শূন্যতায় মিলিয়ে যাই।
কার্তিকের নরম রোদ কিংবা
পূর্ণিমার যৌবনবতি হওয়া
পিপীলিকা জীবনে মূল্য কতোটা!!!

মূল্য, মূল্যবোধ সভ্যতার মানদণ্ড।
মানদণ্ডেই আঁটকে আছে আমাদের প্রেম;
কৈশোরে কানামাছি খেলায় হারিয়েছি।
একা হতে হতে অণু পরমাণু, তবু
আরো আরো
ক্ষদ্রতায় বিলিন ঘাসফুল নদী।
একা হতেই উড়ে ছিলো যে প্রজাপতি
জাদুঘরে কাঁচের বাক্সে বন্দী
জীবনে
শিশুদের শিখায় ঘুর্ণনবিদ্যা।

সীমান্ত প্রহরী
তোমার কোনো নিজস্ব দেশ নেই।
ভাড়ায় বিক্রি হই অল্প মূল্যে
প্রতিদিন মরে যাই,
মরে গিয়ে বেঁচে থাকি
স্বপ্নে বিভোর।

এই সব
বেঁচে থাকাথাকি
ক্লান্তি গ্লানি
পঁচা মাংস
স্বপ্নের বিনিময়
তুমি কোথায়? আমি!!!

কার্তিকের রোদে বিষন্নতা শুকাতে দিয়ে চলে যাওয়া দেখছি।
দূরত্ব
আমাকে বোকার মতো
সাহসী বানায়।
তুমি একা হতে হতে মেটামরফসিস
নতুন সকালে।

দুই

কেবলা

কেবলা মানে দিক
প্রতিটি মানুষের একটাই দিক থাকে,
অবশ্য দিকবিহিন মানুষও ঘুরাঘুরি করে
আমি দিক থাকা না থাকা মানুষ দেখি রঙিন।

অতি ক্ষুদ্র যে পিপীলিকা
তারা দলবদ্ধ দিক ভালোবাসে।

ভালোবাসা মুগ্ধতা বিলায়, আমি
মুগ্ধতাহীন ভালোবাসায় আটকে থাকি।

পৌঁছাতে চাই বৃষ্টি ভেজা জোস্নায়
লাঠাই ছিন্ন ঘুড়ি আকাশের বৃত্তে হারায়
হারিয়ে ফেলে তার নিজস্ব কেবলা।

চকচকে রোদ্দুরে অন্ধের মতো দাঁড়াই
দেখি- দেখতে থাকি অথবা দেখিনা কিছুই
আমাকে ঘিরে অজস্র রঙিন প্রজাপতি, দিক থাকা না থাকা বিবর্ণ মানুষ।

আমিও কখনও কখনও নিজেকে মানুষ ভাবি
তখনই
আমি না
কেবলাই খুঁজে হারিয়ে ফেলা আমাকে।

তিন

মানুষ কতো তুচ্ছ কারণে অকারণে

আমি নিহত হবার সময়
চারপাশ সোনালী রোদ্দুরে মায়াময়।
তুমি, আমার ভালোবাসা
স্পর্শের নাগালে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
ঘামের বিন্দু বিন্দু জলকণা
রক্তের লাল লাল অজস্র টিপ তোমার কপালে,
কিছুটা ভয় তোমাকে ঘিরে।

আমি তোমার চোখে খুঁজি হারিয়ে ফেলা আমাকে।

ঠোঁটে চুম্বনের দাগ বলে দেয়
একদিন কতোটা পিপাসায় শিশুর সারল্যে আশ্রয় চেয়েছি।

আমাকে যখন হত্যা করা হয়
তোমার মোলায়েম হাত আমার বুকের পরে
কিছুটা বিভ্রান্ত আমিও হলাম।

চকচকে রোদ্দুরে আমি নিহত হবার আগে
আমার আঙুল স্পর্শের লোভে
সারা বিছানায় তোমাকেই খুঁজে।

পড়ন্ত বিকেলের একরোখা রোদে সাহসী হয়ে ওঠো।
কম্পিত ঠোঁট কি কিছু বলতে চায়?
ভালোবাসা অথবা
আমার জন্মের আগে যে ব্যাথায় ব্যথাতুর
যাকে ভালোবাসা বলে ভুল করেছিলে
অমাবস্যার কালো গহ্বরের তলিয়ে যাবার আগে।

আমাকে হত্যা করার সময় মুখোমুখি
তুমি, আমার ভালোবাসা।

মানুষ কতো তুচ্ছ কারণে অকারণে
বৃষ্টিতে ভিজে।।।

 

মাসুদ আলম বাবুল এর কবিতা

এক

মিছিল

তার মৃত দিনগুলো কেটেছিলো

জলজ্যান্ত বসন্ত হাওয়ায়

ডুবো সূর্যের মতো কিছু রঙ রেখে গিয়েছিলো

গুহার আঁধারে পুণ্যার্থী স্নানের মতো উপচে ওঠা

জলের হিসেব যতোটুকু জানি

রাখেনি সাগর সাত্ত্বিক

জলপ্রাত্র নিয়ে তার প্রবাল প্রবঞ্চনা।

একবারই মেঘের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলো

যে সারল্যমাখা দুহিতা হৃদয়

একদা সে নিজেই বুঝি মেঘ হয়েছিলো।

যে সূর্যের রঙ খুঁজেছিলো আনত বর্ণায়

সে নক্ষত্র হয়ে আকাশ বিদীর্ণ করেছে,

যে বসন্তের সব হাওয়ায় ভরতে চেয়েছিলো

স্বীয় অবারিত বুক ও হৃদয়

তার দু’হাত এখন জ্যৈষ্ঠের খরতাপে দ্রোহী।

 

দুই

প্রত্যাখ্যাত

 

বৃষ্টির কাছে জল চেয়েছিলাম

বৃষ্টি বললো, মেঘের কাছে বলুন।

মেঘ বললো, সাগরের কাছে আমার অনেক ঋণ।

এ সিজেনটা যাক, আসছে বারে; একটু সময় দিন।

 

দিনের কাছে বলেছিলাম, একটু আলো দাও

বললো রেগে, আমায় বলছো কেনো?

সূর্য আছে হাত পেতে ভিখ চাও।

 

রাতের কাছে বলেছিলাম,

একটুখানি আঁধার দেবে ভাই?

সেই কখনো হয়?

মৃত্যু ছাড়া আমার কাছে আঁধার মজুদ নাই।

 

তিন

সেই যে তুমি

তোমার জন্যে চাঁদ উঠেছে শরৎ ডাঙায়

এবার আমি খেজুর পাতায় চাঁদখানাকে আটকে দিছি

খেজুর পাতা বলছে যেন আর পারে না সময় দিতে

সময় বড় বিশ্রী এক কিপ্টে জিনিস

তুমি শুধু টানাপোড়েন সেই নিশিথে

অবশেষে কাশময়ূরী মেঘ নামালাম

চাঁদ বলেছে আর পারিনে এবার ছাড়ো

মেঘ বলেছে বিষ্টি দেবো কাল সকালে

আজকে আমি পাহাড় চূড়ে নাচ দেখাবো

ততক্ষণে চাঁদটা বড় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে

খেজুর গাছটা অন্ধকারে হিজাব পরে লুকিয়ে আছে

শরৎ ডাঙায় সত্যি তুমি আসবে বলে আর এলে না

মাঝে মাঝে মেঘের সাথে টিটকিরি দেয় চাঁদ লুকিয়ে।

 

শামীমা খানম এর তিনটি কবিতা

এক

তবুও সপ্ন আঁকি

তোমাকে দেখার পর প্রতিদিন লালন করেছি

আমার যে স্বপ্নের পৃথিবী আজও

সে স্বপ্নে বিভোর আমি অথচ তা তোমাকে

এখনও হয়নি বলা, জানানো হয়নি আমার সমস্ত অনূভূতি

ধ্যান-ধারণা অক্টোপাসের মতো

কীভাবে তোমাকে জড়িয়ে রেখেছে!

তোমাকে বিহীন ভাবতে গেলেই কষ্ট হয় আমার!

অথচ জানি এ কষ্ট আমাকে ছাড়বেনা কখনও

বাতাসে বিচ্ছিন্নতার পূর্বাভাস, ঝড়ের পূর্ব সংকেত

আমাকে দলিত-মথিত করে, যন্ত্রণায় বিষাক্ত হই

প্রতিদিন ; তবু সপ্ন আঁকি

সপ্ন দেখি ভালোলাগার সেই বৃক্ষটিকে পরিচর্যা করি

পরিপূর্ণ মলিনীরূপে, শুধু প্রত্যাশা একদিন

প্রকৃতি সহায় হবে আমার

দুরন্ত পৃথিবী ভালোবাসার অসংখ্য ফুলে ভরে যাবে

আমি দেখবো আমাকে, আমার প্রকৃতিকে।

 

দুই

রক্তে লেখা ইতিহাস

বাঙালি জাতির জনক অন্তরে তুমি বাইরে সজীব প্রাণ

তোমার কীর্তি হবেনা কখনো বিলীন।

হে জাতির জনক দেশ ও জাতির কল্যাণে চিরস্মরণীয়

তোমারই অবদান দিয়ে গেলে জীবন

জাতির জন্য শেষ হলো এক মহাপ্রাণ ।

যুগে যুগে তোমার গুণকীর্তনে বাঙালি জাতির মন

মত্ত থাকবে তোমাকে ঘিরে তুমি আপনজন।

১৫ আগস্টে হায়েনার থাবার রক্তে লেখা

তুমি এক ইতিহাস

স্তম্ভিত হলো বাঙালি জাতি থেমে গেলো সব নিঃশ্বাস ।

নীরবে ঝরে চোখের অশ্রু কান্নায় ফাটে বুক

পিতৃহারা জাতি হতবিহ্বল কোথায় লুকাবে দুখ?

আগস্ট এলে কাঁদে তাই এই জাতি তোমাকেই মনে করে

মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছ তুমি আজ বাঙালির ঘরে ঘরে।

 

তিন

অপেক্ষায় থাকবো

অন্তর খুঁজে ফিরে তোমাকে

হৃদয়ের একান্ত নিবিড়তায় পেতে চায় তোমাকেই,

চলে এসো তুমি- গ্রীষ্মের দক্ষিণা বাতাসে

আমি অপেক্ষায় থাকবো।

বর্ষায় এসো তুমি রিমঝিম বৃষ্টিতে

শরতে এসো তুমি সুনীল আকাশে

সাদা মেঘের ভেলায় চরে,

নদীর বুকে কাঁশের বনে শিউলি ফুলের সুবাস নিয়ে,

আমি অপক্ষায় থাকবো।

হেমন্তে এসো তুমি মনোলোভা ফসলের মাঠে

আলোয় আলোয় উচ্ছল হয়ে,

শীতে এসো তুমি হিমেল হাওয়ায়

সকালের সোনালি রোদ্দুরে

আমি অপেক্ষায় থাকবো।

 

বসন্তে এসো তুমি বাহারি ফুলের সমারোহে

সপ্ন জড়ানো আদর মাখানো ডালা সাজিয়ে

আমি অপেক্ষায় থাকবো।

 

 

স্বীকৃতি প্রসাদ বড়ুয়া এর কবিতা

এক

তবুও ফুল ফোটে

সকালে উঠেই বাজারে দে দৌড়,

শুধু দৌড় দৌড় আর দৌড়

আয়নার সামনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শেভ করা শেষ

টিভির পর্দায় ব্রেকিং নিউজ

লঞ্চ ডুবিতে … জনের মৃত্যু

তখনও অনেক মানুষ পেটপুরে সকালের পান্তা ভাত খাওয়া শেষ করেনি

কিন্তু লঞ্চের মানুষগুলো তাদের জীবনের শেষ পাড়ে পৌঁছে গেছে।

 

আবার বসন্তের আমের গাছে দেখা যায় কি সুন্দর ফুলের সমারোহ আহা!

মানুষগুলো যদি এরকম নীরবে ফুল ফোটাতো যদি মানুষের মনে,

অন্তত কলহ হিংসা কিছুটা হলেও কমতো, দুঃখ কিছুটা লাঘব হতো।

একটি মানুষের একটিই মুখ,

দুইটি চোখ, দুইটিই পা, দুইটিই হাত

কিন্তু কিছু মানুষ মনে করছে তাদের লক্ষ লক্ষ এসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ

এজন্য এদের লাগবে পৃথিবীর সব সম্পদ, সব সম্মান, সব সুখ।

অন্যরা উলঙ্গ থাক,

না খেয়ে থাকুক,

ফুটপাতে থাকুক, বুঝুক জীবন কি!

একই প্রসেসে পৃথিবীতে এসে মানুষের কত ভেদ,

অথচ কাক সব একই রকম কোকিল সব একই সুরে কি সুন্দর করে ডাকে,

মানুষ কেন পারে না?

 

দুই

আমি মানুষ নই!!!

মা বাবার কাছে আমি সন্তান

স্ত্রীর কাছে আমি স্বামী

সন্তানের কাছে আমি বাবা

আমি মানুষ নই।

বাজারের কাছে আমি ভোক্তা

দোকানির কাছে আমি ক্রেতা

দেশের মাঝে আমি নাগরিক

শহরের কাছে আমি আগন্তুক

আমি মানুষ নই।

যখন কিছু দেখি তখন দর্শক

যখন দেখাই তখন প্রদর্শক

যখন বানাই তখন নির্মাতা

তবু আমি মানুষ নই।

প্রেমিকার কাছে আমি প্রেমিক

বইয়ের কাছে আমি পাঠক

বোনের কাছে আমি ভাই

আমার মানুষ পরিচয় কই?।

 

চাকরী করলে আমি চাকর

ব্যবসা করলে ব্যবসায়ী

ছবি আঁকলে চিত্রকর

গান গাইলে গায়ক

আমি মানুষ নই।

মারা গেলে আমি মৃত

যুদ্ধে গেলে শহীদ বা যুদ্ধাহত

দুর্ঘটনায় মারা গেলে সংখ্যাতত্ত্বে আমি শুধুই সংখ্যা

কোথাও আমি মানুষ নই?

 

তিন

জানি না,,,

তোমার বাবা কেমন আছে?

জানি না!

তোমার ভাইয়েরা? জানি না!

তোমার মা ভালো তো? জানি না!

তোমার প্রিয়তমা কেমন আছে? জানি না!

তোমার ভাষা কেমন আছে? জানি না!

তুমি কেমন আছ? তাও জানি না!

এতো না জানার মাঝেও দিন যায় রাত আসে

মানুষের জন্ম হয়, মৃত্যু হয়, তবুও আমরা

অজানায় বড় হই না জানায় মরে যাই।।!!!

 

 

অপূর্ব গৌতম এর কবিতা

এক

আমরা এখন মায়ের কোলে …

প্লাটফর্মের সব শিশুরাই আমার বন্ধু ছিল
ওদের বাবা নাই, মা নাই। আমারও নাই
টোকাইয়া টোকাইয়া খাই তাই আমরা টোকাই
মানুষের ফেলে দেয়া জলের বোতল, স্যান্ডেল
জামা প্যান্ট টোকাইয়া র‌্যাওনের ব্যাগ ভরতাম
এ বাড়ির ও বাড়ির দু’একটা ভালো জিনিসও
ব্যাগে ভরার কু-অভ্যাসটাও সচল ছিল সজ্ঞানে
সারাদিনে যে কটা ডাল ভাত খেতাম তার চেয়ে
বহুগুন নির্যাতন হজম করেছে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ
অসহ্য যন্ত্রণার ভারে নিথর দেহ সব মেনে নেয়
সূর্য ওঠে রঙিন আভা নিয়ে। আমার চোখের কষ্ট
বেদনার নীল সাগরে। হাঙ্গরের সাথে তুমুল লড়াই
কীর্তনখোলার ঘাট বন্ধুরা দিনের আলোয় হারিয়ে
গেলেও সন্ধ্যা নামাই একসাথে।

একদিন সন্ধ্যা বেলা –
অন্ধকারে আলো জ্বেলে বক্তৃতা দেয়
একজন মানুষ। পরদিন র‌্যাওনের ব্যাগ ফেলে
মালকাচা দিয়ে দু’হাত ঝুলিয়ে বাম ডান করি
চলো বন্ধু, চলো, মা-কে রক্ষা করি

আমরা এখন মায়ের কোলে …

১১.০২.২০১৯ সোমবার

দুই

 

শরীরে রক্তের সাগর ঢেউ

চতুর্দিকে ঘন কুয়াশা
শিশিরগুলো জলের মতোই
নেমে আসে শরীর বেয়ে
ফোঁটা ফোঁটা জলে ভিজে যায় চুল
ভিজে যায় হাত-মুখ
ভিজে যায় শরীরে জড়ানো
মালবিকার দেয়া উলেন চাদর

দুপুর থেকে সন্ধ্যা একটানা মাইকিং
মানিকের দরাজ কন্ঠের আহবান
চলে আসো বন্ধু সকাল সাতটায়
হিজলদীঘির পাড়ে

আমি ঢাকা যাব, মিছিলে যাব
মিছিলে যাব, শ্লোগান দেবো
দাবী আদায়ের শ্লোগান
মায়ের ভাষার শ্লোগান
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শ্লোগান
শ্লোগান দেবো, প্রতিশোধ নেবো
আমি ঢাকা যাব, মিছিলে যাব

কুয়াশা কেটে যাচ্ছে আলোর রোসনাইতে
হিজলদীঘির পাড়ে জড়ো হওয়া শত লোক
আমাদের বিদায় দিলে, পথ ধরি ঢাকার পথে
সকাল সাতটা সতেরো

গ্রামের মানুষ অতোশতো বোঝেনা
মিছিল, শ্লোগান, প্লাকার্ড, ব্যানার
শুধু বোঝে তারা ‘শালারে ধইর‌্যা মাইর‌্যা ফালা
আমরা মায়ের ভাষায়, বাংলা ভাষায় কতা কমু’

আমি ঢাকা যাই, মিছিলে যাই
শরীরে রক্তের সাগর ঢেউ
১৪৪, উর্দু এ কিছুই আমার নয়
নেশায় ধরেছে মাতৃভাষার
শত্রুর বুলেটে হারানো তিনটি আঙুল
আজও জবানবন্দি দেয় মিছিলের, রাজপথের

দুটি আঙুলে এখনো বর্ণ সাজে
মায়ের ভাষায় অমর একুশ …

তিন

দাসত্ব

আমি মোটেই সাহসী নই ভালবাসি বলতে
আমি মোটেই সাহসী নই
মালবিকা’র কোলে শুয়ে শুয়ে জোছনা স্নাত
রাতের আকাশে লক্ষ তারা গুণতে

আমি মোটেই ভীতু নই
দাসত্বের বিরুদ্ধে কথা বলতে …

 

আরিফ আহমেদ এর কবিতা

এক

বন্ধ করো দ্বন্দ্ব সব

শান্তি চাই! মিছিলের পতাকা ধারক
ধার করা পুরানো প্যাচাল আর কতকাল।
সবুজোরন্য বিলিন করে নগরায়নের এই যে অভয়নগর
এখানে কিসের শান্তি তোমার বলতে পারো –

কতটা জল গড়ালে সাগরে হতে পারে মহাসাগর?

তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়,
এই যে তোমার উন্নয়নের সেতু নির্মাণ চলছে…
এই সেতু ভর করে একদিন ভরদুপুরে
তুমি আমি পাড়ি দেব মরুরসাগর।

জানোতো, সেদিন খুব দূরে নয়
এখুনি রোজ যন্ত্রদানব পিছে খায় কত শত শরীর
ডিজিটাল অগ্নি স্নান; পুড়ে ছারখার চকবাজার, নিমতলি আর

প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে পোড়ে কত ঘরবাড়ি ডিজিটাল হামলায়।

শুনেছি গতকাল ভারতীয় বোমারু বিমান; ঝেড়েছে তিনশত প্রাণ কাশ্মীরে
পাকেরাও তৈরি পাল্টা হামলায় হয়তো ঝরবে আরো কত শত?

ঝরা পাতার মতো ঝরে যাবে শুধু মানুষের মানবিকতার গান।।

তুমি শান্তির কি গান শোনাবে বন্ধু
ইসলাম যে শান্তির আরবী নাম
বিশ্বজুড়ে দ্বন্দ্বটা আসলে এখানেই শুধু।।

 

দুই

বিলাপ

মেঘ জমেছে মেঘ
কয়েক ফোটা আবেগ
আর দু’-এক ফোঁটা বৃষ্টি
চকবাজার তলিয়ে দিয়ে
মৃদু মন্দ কৌশলে
চট্টলায় সেকি চতুর সৃষ্টি।।

ধার করা ভালোবাসা আর
ঋণ করা সেবায়
উন্নয়নের মহাসাগরে
জাতি আজ হাবুডুবু খায়।।

নীতিহীন নৈতিকতার বাজার বড় সস্তা
সব নেতাজীর মুখের বলি পঁচা আলুর বস্তা।।

মেঘ জমেছে মেঘ
আকাশ নামবে ভেঙে
উঠবে তুফান যখন তখন
সাবধানী মাইর ঠেঙে।।

সলিলসমাধির আগে
এমনি কত মা’র খেল ফেরাউন
সামুদও দেখেছিল পাহাড়ের ক্রন্দন।
বোঝেনি ওরা অতিপাপী তাই
তুমি তো বোঝো পাপের ক্ষমা নাই।।

 

তিন

আক্রোশ

সাগরের নোনাজলে আঁধার রাতের ঝিলিক
দেখেছো কি কখনো ছোট্ট ডিঙির খেলা
ঢেউয়ের নাচন?
সময়ের আলাপন শুনেছো কখনো
মৃত্যুপথযাত্রার আলিঙ্গনকালে
বিমর্ষ নয়ন।।

অনাদিকালের অপেক্ষা চলছে
রাত আর সময়ের সাথে
নাকি
সময় চলবে রাত্রীযাত্রায়
বাকবিতন্ডায় কেটে যায় যোজন যোজন প্রহর
আমাদের ছেদহীন আকাশ আর
নিস্ফল মাটিটুকু সম্বল।।

 

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!