ধার্মিক (ধারাবাহিক উপন্যাস)

আরিফ আহমেদ

Sharing is caring!

Painting-by-Rabindranath-Tagore

অংকন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রথম পর্ব

(পর্দা বা বোরখার ব্যবহার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
আচমকা এ জাতীয় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ঈমাম সাহেবকে বিব্রত করে দিতে চাইলেন সাইখুল আশরাফ হুজুরের ভক্তরা। এর আগে তারা এরফান এমপিকে জব্দ করতে অনেকবার চেষ্টা করেছেন, ইমামতি ফেলে রেখে একজন অসুস্থ বিধর্মীকে হাসপাতালে রেখে আসার দায়ে অভিযুক্ত এরফান এমপিকে তারা ইমামতির জন্য অযোগ্য ঘোষণা এবং যারা এরফানের পিছনে নামাজ আদায় করবে তাদেরও মুরতাদ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সরকারের সমর্থন থাকার কারণে এবং এলাকার মানুষের ভালবাসা থাকায় ইসলামী এ গ্রুপগুলো তার কোনো ক্ষতি এ যাবৎ করতে পারেনি।
অনেকদিন পর আজ তারা সুযোগ পেয়েছেন, ‘যত মত তত পথ’ নামের সরাসরি একটি অনুষ্ঠানে স্যাটেলাইট মিডিয়ার সামনে এরফান এমপিকে নাজেহাল করার। দর্শকের সদ্মবেশে তাই তাদের প্রতিটি প্রশ্নই আক্রমাত্বক।
সাইখুল আশরাফ হুজুরের ভক্তরা যে এরফানকে সহ্য করতে পারেন না, এটা এরফান জানতো, কিন্তু তারা যে তাকে এতোটা ঘৃণা কওে, তা এই প্রথম বুঝতে পারে এরফান।
মৃদু হেসে এরফান বলেÑ পর্দাÑ যদি আপনারা বোরখাকে পর্দা বলেন তাহলে আমি বলবোÑ ধর্মীয় ভাবাদর্শে যারা বিশ্বাসী তারা প্রত্যেকেই পর্দাপ্রথাকে গুরুত্ব দেন। পুরুষ-রমণী প্রত্যেকরই পর্দায় থাকা উচিৎ। শুধু নারীই পর্দায় থাকবেন আর পুরুষরা উদোম গায়ে ঘুরে বেড়াবেন আমি এটার পক্ষপাতি নই। তবে সকলের ক্ষেত্রেই মনের পর্দাটাকেই আগে শক্তিশালী করতে হবে। মা বোনদের জন্য বাহ্যিক যে পর্দা রয়েছে সেটাকে বোরখা বলি। প্রচ-ভাবে ধর্মীয় একজন নারী নির্দিধায় বোরখা ব্যবহার করেন, কিন্তু আধুনিক যুগে এর ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে। আর প্রচ- গরমে বোরখার ব্যবহার সত্যি খুব কষ্টদায়ক। তারপরও আমি বলবো বোরখা পড়ে একজন মেয়ে হাজারো পুরুষের সামনে যতটা স্বাচ্ছন্দে চলতে পারবেন, ততটা স্বাচ্ছন্দে অন্যকিছু পড়ে চলতে পারবেন না। কিন্তু একজন পুরুষ যদি তার মনের উপর পর্দা তৈরি করতে না পারেন তাহলে শত বোরখা পড়েও কিন্তু একজন নারী ঐ পুরুষটির কুচক্ষু থেকে নিজেকে রক্ষা পারবেন না।
আপনি নারীর সাথে পুরুষের তুলনা করছেন?
কেন করবোনা যুক্তি দিন, ইসলাম ধর্ম সবসময়ই নারীকে সম্মানের আসনে, মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। আপনাদের-ই হুজুরের বক্তব্যে এর অসংখ্য প্রমাণ পাবেন। কোরাণে কী শুধু নারীদেরই পর্দায় থাকতে বলা হয়েছে?
আপনি মসজিদের টাকা, আল্লাহর ঘরের জন্য দানকৃত টাকায় হিন্দু মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন-এটা যে কতটা নাফরমানী কাজ আপনি জানেন? এর জন্য আপনাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। হঠাৎই এভাবে ক্ষুব্দ হয়ে উঠলেন সাইখুল আশরাফ হুজুরের ভক্তরা। তাদের সঙ্গে আরো আছেন আসমত আলী পীর সাহেবের দরগার কিছু মাদ্রাসা ছাত্র। তাদের ক্ষোবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এখন এই টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে। দেশজুড়ে সরাসরি লাইভ সম্প্রচার চলছে- এই ‘যত মত তত পথ’ নামের ইসলামিক অনুষ্ঠান পর্বে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এরফান এমপিকে অপছন্দ করে এমন সকল মুসল্লিকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে এ পর্বে।
আপনারা শান্ত হউন। উত্তেজিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে এরফানের এ গম্ভীর উচ্চারণ। মুহূর্তেই সবাই চুপ। এরফান বলেনÑ আপনারা এ প্রশ্নের উত্তর আগেও পেয়েছেন। আমি আবারও বলছি। আমি আপনাদের মত কোন ধর্মীয় দীক্ষা নিয়ে আসিনি। আরবী ভাষায় আপনাদের মত পারদর্শী নই। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে আমি এ টুকু বুঝি যে, মানুষের মঙ্গলের জন্য, উপকারের জন্য ধর্ম তৈরি হয়েছে। মানুষের মাঝে মানুষের গভীর বন্ধুত্ব, ভালবাসা তৈরিই ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য। পৃথিবীর সব ধর্মেরই মূল উচ্চারণ হচ্ছে শান্তি। শুধু মসজিদ বা মন্দির নয়, পৃথিবীতে যতরকম উপসনালয় আছে এবং সে সব উপাসনালয়ে যত দান ক্ষয়রাত হচ্ছে তার সবই স্রষ্টা বা আল্লাহর নামেই হচ্ছে। আল্লাহ কী কখনো ঐ টাকা বা সম্পদ নিজের জন্য ব্যবহার করেন? ঐ টাকায় আমরা যেটা করি তা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ত মসজিদের বিভিন্ন সংস্কার বা ইমামের বেতন ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করি। কিন্তু আমাদের আহঞ্জিবাড়ির মসজিদের এ জাতীয় কোন সংস্কার বা ইমাম সাহেবের বেতন প্রয়োজন হয়না। তাই আমি সে টাকা মানুষের উপকারে ব্যবহার করি। সে মানুষটা হিন্দু না মুসলমান তা দেখার প্রয়োজন আমার নেই। এতে আপনারা ক্ষুব্দ হন বা আমাকে মুরতাদ বলেন আমি পরোয়া করিনা। আপনারা একটা বিষয় কেন বোঝেন না, ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, এক আল্লাহর ইবাদত যদি সবাই করেন তাহলে আপনাদের মধ্যে এত মতভেদ কেন? কেন ছোট্ট একটি জেলা শহরে এতগুলো ইসলামী দল বলতে পারেন? আমি আরবী জানিনা, তবে শুনেছি- আপনাদেরই নেতারা বিভিন্ন মাহফিলে ওয়াজ করেছেন, বিদায় হজ্বের মহত্ব বলেছেন, হুদায়বিয়ার সন্ধির কথা বলেছেন। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো বিদায় হজ্বে হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর বাণীগুলো আবার শুনুন, বুঝুন। তারপর ধর্ম পালন করুন। হুদায়বিয়ার সন্ধি দিয়ে নবীজী কী বুঝাতে চেয়েছেন ভালো করে ভেবে দেখুন।  একটি শিশুকে নবীজী মিষ্টি খেতে নিষেধ করবেন, সেইজন্য তিনি কী করেছিলেন তা বারবার স্মরণ করুন, দেখবেন আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর আপনারা পেয়ে গেছেন। আর একটা কথা…….
আচমকা বিকট শব্দে কেঁপে উঠল ময়দান। কেঁপে উঠল টিভি স্ক্রীণ ও সারা দেশ। হৈ-হুল্লোর, চিৎকার আর আর্তনাদে আকাশ বাতাস একাকার হয়ে গেল। দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল এ তখন একটাই ছবি একটাই প্রশ্ন – কে এই এরফান ইমাম এমপি?)

এক

হে স্রষ্টা তুমি, পথ ভ্রষ্টা আমাদের ক্ষমা করো।।
জ্বালো সত্য পিদীম জ্বালো, জ্বালো মঙ্গলশিখা জ্বালো ।
আমাদের মনের গহীনে লুকানো অন্ধ কোঠায়
পাপেরা সেখানে সাঁতার কাটে আর বড় হয়।।
তুমি স্রষ্টা, সব দ্রষ্টা পাপেদের বিনাস করো,
পাপীদের ক্ষমা করো।
জ্বালো সত্য পিদীম জ্বালো, জ্বালো মঙ্গলশিখা জ্বালো।

ফজরের নামাজ শেষে এভাবেই প্রার্থনাসঙ্গীত চলছিল আহঞ্জীবাড়ির মসজিদে। হঠাৎ বাহিরে কান্নার শব্দ পেয়ে ঈমাম সাহেব দ্রুত প্রার্থনা শেষ করলেন। আমীনÑ বলে ঈমাম সাহেবের পিছন পিছন মুসুল্লীরাও বেরিয়ে এলেন মসজিদ থেকে। মুসুল্লী বলতে এই আহঞ্জীবাড়ির বাসিন্দারাই জনাকয়েক। বাহিরের বা আশেপাশের বাড়ির লোকেরা এ মসজিদে আসেনা। কারণ অনেক। এখানে নাকি সব ইসলাম বিরোধী, আল্লাহ’কে নারাজ করার কায়কারবার চলছে। এটা যদি গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়ির মসজিদ না হতো তাহলে…….। থাক! সে অনেক কথা, পরে সে বিষয়ে শোনা যাবে, আগে এই কান্নার উৎস কী সেটা জানাই প্রধান বিষয়।
মুসুল্লীরা সবাই নামাজ শেষে বাহিরে এসে কান্নারত দু’জন মহিলা-পুরুষকে ঘীরে ধরেছে। তাদের সাথে তিন-চারটে বাচ্চাও কাঁদছে। মুসুল্লীরা যতই জানতে চায়- কী হয়েছে? ততই কান্নার বেগ বাড়ছে তো বাড়ছেই। তাদের কান্নার একটাই সুর ধ্বনিত হচ্ছেÑ ও চেয়ারম্যানসাব আমাগো বাঁচান। আমরা এহন কই যামু? কী খামু? আমাগোরে বিষ আইনা দেন, আমরা খাইয়া মরি। ও চেয়ারম্যানসাব গো আমাগোরে বাঁচান।
ভিড়ের মধ্যে এবার ভরাট মিষ্ট একটি কণ্ঠ ধ্বণিত হলÑ এই তোমরা কান্না থামাও,  কী হয়েছে আগে বল, তারপর দেখি তোমাগোরে বিষ দিমু না অন্যকিছু।
সাথে সাথে কান্না থেমে গেল।
ভিড় একপাশে সরে গেল। কেউ একজন একটা চেয়ার এনে পেতে দিল মসজিদের সামনের দাওয়ায়। ৩৫ কী ৩৬ বয়সের একজন যুবক এসে সে চেয়ারটি সরিয়ে দিয়ে মসজিদের দুয়ারের পাদানীতে বসলো। সৌম্যসুন্দর সে যুবকের মুখাবয়ব। ক্লীনশেভ করা, সে মুখে খেলা করছে যেন কোনো দৈবজ্যোতি। পোড়খাওয়া তামাটে উজ্জল গায়ের রং, লম্বায় প্রায় ৫ফিট ৯ ইঞ্চি হবে। কথা বললে মনে হয় যেন মাউথপিস হাতে নিয়ে মাইকে কথা বলছে, এমনই ভরাট তার কণ্ঠস্বর। সে যখন আযান দেয়, শত্রুরাও তখন থমকে যায়, মনদিয়ে শোনে আযানের সুর। নিজের অজান্তেই বড় বড় আলেমÑ যারা ফতোয়া দিয়ে আহঞ্জীবাড়ির মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন, তারাও বলে উঠেন আহ্! কী দারুণ, একেই বলে আযানের সুর। ইস, বাংলাদেশের সব জায়গায় যদি এমন মিষ্টি সুরের আযান হত!
এই কণ্ঠ ধ্বণিত হওয়া মাত্রই পিনপতন নিরবতা নেমে এল আহঞ্জীবাড়ির মসজিদ সীমানায়। পাখীদেরও বুঝি এখন শব্দ করা নিষেধ। তাই এতক্ষণ যে সব পাখী কিচির মিচির শব্দে ভোরের আগমন ঘোষণা করছিল সেগুলোও যেন চুপ হয়ে গেল।
Ñ হ্যাঁ সুনীল কাকু বল কী হয়েছে? কেন বউ পোলাপান নিয়ে এই ফজরের সময় মসজিদের কাছে এসে কান্না করছো?
সুনীল দাস তখনো ফুঁফিয়ে কান্না চাঁপার চেষ্টা করছে, ওর হাতে-গায়ে কালো কালো কালির ছোঁপ, বউটির শাড়ির বেশ কয়েক জায়গায় পোড়া, কপালের খানিকটা কেটে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেধে আছে। হাতে পোড়াক্ষত। বাচ্চাগুলোর চোখেমুখে ক্ষুদা আর কষ্টের ছাপ। ক্রমশ সকালের আলো যতো পরিস্কার হচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে বিভৎস একটা চিত্র।
সুনীল নয়, কথা বলে উঠল সুনীলের বউ। তুমি গ্রামের চেয়ারম্যান। গরিবের মা-বাপ। বিপদে তোমরার কাছে আসমু না তো কই যামু কও বাপ? বলেই আবার কান্না চাঁপার চেষ্টা, এবার সুনীল বলে উঠলÑ পরশুদিন মাঝরাইতে কে বা কারা যেন আমাগোর ঘর জ্বালাইয়া দিল। বউ বাচ্চা লইয়া পুইড়াই মরতাম, যদি গরুঘর আগে না জালাইয়া বসতঘরে আগে আগুন দিত। গরুগুলোর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাউঙ্গা গেল। দেখি দাউ দাউ কইরা আগুন জ্বলছে। কোনমতে জানডা বাচাঁইছি। ঘর-গৃহস্ত কিছু বাঁচে নাই, গরুগুলোর কি হইছে কইবার পারমু না। আশেপাশের লোকজন ছুইটা আইল। আগুন নেভানোর চেষ্টাও করেছে। লাভ হয় নাই।
পাশ থেকে একজন মুরুব্বী ফোঁড়ন কাটলেনÑ এ তো দুদিন আগের কথা। শুনলাম তোমরা বিচার চাইতে শহরে তোমাগো সমিতিতে গেছ। তা এখন আবার চেয়ারম্যানের…?
কাকা? আচমকা বাঁধা পেয়ে থেমে গেলেন মুরব্বী কাকা। তার কথা আর শেষ হল না।
সুনীল ব্যাখ্যা দিলÑ আমরা নিম্নজাতের হিন্দু। তাই কী করমু বুঝবার পারি নাই, প্রথমে আমাগের সংঘ নেতাদের জানাইলাম, তাগোর আচরণ ও কথাবার্তা শুনে তেনারা কিছু কইরবার পারবো বইলা মনে হইল না। উল্টো তাগোর কাছে যাইয়া ছেলেমেয়েরা দুবেলা কিছু খাইবারও পারে নাই। তাই আবার তোমার কাছে ছুইটা আইছি বাজান, তুমি একটা ব্যবস্থা কইরা দেও।
যুবক বলতে শুরু করলেনÑ তোমাদের ঘরে কারা আগুন দিছে সে খোঁজ দু-একদিনের মধ্যেই জানা যাবে। যারা আগুন দিয়ে তোমাগো সর্বশান্ত করেছে, তারাই তোমাদের সবকিছু আবার আগের মত ফিরিয়ে দেবে। আমি আজ পঞ্চায়েতে তাদের সব নিয়ে ৫দিন সময় দেব, এই পাঁচদিন তোমরা আহঞ্জীবাড়ির কাচারীঘরে থাকবে। নিজেরা রান্না করে খাবে। বাড়ির লোকেরা তোমাদের চাল-ডাল যা লাগে দিয়ে যাবে। কোনো অনিয়ম হলে আমাকে জানাবে। যাও, এখন তোমরা বিশ্রাম নাও।
কাচারীঘরটি মূলত আহঞ্জীবাড়ির ঐতিহ্যের সাক্ষী। এখানে বসে এখনো বিচারাচার ও মেহমানদারীর কাজ পরিচালিত হয়। বাড়ির কোনো গৃহস্তের ঘরে বাড়তি মেহমান এলে তারা এখানে থাকেন। আবার মসজিদের বারান্দায় সকালবেলা বাচ্চাদের আরবী ও বাংলা শেখান যে মৌলভী সাহেব তিনিও থাকেন এই কাচারীঘরে। তাই স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু পরিবারকে কাচরীঘরে জায়গা দেওয়া নিয়ে একটা গুঞ্জন উঠলো। গুঞ্জন তুললেন যুবকের বাবা এমাজউদ্দিন আহন স্বয়ং। তিনি বললেন- তোমার সব কাজে আমরা স্বায় দিচ্ছি বলে তুমি যা খুশি তা করতে পার না। কাচারীঘরে ওরা থাকলে মৌলভী সাহেব কোথায় যাবেন?
যুবক- আহ্ বাবা। আমাদের কাচারীঘর কী এত ছোট? যেখানে একসাথে জনা পঞ্চাশেক লোক ঘুমাতে পারে, সেখানে মাত্র একজন লোকের জন্য পাঁচজন লোকের জায়গা হবে না।
এ কথায় বাবার স্বর একটু নরম হল- না না আমি জায়গার কথা বলছি না, আমি মৌলভী সাহেবের দিকটায় ভেবে বলছি, ওখানেতো তার একটা খাট আর একটা আলমিরা রয়েছে, কোন পার্টিশনতো নেই। এমনিতেই আমাদের মসজিদ নিয়ে দূর্ণামের শেষ নেই। তারউপর মৌলভী সাহেব যদি…..
এমনসময় পাগড়িটুপি মাথায, চাপদাঁড়িতে ঢেকে থাকা মুখাবয়বের অনেকটা হাজী হাজী দেখতে একজন যুবক কথা বলে উঠলেন- মাপ করবেন কাকা সাহেব। আপনাদের মসজিদ যখন ইসলামী সংস্থা থেকে অবাঞ্চিত ঘোষিত হয়েছে তারপরই কিন্তু আমি সব জেনে বুঝে এ মসজিদে মোসাহেব হয়ে এসেছি। আমি জানি এখানে এরফান সাহেব কিছু ভিন্নধারার প্রচলন ঘটাবেন এবং আমিও তার সাথে আছি, সবসময়। তাতে যদি আলেম সমাজ আমাকেও অবাঞ্চিত করে আমার কিছু যায় আসে না। সত্যিকার ইসলামের শিক্ষাই হচ্ছে আগে মানুষের হেফাজত, তারপর আল্লাহর ইবাদত। সুনীল কাকু ছাড়াতো আমিও অচল। এই যে আমার এত সুন্দর দাঁড়িমোচ দেখছেন এটা ঐ সুনীল কাকার হাত পড়েছে বলেই না এত সুন্দর হয়েছে। তার সাথে একত্রে থাকায় আমার কোন আপত্তি নাই। চাইলে কাকা তুমি তোমার বউ সন্তান নিয়ে খাটটা ব্যবহার করো, আমি এ পাঁচদিন মসজিদের বারান্দায় কাটিয়ে দেব।
এ কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
জয় হোক বাবা তোমার, ভগবান তোমাদের ভাল করবেন। বলতে বলতে সুনীল আবার কান্না শুরু করলেন। বউ, সন্তানদের নিয়ে সুনীলকে কাচারীঘরে তুলে দিয়ে ঈমাম সাহেব অর্থাৎ এরফান চেয়ারম্যান চললেন ভিতর ঘরে, তার নিজের ঘরে।

চাঁপদাড়িতে অনেকটা হাজী হাজী দেখতে এই মৌলভী সাহেবের নাম ফুয়াদুল ইসলাম চৌধুরী। ডাকনাম ফুয়াদ। এ গ্রামের চেয়ারম্যান এরফান সাহেবের বাল্যবন্ধু তিনি এবং তিনি আসলেই একজন হাজী। যদিও নামের আগে তিনি তা ব্যবহার করেন না। একবার দু’বার নয় তিনি সাত সাতবার হজ্ব করেছেন। আসলে দীর্ঘ এগারটা বছর তার কেটেছে ইরাক, ইরান, মিশর ও সৌদী আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে। ইসলাম নিয়ে গবেষণার জন্যই মূলত তার এ সৌদী আরবে অবস্থান। আর এ জন্য এরফানই তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। ঘটনার সুত্রপাত যদিও ভিন্ন অঞ্চলে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আজকের চেয়ারম্যান ও পেশঈমাম এরফান আহন তখন নিতান্তই কিশোর।  ফুয়াদও তখন সবে ১২ বছরে পা দিয়েছে। এই অল্প বয়সে ১৪ বার কোরাণ শরীফ খতম দিতে পারার গর্বে গর্বিত ফুয়াদ প্রথম পরিচয়েই ঢাক্কা খেল এরফানের কথায়Ñ তুমি ১৪ বার কেন, হাজার বারও যদি কোরাণ শরীফ খতম দাও তাতে কারো কোন উপকার হবে না।
এ কথায় অনেকটা ক্ষেপে যায় ফুয়াদÑ জানতে চায় কেন? কেন হবে না? আমার, আমার বাবা-মায়ের তো অনেক সোয়াব হচ্ছে।
এরফান বলেছিল- কচু হচ্ছে। সোয়াব কী জিনিষ, তুমি কী তা দেখতে পারো? তুমি কী পড়লে, কেন পড়লে? যা পড়েছো, তা ভালো না মন্দ এটা যদি তুমি বলতেই না পারো তাহলে এই পড়া তোমার কী উপকারে এল? কোন উপকারেই যদি না এল, তাহলে এখান থেকে কী সোয়াব তুমি আশা কর?
প্রশ্নকটি ছুড়ে দিয়েই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল কিশোর এরফান। জানো বন্ধু, আমাদের মসজিদের ঈমাম সাহেবকে এই প্রশ্ন করেছিলাম বলেই আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন হয়তো তোমরাও তাড়িয়ে দেবে, কিন্তু একটু ভেবে দেখতোÑ আমি যা বুঝিনা, সেটা শিখে, মুখস্থ বলে আমার কী লাভ?
এরপরই মূলত এরফানের সাথে বন্ধুত্ব ক্রমশ গভীর হয় ফুয়াদের। একইসাথে পড়াশুনায় মনোযোগী হয় এরফান ও ফুয়াদ। একইসাথে ফুয়াদ বাংলা ও আরবীতে পড়াশুনা চালিয়ে যায়। আর এরফান ওদের একটি রেষ্টুরেন্ট পরিচালনার পাশাপাশি ফুয়াদের কাছে বাংলাটা শিখে নেয়। দু’জনে ঐ বয়সেই একটা লক্ষ্য নিয়ে এগোতে থাকে। তারপর এরফানের পরামর্শে ইসলাম নিয়ে গবেষণা শুরু করে ফুয়াদ। ওরা দু’জনে মিলে প্রথমে বাংলা অনুবাদের কোরাণ শরীফগুলো সংগ্রহ করে। সেখানে অনেক কিছুই ওদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। অনেক ব্যাখ্যাই মনপূঃত হয় না ওদের।
কোরাণশরীফ নাজিল হয়েছে মক্কার কোরাইশ বংশের ব্যবহৃত আরবী ভাষায়। তাই এরফানের দাবী আগে কোরাইশদের আরবীটা ভালো ভাবে রপ্ত করতে হবে। এরফান বলেÑ কোরাণকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। তারমানে পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান রয়েছে এই কোরাণে। অথচ আমরা যে ব্যাখ্যা পড়ছি সেখানে বেশিরভাগ অংশ জুড়েই শুধু ভয়-ভিতি প্রদর্শন করা আছে। আল্লাহ কোন ভয়ের শব্দ না। ভালবাসা আর শান্তির অনন্য একটি উচ্চারণ হচ্ছে- আল্লাহ্। কোরাণ-এর প্রকৃত মর্ম উদ্ধার করতে হলে প্রতিটি শব্দের সত্যিকার অর্থ উদঘাটন করতে হবে। আমাদের এই বাংলাদেশে যদি রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেটে এক এক অঞ্চলের ভাষা এক একরকম হতে পারে তাহলে আরবী ভাষার ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। তাই কোরাইশদের আঞ্চলিক আরবী জেনে তবেই কোরাণ নিয়ে গবেষণায় যাও। এটাই ছিল এরফানের একান্ত অনুরোধ। আর যে কারণেই দীর্ঘ এগারটি বছর বন্ধুকে ছেড়ে থেকেছে ফুয়াদ। ঘুরেছে মক্কা-মদিনা আর কাবা’র পথে পথে। দেখেছে, হেসেছে আর শিখেছে। জেনেছে যতটা ভুল চলছি আমরা তার চেয়েও অনেক বেশি ভুল পথে চলছে আজকের আরব জাতী। ইসলামের দেখানো পথ থেকে হাজারক্রোশ দূরে সরে এসেছে আজকের মুসলিম সমাজ। নিজেদের মধ্যে তৈরি করেছে হাজার হাজার বিভক্তি। এক আল্লাহরই ইবাদত যখন করবো, তখন কেন এত বিভক্তি? কিছুতেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না ফুয়াদ ও এরফান।
এ মুহূর্তে কাচারীঘরে সুনীল দাস পরিবারের বাচ্চাদের সামনে বিস্কুটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে মৌলভী ফুয়াদ আর সুনীল দাস ব্যস্ত একটা পার্টিশন তৈরির কাজে। আপাতত রশি বেঁধে চাঁদর টানিয়েই পার্টিশনের কাজ ছাড়লো ওরা। যেহেতু সুনীলের বউ সাথে রয়েছে তাই এ পার্টিশন। তানা হলে সুনীলকে নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না ফুয়াদের। বন্ধুকে সে জানে। খুব ভালো ভাবেই জানে। ও যখন বলেছে পাঁচদিনের মধ্যে সুনীল সমস্যার সমাধান হবে, তখন পাঁচদিনেই হবে।
এদিকে একা পেয়ে সেই যে বকর বকর শুরু করেছে সুনীল কাকা, থামবার নাম নেই। তার বেশিরভাগ কথাই হচ্ছে এমপি সাহেবের বিরুদ্ধে। এমপি সাহেবই ইসলামী সংস্থাকে আহঞ্জীবাড়ির মসজিদের উপর খেঁপিয়ে তুলেছে। গ্রামের লোকদের উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে এই মসজিদে নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে। বলে কিনা এরফান চেয়ারম্যান বিদেশে খ্রিস্টানদের সাথে মিশেছে, চুক্তি করে এসেছে খ্রিস্টানদের ধর্ম এনে গ্রামের সব মুসলমানদেরও খ্রীস্টান বানিয়ে দেবে।
: আহ্ কাকা থামোতো। কারো পিছনে কথা বলা ভালো নয় কাকা। তোমাদের ধর্মে কী এটা লেখা নেই?
: থাকবেনা কেন বাবা, আছে। সব ধর্মে ভালো ভালো কথাই লেখা থাকে। আমরা সেগুলো মানলেতো।
তয় কথা কী জানো বাবা, এই এরফান বাবাজী গ্রামে আসার পর থেইকাই গ্রামের মানুষগুলো সব কেমন ভালো হইয়া যাচ্ছিল। দেখলেনা চেয়ারম্যানী ইলেকশনে সবাই কেমন ওরেই ভোট দিল। আমরা অবশ্য দেই নাই, ভোট বেইচা দিছিলাম। নগদ টাকায় বেইচা দিছি বিরোধী পার্টির কাছে। আর এহন বলেই আবার কান্না শুরু করল সুনীল কাকা। এমন ভালো মানুষটারে ভোট দেই নাই অথচ হের দুয়ারেই….।
: থাক কাকা, এই সব কথা থাক। এখন তুমি কী করবা? হাটে যাইয়া বসতে পারবাতো?
: না বাবা, খুর-কাচি কিছুইতো আর খুইজা লইতে পাই নাই। পোড়াবাড়ির মধ্যে খুজলে হয়তো পাইয়া যামু। তয়….।
: তোমার আর খুইজা কাজ নাই। এখন যাওতো, ঘাটে যাইয়া স্নান কইরা আসো। গায়েতো কালি ময়লার অন্ত নাই। নাপিত নাপিত গন্ধ আসতিছে।
: এ কথায় হেসে দিল সুনীল দাস। নাপিতরে কও নাপিত নাপিত গন্ধÑ হাসাইলা বাবা।
: আর হাসতে হবে না, তারাতারি যাও কাকা, সঙ্গে বাচ্চাদের নিয়ে যাও ওরাও বুঝি দুদিন স্নান করে নাই।
: ঠিকই ধরছো বাজান, কিন্তু বাজান তুমি মৌলভী হইয়া যে বড় স্নান স্নান করতেছো? এতে তোমার পাপ হইবো না?
: উহ্ কাকা যাও তো। অত পাপ-পূণ্যের বিচার তোমারে করতে হইবো না। যাও, এক্ষুনি আবার ভিতর থেইকা নাস্তা আইসা পরবো, খাইয়া তোমারে চেয়ারম্যান সাহেবের অফিসে যাইতে হইবো না?
হহ হহ, যাই, বলে ব্যস্ত হলেন সুনীল কাকা।

ঘরতো নয যেন বিশাল একটি অট্টালিকা। এটাই এরফান আহন-এর ঘর। ওর দাদা-পরদাদাদের তৈরি স্মৃতি। সেগুন আর কড়াই কাঠের মিশ্রণে তৈরি দোতলা এই ঘরটিকে ছোটখাট রাজপ্রাসাদ বলাটাও অশোভনীয় হবে না। তবে পুরো বাড়িতে কিন্তু কোন ইটার ছোঁয়া নেই। সবই কাঠ আর টিন দিয়ে ঘেরা। বিশাল বড় এই আহঞ্জীবাড়ি। পুরো বাড়িতে প্রায় ২০/২৫টি ঘর রয়েছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় ঘর এটি। বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দারা সবাই একে অপরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। চাচাত-মামাত-ফুফাত ভাইবোন, চাচা-চাচীদের বাস এ বাড়ী জুড়ে। প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের মিলও প্রচ-। আহঞ্জীবাড়ির প্রধান ব্যক্তি ছিলেন ইয়ারউদ্দিন আহন। তিনি মূলত ইরান থেকে ধর্মপ্রচারের জন্য এ অঞ্চলে এসেছিলেন। এখানের মানুষের সাথে তার এতটাই বন্ধুত্ব হয়ে যায় যে তিনি আর নিজ দেশে ফিরে যান নাই। প্রবাদ আছে যে, জীনের বাদশার সাথেও নাকি তার খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই জ্বীনের বাদশা একরাতের মধ্যে তাকে এই বাড়ি তৈরি করে দেয় ও সূদূর ইরান থেকে তার বউ-সন্তানকে এই দেশে, এই অঞ্চলে এনে দেয়। সেই থেকে এ অঞ্চলে তাদের বসবাস। গ্রামের ধর্মগুরু ও পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন ইয়ারউদ্দিন আহন। আসলে ধর্মপ্রচারকারীদেরকেই তখন আহঞ্জী বলা হত। যে কারণে এ বাড়িটির নাম আহঞ্জীবাড়ি হয়েছে। এরফানের দাদা ইমতিয়াজ উদ্দিনও এ অঞ্চলের ধর্মপ্রধান ও পঞ্চায়েত প্রধান ছিলেন। মাঝখানে অল্পকিছুদিন এরফানের বাবার সময়টা থেকে গ্রামের চেয়ারম্যানী চলে যায় অন্য লোকের হাতে। সে সাথে এ গাঁ থেকে বিদায় নেয় পঞ্চায়েতী ক্ষমতাও। সম্প্রতী এরফান ফিরে এসে গাঁয়ে বসবাস শুরু করায় আবার সে ক্ষমতা ফিরে আসার একটা সম্ভাবনা দেখা দিলেও ধর্মিয় আচার অনুষ্ঠান নিয়ে ছেলের কথাবার্তা ও কার্যকলাপে শুধু গ্রামেরই নয়, জেলা শহরের ধর্মীয় নেতারাও ক্রমশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। এ নিয়ে রিতীমতো আতংকিত এরফানের বাবা এমাজউদ্দিন আহন।
সুনীলের বিষয়টা নিয়ে ছেলের সাথে কথা বলবেন বলে তিনি নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছিলেন। আর যাই হোক সুনীল হিন্দু মানুষ, তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে আর শত্রু বাড়াতে দেবেন না, অনেকটা এমন প্রতিজ্ঞা করেই বসেছিলেন তিনি।
ঘরে ঢুকেই এরফান বিষয়টা বুঝে নিয়েছে। বাবার সামনে বসে বললÑ বাবা, তুমি মনে হয় খুব দুশ্চিন্তা করছো? বিশ্বাস করো বাবা তোমার ছেলে এমন কোন কাজ করবে না যাতে অধর্ম হয় বা যা ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী।
বাবা- তাহলে তুই যে সুনীলকে বললি পাঁচদিনের মধ্যে ওর সব ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবি। সেটা …?
এরফান : সেটাতো চেয়ারম্যানের কাজ বাবা।
বাবা : কিন্তু সুনীল হিন্দু মানুষ, এমনিতেই মসজিদ ফা-ের টাকা দিয়ে তুই দীনু মাঝিকে নৌকা কিনে দিয়েছিস, ভিখারী রাহেলার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিস বলে মুসুল্লীরা সব ক্ষেপে আছে। এমন কী আমাদের বাড়ির অনেকেই আঢ়ালে আবডালে নানান রকম মন্তব্য করছে।
এরফান : আহ্ বাবা, তোমরা কেন বোঝনা, তুমিতো তাদের বোঝাতে পার যে এই টাকাতো আর নষ্ট হচ্ছে না। দীনু মাঝির নৌকাটা ডুবে গেল। ও বেচারা না খেয়ে মরে যেত। আল্লার ঘরে টাকা পড়ে আছে, আর তার বান্দা না খেয়ে মারা যায় এটা ইসলাম ধর্ম কখনো মেনে নেবে না বাবা। তাছাড়া দীনু মাঝিতো প্রত্যেক শুক্রবারের জুম্মায় এসে কিছু কিছু করে টাকাটা ফেরৎ দিচ্ছে। আর রাহেলার মেয়েটার বিয়ে হওয়ায় গ্রামের একটা পূণ্যি হলো না বাবা, তুমিই বল। মেয়েটা বড় হয়েছে, ঠিক সময় ওর বিয়ে না হয়ে একটা কোন অঘটন ঘটলে তখন পুরো গাঁয়ের নাক কাটা যেত না? আমরা তো আর ছেলেকে যৌতুক হিসেবে টাকাটা দেই নাই। ছেলেটা যেন কিছু একটা কাজ করে বউ ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে খেতে পারে সেজন্য একটা ভ্যান রিক্সা কিনে দিয়েছি। ওর আয় ভালো হলে ও টাকাটা ফেরৎ দিয়ে যাবে। তুমি কী দেখেছো বাবা রাহেলা খালা এখন আর ভিক্ষা করে না।
বাবা : কিন্তু মসজিদ ফা-ের টাকায় এগুলো করা কী জরুরী ছিল? টাকাটাতো অন্যভাবেও জোগাড় করা যেত।
এরফান : হ্যা বাবা যেত, তবে সেজন্যে অনেকের কাছে হাত পাততে হত। কেউ দিত, কেউ নানান কথা শোনাতো। এতে অনেক সময়ও বাজে খরচ হত। তার চেয়ে কি এটা ভালো নয় বাবা? মসজিদ ফা-ের সব টাকা এ গাঁয়ের প্রতিটি মানুষের দান। তারা আল্লাহর ঘরে দান করেছেন। আল্লাহ’র ঘরের টাকায় সকলের অধিকার আছে, ঐ রাহেলার যেমন আছে, তেমনি তোমার-আমারও আছে।
বাবা : না বাবা তোমার সাথে যুক্তিতে আমি পারবো না তবে বলি কী সুনীলকে নিয়ে আবার যেন এমন কোন কা- করে বস না যা ধরে ধর্মিয় নেতারা তোমার উপর আরো ক্ষেপে যায়।
এরফান : আচ্ছা বাবা সেরকম কিছু হবে না, যদি না ধর্মিয় নেতাদের কেউ ওর ঘর জ্বালানোর সাথে জড়িত না হন।
বাবাÑ তোমার কী ধারণা, ওর ঘর ধর্মিয় নেতাদের কেউ জালিয়েছেন?
এরফানÑ ঠিক জানিনা বাবা, তবে শুনেছি সমাজ সেবা কল্যাণ সংস্থা মসজিদের ঈমাম সাহেবের জন্য সুনীল কাকার জমিটা কিনতে চেয়েছিলেন এমপি সাহেব। হয়ত…
বাবাÑ হয়ত সে সুযোগটাই নিচ্ছে অন্য কেউ, এটা হতে পারে না?
এরফানÑ পারে বাবা, খুব সম্ভব সেটাই হয়েছে। এমপি সাহেবের সাথে আমার একটা বিরোধ তৈরির জন্য এটা কোন ষড়যন্ত্রও হতে পারে। আমি আজই একবার এমপি সাহেবের কাছে যাবো, খোলাখুলি কথা বলবো।
বাবা : যেটা ভালো মনে করো, কিন্তু সাবধান এমপি সাহেব কিন্তু এমনিতেই তোমাকে পছন্দ করেন না। তুমি যাতে চেয়ারম্যান হতে না পার সেজন্য অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন। কী করে যে তুমি চেয়ারম্যান হয়ে গেলে সেটা আমার কাছেও খুব রহস্যময় রয়ে গেছে।
শুধু তোমার কাছে কেন বাবা আমার নিজের কাছেও বিষয়টা রহস্যময়ই বটে। বছর হয়নি গ্রামে এলাম অথচ এর মধ্যে এত ভোট আমি পাব আশাই করিনি। এটা সম্ভবত আমাদের পূর্বপুরুষদের ভালো কাজের ফল বাবা।
বাবা : হ্যা তাই হবে। যাও বের হও, তবে তোমার মায়ের কবরটা একবার দেখে যেও। শেয়াল বুঝি আবার গর্ত করেছে।

এই আহঞ্জীবাড়িটির অবস্থান জেলা শহর থেকে নদী পার হয়ে প্রায় মাইল দশেক ভিতরে। গ্রামের নাম ইয়ার গাঁও। মূলত ইয়ারউদ্দীন আহঞ্জীর নামানুসারেই এ গাঁয়ের নাম হয়েছে ইয়ার গাঁও। শহরের অনেকে এ গাঁওটাকে বন্ধুপাড়া নামেও ডাকেন। বিশেষ করে এমপি সাহেবতো তার ভাষণে প্রায়ই বলেনÑ বন্ধুপাড়ার বন্ধুরা।
অনেক বড় বড় লোকের আনাগোনা ছিল এ বাড়িতে। এমনকি মহাত্মা গান্ধি, লর্ড কার্জনও এসেছেন। যে কারণে এ বাড়ির প্রবেশ পথেই আভিজাত্যের নিদর্শন রয়েছে। পাকা রাস্তা শহর থেকে এসে সোজা চলে গেছে আহঞ্জীর হাট স্কুল ও কলেজে। পাশ ঘেষে সেই সড়ক যেন অনেকটাই হেটে ঢুকে পড়েছে আহঞ্জীবাড়ির উঠানে। সাড়ি সাড়ি দেবদারু আর মেহগণি গাছের পাহাড়া এসে থেমেছে বিশাল এক পুকুরের সাণ বাধানো ঘাটে। ঘাটে পথিকের বিশ্রামের জন্য রয়েছে চমৎকার ব্যবস্থা। ঘাটের পাশেই সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বেশ কয়েকটি তাক। সেখানে থরে থরে সাঁজানো আছে প্লাস্টিকের বদনা। পুকুরঘাট থেকে পূর্বদিকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে রয়েছে জোড়া পাকা পায়খানা  ও পশ্রাব ঘর। সাইনবোর্ডে তীরচিহ্ন দিয়ে লেখা আছে পুরুষদের পায়খানা ঘর। এ রকম বাড়ির ভিতরে আরো দুটি পুকুর রয়েছে। মহিলাদের জন্য পাকা পায়খানা ঘর ও গোসলখানাও আছে সেখানে।
পুকুরঘাটে বসলেই আপনা থেকে চোখ আটকে যাবে পশ্চিমদিকের একটি ঘরে। মার্বেল পাথরের উপর খোদাইকরা আল্লাহু আকবর লেখাটি দৃষ্টি কাড়বেই। এটিই এ বাড়ির মসজিদ। একসময় এটাই ছিল এ গাঁয়ের প্রথম মসজিদ। মসজিদের পাশেই কাচারীঘর এবং মসজিদের সামনে ১০০ গজ এগিয়ে কবরস্থান।
দৃঢ়পায়ে মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো এরফান। কবরের পাশে কাঁদতে নেই তাই, নেমে আসা চোখের জল সামলাবার ব্যর্থ চেষ্টায় ও ব্যস্ত হল শেয়ালের তৈরি গর্তটা ভরাট করতে। একহাতে মাটি জড়ো করে গর্ত ঢাকার চেষ্টা করছে অন্য হাতে চোখের জল মোছার চেষ্টা। স্মৃতিজুড়ে মায়ের ঝাপসা মুখাবয়ব। সে মুখে এরফানের জন্য প্রচ- আকুতী। যেন এই কবর থেকেও মা ওকে ডাকছেনÑ বাবা এরফান, ফিরে আয় বাবা।

দুই
এরফানের বয়স যখন সবে ৪ বছর তখনই ওকে ভর্তি করে দেয়া হল গ্রামের মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা বলতে তখন আহঞ্জীর হাট স্কুলটিকেই ব্যবহার করা হতো। খুব সকালে ফজরের নামাজ শেষ হলেই মাদ্রাসার পড়াশুনা শুরু করতেন আহঞ্জীবাড়ি মসজিদের ইমাম ও মোহাদ্দেস দু’জনে গ্রামের ছেলেমেয়েদের আরবী শিখাতেন। বেলা ৯টা পর্যন্ত চলতো আরবী শিক্ষা কার্যক্রম। এখান থেকে প্রাথমকি শিক্ষা গ্রহণ শেষে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করে দেয়া হতো হাফেজিয়া বা মোহাম্মদিয়া মাদ্রাসায়। দুটি মাদ্রাসাই শহরে অবস্থিত। আর যারা বাংলা পড়তেন তারা ভর্তি হতেন গ্রামের পাঠশালায়। শিশুবেলা থেকেই দাদা ইমতিয়াজ আখন এর কোলে চড়ে মসজিদে যেতে অভ্যস্ত এরফান। তাই মাদ্রাসায় যেতে ওর খারাপ লাগেনি। আলিফ-বা-তা-শা শিক্ষা গ্রহণ করতেও ভালোই লেগেছে যতদিন ও বুঝেছে যে আলিফ মানে অ, বা মানে আ। প্রথমদিকে মাদ্রাসার মৌলভী সাহেব এভাবেই বুঝিয়ে আরবী শিখাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আলিফ জাবর আ, আলিফ জের এ আলিফ পেশ উÑ আ এ উ নিয়ে। এ দিয়ে সে কিছুতেই ক, খ, গ মিলাতে পারছিল না। যে কারণে খুব সুন্দরভাবে আরবী লিখতে ও পড়তে পারলেও এরফানের মধ্যে আরবী শেখার প্রতি প্রচ- অনিহা দেখা দিল। বাধ্য হয়েই মা ও দাদার প্রশ্রয়ে এরফানকে মাদ্রাসা থেকে সরিয়ে ভর্তি করা হল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরফানের বয়স যখন আটবছর ঠিক তখনই এক অদ্ভুত কা- করে বসলো ও। সেদিন ছিল শুক্রবার। মসজিদে জুম্মার নামাজের জন্য দূর দূরান্ত  থেকে আসা মুসল্লীদের ভিড় ছিল। দাদা ইমতিয়াজ আখন তখন আর বেঁচে নেই। দাদার পাগড়ীটা মাথায় দিয়ে এরফান এসে বসেছিল কাচারীঘরে পঞ্চায়েত প্রধানের চেয়ারে। এই চেয়ারে বসা নিষেধ থাকলেও যেহেতু দাদা নিজেই ওকে কোলে নিয়ে এখানে বসতেন তাই কেউ বাঁধা দিল না। কিন্তু সমস্যা হল জুম্মার নামাজে খুতবাটা যখন শেষ হলো- ইমাম সাহেব যেই বললেন- ওয়াশকুরুনি,ওয়াশকুরুকুম, ওয়াশকুরুনী ওয়ালা তাকফুরুণ’।
অমনি এরফান হাততালি দিয়ে উল্লাস করে উঠলÑ এহে হুজুর আর কোন সূরা পারে না, এই একটাই প্রতিদিন পড়ে।
এ ঘটনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। একটি বাচ্চাছেলের আচরণে এটাই আশা করা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ঘটনাটি ঘটিয়েছে আহঞ্জীবাড়ির নাতি, তাও আবার পঞ্চায়েত চেয়ারে বসে। যে কারণে মুসল্লিদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়। ইমাম সাহেব খুবই ক্ষুব্দ হলেন এবং এতে করে পঞ্চায়েত চেয়ারটি আহঞ্জীবাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলা হল। যেহেতু ইমতিতিয়াজ সাহেব মারা গেছেন এবং এরফানের বাবা এমাজউদ্দিন খুব একটা দৃঢ়চেতা নন তাই বাধা দেয়ার আর কেউ ছিল না। এরফলে গ্রামবাসী তো বটেই এরফানের বাবাও ছেলের প্রতি কিছুটা ক্ষুব্দ হলেন। তার ভেতর একটা চাঁপা রাগ কাজ করতে লাগল। তের বছর বয়সে এরফান যখন নবম শ্রেণীতে পড়ছে ঠিক তখন একদিন ক্লাশে ইসলাম ধর্ম শিক্ষকের হাতে বেদম পিটনী খেল এরফান। ওর দোষÑ আরবী পড়া শিখে আসেনি। উল্টো শিক্ষকের মুখে মুখে তর্ক শুরু করে দিয়েছে। ওর যুক্তি হচ্ছে- যেহুতু আমরা বাংঙ্গালী। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাই আমরা কেন আরবীতে পড়বো। আরবীটাকেও আমাদের বাংলা করে কেন দেয়া হচ্ছে না। এ কথায় ধর্ম শিক্ষক খুব রেগে গেলেন এবং এরফানকে ‘বেয়াদপ’ আখ্যা দিয়ে মেরে ক্লাশরুম থেকে বের করে দিলেন। এ ঘটনায় বাবা-মায়ের মধ্যেও এরফানকে নিয়ে ঝগড়া হয়ে গেল।
পরবর্তী ঘটনাটি ঘটল জুম্মার নামাজে। এরফান সরসরি মসজিদের ইমাম সাহেবকে বলল- হুজুর এই গ্রামের কেউ ই আরবী ভাষা বোঝেনা। আপনি আরবীতে কী বলছেন- তা ভালো না মন্দ? আমরা যদি নাই বুঝি তাহলে কী লাভ আরবীতে পড়ে। আপনি বাংলা করে বুঝিয়ে দিন।
ইমাম সাহেব মিষ্টি হেসে বলেন- বাবারে আরবী ভাষা সয়ং আল্লাহর ভাষা তিনি এ ভাষায় কোরাণ নাজিল করেছেন। তুমি আমি না বুঝলেও এ ভাষায় কোরাণ পড়তে হবে। তাহলেও সোয়াব হবে।
এরফান সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলে উঠল- গত জুম্মায়ইতো আপনি বললেন- কোরাণ শুধু পড়লেই হবে না। আমলও করতে হবে। আমি যদি না-ই বুঝি তাহলে আমল করবো কী করে? আমাদের মসজিদে খুতবা পড়তে হলে আপনাকে আরবীসহ বাংলা বুঝিয়ে পড়তে হবে।
এ কথায় হুজুর খুবই ক্ষেপে গেলেন এবং রেগে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। গ্রামের মুসল্লিরা সবাই এরফানের নিন্দা করতে শুরু করল। রাগে ক্ষোভে এরফানের বাবাও প্রায় তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তিনি ছেলেকে টেনে হিচড়ে মসজিদ থেকে বের করে নিলেন এবং একচোট উত্তম-মাধ্যম পিটিয়ে ছেলেকে বাড়ি থেকেও বের করে দিলেন। পঞ্চায়েতের চেয়ার তার বাড়ি থেকে সরে যাবার পর এতোদিন চেপে রাখা কষ্টটাও এখন তার ভিতর থেকে বের হয়ে এল। অনেকটা দাদার স্বভাব পেয়েছে এরফান। দাদার মতই প্রচ- একগুয়ে ও জেদী। বাবা আচরণে প্রচ- আহত হয়ে সেই যে গ্রাম ছাড়ল। পিছন থেকে মা তখন কী ডাকাটাই না ডাকল। বাবা যাসনে। বাবা এরফান কথা শোন—– যাসনে, ফিরে আয় বাবা।
আর ফেরেনি এরফান। নিজ জেলা, নিজ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল ভিন্ন দেশে ভিন্ন জেলায়। ভিন্ন গ্রামে। কী হতো বলা যায় না। তবে ভাগ্য ভালো যে ঐ সময় ফুয়াদের সাথে দেখা হয় ওর। ফুয়াদের বাবা-মাই ওকে আশ্রয় দেয় তাদের ঘরে, তাদেরই সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠে এরফান, অল্প বিস্তর পড়াশুনাও করে বটে, তবে আর দশটা যুবকের মত স্কুল বা কলেজে গিয়ে পাঠ গ্রহণ করা ওর ধাতে সয় না। ফুয়াদের বাবা খুব চেষ্টা করেন ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিতে। কিন্তু ওকে রাজী করানো কার সাধ্যি। বাধ্য হয়ে ফুয়াদই পড়াতো ওকে। নিজে যখন যা পড়তো তাই পড়াতো এরফানকে। আবার গল্প উপন্যাস আর ইসলামী বিভিন্ন অনুবাদ পড়ার প্রতি ওর আগ্রহ ছিল প্রচ-। যে কারনে ফুয়াদদের বাড়ির প্রায় সকলেই ওর জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে বই সংগ্রহ করে আনতো। সে সাথে পাবলিক লাইব্রেরীতো ছিলই। এভাবেই বেড়ে ওঠে এরফান। পাবলিক লাইব্রেরী এবং জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্র হচ্ছে ওর শিক্ষা গুরু। যথারীতি আর দশটা যুবকের মতই প্রেমেও পরেছিল। আর এই প্রেমই আবার ওকে ফিরিয়ে আনে নিজ দেশে, নিজ গ্রামে।
মায়ের কবরের পাশে বসে স্মৃতি হাতড়ে এরফান পুনরায় ঢুকরে কেঁদে ওঠে। নিজের ভালবাসার মেয়েটির কথা মনে হতেই বুকের মধ্যে চাঁপা একটা কষ্ট ঝন্ঝনিয়ে ওঠে। অজান্তেই বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।

তিন
বাবার উপর অভিমান করে ঘরছাড়া এরফান নদীর ঘাটে প্রথম যে লঞ্চটি  পেল সেটিতেই চড়ে বসল। লঞ্চের সারেং, কেরানী সবাই ওকে চেনে, তাই চুপি চুপি কাউকে কিছু না জানিয়েই নেমে পড়ল অপরিচিত এক ঘাটে। এটি ছিল ভোলার চরফ্যাশন। এখানে লঞ্চঘাটে ওর পরিচয় হয় মহেশখালীর ঘটিভাঙা দ্বীপের মাছ ব্যবসায়ী নুরু বদ্দারের সাথে। নুরু বদ্দার ওকে সাথে নিয়ে যান তার বাড়িতে। অর্থাৎ মহেশখালীর ঘটিভাঙা দ্বীপে। যে দ্বীপের মানুষেরা সবাই মুসলমান এবং সাগরে মাছ ধরাই যাদের প্রধান পেশা। শিক্ষার আলো বলতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তিনটি মসজিদ ছাড়া আর কিছু ছিলনা। তবে মসজিদের মৌলভীদের এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দাপট ছিল পুরো গ্রাম জুড়ে। গ্রামটির অবস্থান মহেশখালী থানা সদর থেকে প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণে, মাঝখানে মাইল দেড়েকের একটি বিল বা নিম্নভূমি ঘটিভাঙা দ্বীপটিকে মহেশখালী থেকেও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সাগরে জোয়ার এলে বিলটিতে হাটুপানি জমে কিন্তু বর্ষাকালে এ বিলটি ডুবে সাগরের অংশ হয়ে যায়। যে কারণে ঐ সময়টায় মহেশখালীর সাথে এই গ্রামের কোনো যোগাযোগই থাকেনা বলা যায়। এ সময় তারা বাজার সদায় করার জন্য সরাসরি জেলাসদর কক্সবাজারে চলে যায়। এমনিতেও সাগরের মাছ বিক্রির জন্য এদের কক্সবাজারই যেতে হতো। এরফানের কাছে সবচেয়ে অবাক লেগেছে যেটা- এ দ্বীপের ছেলে বুড়ো ও মহিলারা সবাই প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে অনেকটা বিড়াল কুকুরের মতোই বালু খুড়ে সামান্য গর্ত তৈরি করে, কাজ সেরে আবার ঢেকে দেয়। দু’এক ঘর অবস্থাপন্নদের মহিলারা অবশ্য বাড়ির ভিতরে জঙ্গলের দেয়াল তৈরি করে নিয়েছে। এমন বাড়ি এখানে মাত্র ছয়-সাতটি। গ্রামটিকেও তারা ছয়-সাতটি মহল¬া বা পাড়ায় ভাগ করে নিয়েছে। প্রথমদিনই এই টয়লেট ব্যবস্থা দেখে প্রচ- অবাক হয় এরফান। নিজ উদ্যোগে নুরু বদ্দার ও তার বোটের লোকদের সাহায্য নিয়ে প্রথমেই সে টয়লেট তেরির কাজ শিখায় গ্রামের সবাইকে। এতে বোটে অবস্থানরত ভোলা ও বরিশাল অঞ্চলের জেলে কর্মিরা খুব খুশি হলেও স্থানীয় ঈমাম ও প্রধান শিক্ষক খুব রুষ্ট হন। যা এরফানের জানার কথা নয়।
নুরু বদ্দারের দুই ছেলে ও এক মেয়েকে প্রাথমিক শিক্ষা দানের দায়িত্ব নিয়ে প্রায় তিনমাস কাটিয়ে দেয়ার পর এরফান আবিস্কার করে এখানের প্রতিটি মহল্লার সাথে প্রতিটি মহল্লার চলে শক্তির দাপট। নুরু বদ্দারের মহল্ল¬ায় একটি মসজিদ থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পড়েছে আজমত মাস্টারের নিজ এলাকায়। যে কারণে আজমত মাস্টারের জ্ঞাতি-গুস্টি ও তার পেয়ারের লোক ছাড়া অন্যকারো ছেলে বা মেয়ে প্রাথমিক স্কুলে যেতে পারে না। পড়তেও পারে না।  এ সভ্যতার সাথে এরফান এতোটাই অপরিচিত যে ও যতই দিন যায় ততই সকলের শত্রু হয়ে উঠতে শুরু করে।  কোনো এক অজ্ঞাত কারণে প্রধান শিক্ষক আজমত মাস্টার এরফানকে খুব পছন্দ করতে শুরু করে। এরফানের সঙ্গে বসে গল্প করতে সে হুটহাট চলে আসে নুরু বদ্দারের ঘরে। নিজেই ডেকে নুরু বদ্দারের ছেলে-মেয়েকে স্কুলে ভর্তি কওে নেয়। এতে নুরু বদ্দার খুব খুশি হয়, কারণ স্কুলে ভর্তিতো দূওে থাক আজমত মাস্টার এতোকাল তার দিকে বন্দুক তাক করে রাখতো। এখন এরফানের কারণে সে বন্ধু হয়েছে। ধীরে ধীরে এরফানকেও সবাই মাস্টার বলে ডাকতে শুরু করে। এ দিকে এরফানের কথাবার্তা, আচার আচরণ ও গায়ের রং-এর সৌন্দর্য এই দ্বীপে মন্ত্রী-প্রেসিডেন্টের ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ইত্যাদি গুজবের জন্ম দেয়। যে কারণে শিশু ও বুড়োরা খুব তারাতারি এরফানের বন্ধু হয়ে ওঠে এবং সবাই ওর কাছে পড়া শেখার জন্য ব্যস্ত হয়।
অন্যদিকে মহিলারা বিভিন্ন অজুহাতে এরফানকে সমাদর শুরু করে। এরফান চা পছন্দ করে জেনে অনেক ঘর থেকেই নিয়মিত চা আসে নুরু বদ্দারের ঘরে। সত্যি বলতে এ সব চা সবই সাগর পারে যেখানটায় ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলো (বোট) বাঁধা থাকে সেখানের একটি দোকানে তৈরি। বদ্দারদের এই বোট রাখার স্থানকে এরা মাছঘাটা বলেন। এই গ্রামে সমুদ্রের তীর ঘেছে এরকম তিনটি মাছঘাটা রয়েছে। যেখানে চা দোকান, মুদি দোকান ও ভিসিআর ঘর তৈরি করে গ্রামের ছেলে-বুড়োদের বিনোদন চলে। বাড়িতে মহিলারা চা দূরে থাক ঠিকমত মাছটাও রাঁধতে জানেন না। পুরো গ্রাম জুড়ে মাত্র দুটি ভিসিআরঘর বা হিন্দি সিনেমা দেখার বিনোদন কেন্দ্র রয়েছে। ৫/১০ টাকা টিকিটের ব্যবস্থায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা এটি পরিচালনা করছেন। এর একটি সাগর পাড়ে অন্যটি গ্রামের উত্তর প্রান্তে আজমত মাস্টারের এলাকায়। এই দুটি সিনেমা ঘরকে ঘিরে মাসের মধ্যে দুবার গ্রামে বন্দুকযুদ্ধ হবেই। প্রত্যেক ঘরে ঘরে বন্দুক রয়েছে। এরফান পরে জেনেছে, এদের পূর্বপুরুষেরা সবাই ছিল জলদস্যু।
ঘটিভাঙা মূলত কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানাধীন একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম। কক্সবাজার থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত মহেশখালী দ্বীপটিকে প্রকৃতির লীলাভূমিও বলা যায়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এ এক অনন্য রাজ্য। পাহাড়ের উপর পুরাতন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য নিয়ে মথ, মন্দির আবার মসজিদও দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। ঘটিভাঙা দ্বীপে অবস্থানকালে এরফান মাত্র দু’বার মহেশখালী সদরে যেতে পেরেছিল। হলে কী হবে এখানের মানুষেরা বেশিরভাগই আরাকান থেকে আগত মুসলামানরা। যারা নিজেদের প্রকৃত মুসলমান বলে দাবী করে এবং অল্প কয়েকঘর মগ-চাকমা ও রাখাইনদেরকে নিজেদের দাস মনে করে। বিশেষ করে রাখাইন মেয়েরা খুব সুন্দর হবার কারণে প্রায়শঃই তাদের উত্যক্ত করে মুসলমান যুবকরা। আবার দ্বীপের যে অংশে মগ বা রাখাইনদের  বসত বেশি, সে অংশে মুসলমানদের যাতায়াতের অনেক সমস্যা। তবে চোলাই মদ ও গাজা খেতে হলে মগ ও রাখাইনদের কাছেই জিম্মি রাখতে হয় নিজম্ব সম্পদগুলো। আর জেলে মানেই এ অঞ্চলে মদ-গাঁজা, ভাং-এর উম্মক্ত প্রদর্শনী। প্রথমটায় এ দৃশ্য তেমন চোখে পড়েনি এরফানের। কারণ ও যখন এসেছে তখন ছিল শীতকাল। মাছ ধরার সুবর্ণ একটা সময় তখন। সাগর পাড়ের জেলেরা ছয়মাস মাছ ধওে, বাকী ছয়মাস বসে বসে খায়। কেউ কেউ এ সময় লোনা খেতে ফসল ফলাবার চেষ্টা করে। কেউ লবণ চাষ করে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমটা শেষ হলেই দৃশ্য বদলে যায়। জেলেরা সব মেতে ওঠে আড্ডা আর নেশায়। যা এতোদিন চলেছে সাগরের উপর তা চলে জনসমক্ষে। মদ-গাঁজার আর জুয়োর অন্যরকম এক রাজ্য হয়ে ওঠে ঘটিভাঙা দ্বীপ। দুর দূরান্ত থেকে বোটে মেয়ে মানুষ আসে, আসে অন্য জেলেরাও। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে যতই নেশা করুক আর জুয়ো খেলুক আজান শোনামাত্র এরা মাতাল অবস্থাতেই মসজিদে ছুটে যায়, নামাজ পড়ে। আবার একে অপরের নামাজে ভুল ধরে। যা দেখে রাগে গাঁ জ্বলে ওঠে এরফানের। এ সব দেখে দেখে ভিত এরফান এ অঞ্চল থেকে যখন পালাবার পথ খুঁজছে তখন একদিন রমজানের রাতে পেট খারাপ করে এরফানের। বহুকষ্টে এ অঞ্চলের খাবারে ও অভ্যস্ত হলেও হাঙর মাছের ঝোলটা খেতে অভ্যস্ত হয়নি। মাস্টার হাঙর খায় না- এ শুনে ছাত্র-ছাত্রিদেও সে কী হাসাহাসি। এতোদিন তাও সহ্য করে এড়িয়ে যেতে পারলেও নুরু বদ্দার ও আজমত মাস্টারকে এড়ানো গেল না। প্রায় ছ’মাস পর রমজানের একরাতে তাদের দু’জনের সাথে খেতে বসতে হলো এরফানকে। বোট নিয়ে সাগরে থাকায় বহুদিন পরে নুরু বদ্দারের সাথে দেখা। সমস্যার অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে। তাই খেতে খেতে কথা বলার ইচ্ছে নিয়ে একত্রে খেতে বসেছিল ওরা। হাঙরের গন্ধ পেয়েই এরফান সাবধান হয়ে ওঠে। কিন্তু হেড মাস্টার ও নুরু বদ্দার জোড় করে ওকে হাঙরের একঅংশ খেতে বাধ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে বমি। এতে হেডমাস্টার ও নুরু বদ্দার খুব মজা পায়। তারা দুজনে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে। যেহেতু রোজার মাস তাই ভোররাতে নুরু বদ্দার নিজেই এসে ডেকে তোলে এরফানকে। বলে- মাস্টার এ বেলা খুব ভালো খাবার আছে। ওঠো। এদের খুব ভালো খাবার হচ্ছে- গরুর মাংস ও আলু দিয়ে রান্না করা এক পাতিল ঝোল। যাকে ডালও বলা যায় না আবার ঝোলও বলা যায় না। একেতো সন্ধ্যারাতে খেয়ে বমি করা, তার ওপর এখন এই ভালো খাবার স্মরণ করে ও এ বেলা খাবেনা বলতেই নুরু বদ্দার আৎকে উঠলেন। বললেনÑ সে কী মাস্টার, আপনি রোজা থাকবেন না, তা কী হয়?
এ কথায় উঠে অনেকটা জোর করেই অল্প কিছু খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে এরফান। কিন্তু ঘুমানো আর হয় না। পেটের যন্ত্রণা থেকে ডায়রিয়া শুরু হয়ে যায়। ভোর হতে না হতেই দশ/বারোবার টয়লেট হয়ে যায়। স্বাভাবিক কারণেই এতে রোজা থাকা সম্ভব হয় না। আশেপাশে ডাক্তার বলতেও ঐ প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ঐ হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যেতে মন স্বায় দেয় না। ও নিজেই দোকান থেকে ছাত্রটাকে পাঠিয়ে আখের গুড় কিনে আনে। পানির সাথে গুড় মিশিয়ে তাতে একচিমটে লবন দিয়ে নিজেই খাবার স্যালাইন তৈরি করে খায়। কীভাবে যেন একথা পুরো ঘটিভাঙা দ্বীপে ছড়িয়ে যায় যে, মাস্টার রোজা রাখেনি। বিষয়টা যে অনেকেই জেনে গেছে তা নিয়ে প্রথম দুদিন এরফান কোন গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ও সুস্থ হবার ২য় দিনে পাড়ার বড় মসজিদের ঈমাম সাহেব হঠাৎই লোক পাঠিয়ে ওকে ডেকে পাঠালেন। আজমত মাষ্টারের এলাকার সাগরের পাড়ের একটি চায়ের দোকানে তখন মহেশখালী দ্বীপের ছয়টি মসজিদের ঈমাম এবং পুরো গ্রামের যত যুবক ও প্রবীণ আছে, সবাই জড়ো হয়েছে। শুধু নেই নুরু বদ্দার। জরুরী কাজে সে শহরে, মানে কক্সবাজারে গেছে। এরফান ঘটনাস্থলে পৌঁছে, অবস্থা দেখে ও বুঝে আতঙ্কে কান্নায় ভেঙ্গে পরল। এ কোন দেশরে বাবা। একটা অসুস্থ কিশোর রোজা না থাকার অপরাধে তার বিচার করতে বসেছে মসজিদের ঈমাম ও প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আর বিচার দাবি করছে গ্রামের নেশাখোর কিছু যুবক। এরফানের কোনো জবাব না শুনেই বিচারের রায় হলোÑ পঞ্চাশ ঘাঁ জুতোর বাড়ি আর নুরু বদ্দারের ঘর ছেড়ে দিয়ে এলাকার সাধারণ নিম্ন আয়ের এক জেলের ঘরে গিয়ে তার ছেলেদের তিনবেলা পড়ানো, বিনিময়ে থাকার আদেশ দেয়া হলো এরফানকে। তবে জুতো মারার আগে ডাক্তার আজমত মাস্টার পরীক্ষা করে দেখবেন যে এরফান মাস্টার কতটুকু অসুস্থ? পঞ্চাশ ঘাঁ জুতো সইতে পারবেন কিনা। মাস্টারের সুপারিশে জুতো পেটার পরিমাণ কমানো যেতে পারে।
অবিশাস্য এ রায় ঘোষণা মাত্রই পালাবার চেষ্টা করেছিল এরফান। কিন্তু চারদিক থেকে ওকে ঘিরে রাখা হলো। পিছন থেকে চেংরা যুবকদের দু-চারটে কিল চড়ও এসে পড়লো ওর পিঠে। এ সময় হঠাৎই হুঙ্কার দিয়ে দাঁড়ালেন আজমত মাস্টার। ডাক্তার আজমত।
অনেকদিনের বন্ধুত্বের বদৌলতেই হয়তো তিনি সহমর্মিতা দেখালেন। অন্তত ঐ মূহুর্তে এরফানের তাই মনে হলো। তিনি বললেনÑ আমি এরফান মাস্টারকে নিয়ে শহরে যাচ্ছি। ওখানে তার চেকাআপ করিয়ে আনবো। বলেই তিনি এরফানের হাত ধরে অনেকটা টেনেই নিয়ে বোটে চড়লেন। মুখে বললেন- ছিঃ মাস্টার কী মেয়ে-ছেলের মতো কাঁদছেন। আরে এ সব গ্রাম্য মূর্খরা কী আপনার বিচার করতে পারে? আপনি হলেন আমার বন্ধু, আমার বন্ধুর বিচার করবো আমি।
বাবার বয়সী এই ৪০-৪৫ বয়সের মাস্টারটিকে এতোদিন কেন যেন এরফান পছন্দ করতে পারেনি। আজ যেন তাকে সাক্ষাৎ ফেরেশতা বলে মনে হচ্ছে ওর। ওর ধারণা ছিল লোকটি অল্প শিক্ষিত, মূর্খদের গায়ে মোড়ল সেজে বসেছে। তাই একটা দূরত্ব বজায় রাখছিল এতোদিন। ওর ছোট্টমনে লোকটাকে নিয়ে লুকিয়ে থাকা সব শংসয় এই মূহুর্তে কেটে গেল। আজ তার আচরণে এবং অবলীলায় ওর মতো ছোটো একটি ছেলেকে নিজের বন্ধু দাবী করায় এরফান লোকটিকে বিশেষ সম্মানের স্থানে বসাতে চাইলো। বাবার মুখে ও শুনেছেÑ খুব জ্ঞানী লোকেরাই সবাইকে সহজে বন্ধু বানাতে পারে। তাদের কাছে ছোটো আর বড় কোনো ভেদাভেদ নাই। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বোটের চালক যখন জানতে চাইলো মাস্টার আপনি রোজা ভাঙলা কেন? জান না রোজা ভাঙা আর জেনা করা সমান অপরাধ।
তখন উত্তরটা আজমত সাহেবই দিলেনÑ এই কথা তুমি কই শিখলা পাইলট। চালককে এরা পাইলট বলে।
পাইলট উত্তরে বললÑ কেন আমাগো মৌলভী সাবরাতো সবসময় এইডা-ই কয়? আপনি জানেন না ডাক্তার সাব।
আজমত সাহেবরে এরা কেউ ডাক্তার বলে, কেউ আবার ডাকে মাস্টার বইলা। এদের নিজস্ব ভাষাটাও যেন কেমন। আপনি তুমি মিলিয়ে গোলমালে টানের একটা ভাষা। বড় ভাই মানে বদ্দা। ভালো মানে গম।
আজমত সাহেব বললেন- হু তা জানি, তয় শরীরে যদি রোগ থাকে আর কেউ রোজা না রাখতে পারে তাইলে কী করবো? তা কী কইছে?
প্ইালট : হ কইছিল তো, কী দান খয়রাত করতে। আর সুস্থ একজনরে তার বদলে রোজা রাখতে হইবো।
এরফান এবার সাহস করে বলেই ফেলল : কেউরে যদি পাওয়া না যায়, কেউ যদি বদলি রোজা না রাখতে চায়, তাইলে কী করবো হেইডা কী কইছে?
শাবাস মাস্টার! বলেই এরফানের পিঠে একটা বিশাল চাপড় বসালেন আজমত মাস্টার। একেতো বিশাল লম্বা-চওড়া তার উপর ইয়া মোটা এক একটা হাতের ওজন হবে তিনমন। আদুরে চাপড় পড়তেই এরফান ছিটকে সাগরে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। মাস্টার নিজেই ওকে তারাতারি জড়িয়ে ধরে সাগরে পড়ে যাবার হাত থেকে বাঁচালেন। আর পাইলট টা তখন এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল যেন বাংলা সিনেমার কোনো নায়িকাকে এই মাত্র নায়ক সমুদ্রে পড়ে যাবার হাত থেকে বাঁচালো। এতে বুঝি মাস্টারের ভাবমূর্তি একটু ক্ষুন্ন হলো। তাই সে খুব গম্ভীরভাবে পাইলটকে আবার জিজ্ঞেস করলেন- কী মৌলভীত কী এইডা নিয়া কথা কইছে? কেউ যদি বদলি রোজা না রাহিত চায়, তাইলে কী করবানে?
পাইলট : না। ইভা তো ন’ কয়। জুম্মার দিন ইবা জিগাইবার হইবো।
আরে মৌলভী কী কইবো, আরথুন শুন : তোমার শরীরডা এডা পাল¬াত চড়াই অন্য পাল¬ায় চাউল দিবা নাইলে টাকা দিবা। বুঝছো? এই কথার মানে হচ্ছে- এক পাল্লায় মানুষ ও অন্য পাল্লায় চাল ওজন করে, চালটা মসজিদেও ইমামকে দান করতে হবে। এটাই এই জেলার, এই কক্সবাজার জেলার নিয়ম বলে ঘোষণা করেছেন কিছু ইমামরা। আর সব স্থানের মতো এখানেও প্রভাবশালী নেতারা নিয়ন্ত্রণ করছেন ইমামদের ইমামতিকে।
কথার ফাঁকেই শহরের কাছাকাছি এসে গেছে বোট। প্রায় তিনঘন্টা টানা চলতে হয়েছে। বিকেল তিনটার দিকে ওদের বোট সমুদ্রের সীমানা কেটে বাকখালী নদীতে প্রবেশ করল। মিনিট দশেক চলার পরই পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। ঘাট এসে গেছে। সাইনবোর্ডে লেখা বাজারঘাটা। এই প্রথম কক্সবাজার শহরের চেহারা দেখল এরফান। প্রথমেই ওরা গেল একটি খাবার হোটেলে। আর হোটেলে প্রবেশ মাত্রই মুখটা কালো হয়ে গেল মাস্টারের। কারণ ভেতরে খাবার খাচ্ছিলেন নুরু বদ্দার। এরফানকে দেখে যেন খুব অবাক হলেন তিনি। কুশল বিনিময় শেষ না হতেই আজমত মাস্টার বলে উঠলেন- তোমার মাস্টার যে এতো অসুস্থ এইডা তো কও নাই। এইডারে ডাক্তার দেখাইতে গ্রামের সবাই পাঠিয়ে দিল।
শুনে যেন চমকে উঠলেন নুরু বদ্দার। আর এই ফাঁকে আজমত মাস্টার যেন অনেকটা পালাতে ব্যস্ত হলেন। বললেনÑ মাস্টার তুমি নুরুর সাথে একটু বস আমি একটা সদয় নিয়া আসি। দ্রুত চলে গেলেন তিনি।
নুরু বদ্দারকে সব ঘটনা খুলে বললো এরফান। বিচারের রায়, ওকে ডাক্তার দেখানোর কথা সব।
সব শুনে নুরু বদ্দার এরফানের হাতে একহাজার টাকা গুজে দিয়ে বললেন- মাস্টার তুমি তোমার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাও। আর ঘটিভাঙা ফিরে যেও না। পারলে আজ রাত্র হবার আগেই পালিয়ে যেও।
নূরু বদ্দারের কথা শেষ না হতেই ফিরে এলেন আজমত মাস্টার। এসেই তাড়া দিলেন- চল মাস্টার, তোমারে ডাক্তার দেখিয়ে আনি, সন্ধ্যার আগেই আবার ফিরতে হবেতো।
নূরু বদ্দার বিদায় নিয়ে তারাতারি চলে গেলেন। এরফানকে নিয়ে আজমত মাস্টার চেঁপে বসলেন রিক্সায়। বাজারঘাটা থেকে বড়জোর দশ মিনিটের হাঁটা পথে এসেই রিক্সা ছেড়ে দিলেন। প্রধান সড়ক থেকে হাতের বামের একটা ছোটো সড়কে প্রবেশ করতে করতে আজমত মাস্টার বললেন- মাস্টার তোমারে আজ একটা নতুন জিনিস দেখামু। দ্যাখবা।
এরফান- কী জিনিস?
আজমত মাস্টার- চল, গেলেই দ্যাখবার পাবা।
এখানে শিলা ভিডিও নামের একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আজমত মাস্টার দুজন লোকের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কী সব কথা বলল। এরফান যার বেশিরভাগই বুঝতে পারলো না, তবে সিনেমা দেখার বিষয়ে আলাপ চলছে তা পরিস্কার বুঝতে পারলো ও। অল্পসময়ের মধ্যেই ওরা প্রবেশ করল মলিবাশেঁর বেড়া দিয়ে তৈরি স্কুল ঘরের মত লম্বা একটি ঘরে। সেখানে মাদুর ও চেয়ার পেতে লোকেরা ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখছে। এরফানকে সাথে নিয়ে আজমত মাস্টার সে ঘরে প্রবেশ মাত্রই একটু আগে আজমত মাস্টার যাদের সাথে কথা বলেছেন-তাদের একজন এসে কিশোর বয়সীদের তাড়িয়ে দিল। এরফানকেও সে তাড়াতে চাইলো কিন্তু আজমত মাস্টার বাঁধা দেয়ায় লোকটি বিকৃতভাবে হেসে বললÑ ইবা লালপোয়া। ও বড্ডা আড়ে একখানা গাঁওত দিও। ওদের কথার মানে এরফান বুঝতে পারলো না, শুধু বুঝল এটি একটি সীনেমা হল। এ অঞ্চলে সম্ভবত এভাবেই সীনেমা দেখে লোকে। আজমত মাস্টারও সীনেমা পাগল লোক। খুব সম্ভব সে শহরে এলেই এখানে এসে হিন্দি ছবি দেখে। তাই এখানের অনেকের কাছেই সে বেশ পরিচিত।
কিন্তু ছবি আরম্ব হওয়া মাত্রই ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে উঠলো এরফানের। এ জাতীয় ছবির কথা ও শুনেছে, কিন্তু জীবনে প্রথম ন্যাংটো নারী পুরুষকে এভাবে ছবিতে দেখে লজ্জায় ওর চোখে পানি এসে গেল। ছিঃ ছিঃ একজন স্কুল মাস্টার কী করে এভাবে ন্যাকেট ছবি দেখতে আসে। তাও এরফানের মতো একটা বাচ্চা ছেলেকে সাথে নিয়ে। এরফান উঠে দ্রুত বাহিরে চলে যেতে চাইলে আজমত মাস্টার থাবা দিয়ে ওর হাত ধরে ফেলল। একটানে ওকে তুলে নিল নিজের কোলে।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব এরফান প্রচ- চিৎকার করে খাঁমচী বসিয়ে দিল আজমত মাস্টারের মুখে, এতোই দ্রুত যে আজমত মাস্টার ওকে কোলে তুলে অনেকটা মেয়েদের মতই আদুড়ে ঢংঙে ঝাঁপটে রেখেছিল, আচমকা খাঁমচী এসে ওর মুখে পড়তেই পিছন দিকে হেলে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু চেয়ার উল্টে এরফানকে সহ নীচে পরে গেলে ফ্লিম দেখায় মগ্ন মানুষেরা পিছনে তাকাতে বাধ্য হলো। এতে আজমত মাস্টার লজ্জা পেল কি-না তা বোঝা না গেলেও দ্রুত এরফানকে ছেড়ে দিয়ে সে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হলো। আর এই ফাঁকে এরফান একছুটে সীনেমা হল থেকে বের হয়ে গেল। এরফান চলে যাচ্ছে দেখে আজমত মাস্টার চেঁচিয়ে উঠলো- এই ওকে ধর। ধর।
ততক্ষণে এরফান প্রধান সড়কের পথ ধরে সোজা ছুটছে। ও জানেনা কোথায় যাচ্ছে, তবে ছুটতে ছুটতে একসময় ও  যখন প্রচ- হাঁপাতে শুরু করল তখন থেমে দেখলো জনমানবহীন একটা এলাকায় চলে এসেছে ও। পাশেই একটা পাহাড় আর পাহাড়ে চড়ার একটা পায়ে চলা পথ। ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে নিতে এরফান পাহাড়ি পথে উপড়ে উঠে যেতে লাগল। কিছু দূর এগোতেই ও দেখলো সম্মুখে অপূর্ব সুন্দর একটি চৌচালা কাঠের বাড়ি। সন্ধ্যার আবশা আলোতেও দূর থেকেই ভিতরে গৌতমবুদ্ধের বিশাল মুর্তিটি ওর নজর কাড়লো। বুঝলো, এটা কোনো আশ্রম বা মথ। আশেপাশে জনমানুষ্যির কোনো চিহ্ন চোখে পড়ল না ওর। আশ্রমের সামনের পাটাতনটা এতোই পরিচ্ছন্ন যে ক্লান্ত এরফান সেখানে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
আচমকা পেটে গুতো খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল এরফানের। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো কেউ ওর প্যান্ট ধরে টানাটানি করছে, খোলার চেষ্টা করছে। জিন্সের প্যান্ট, বেল্ট দিয়ে বাঁধা, তাই সহজে খোলা সম্ভব হয়নি, টানাহেচড়ায় ওর ঘুম ভেঙ্গেছে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতেই কেউ একজন প্রচ- চড় মারলো ওর গালে। এতোটা জোড়ে যে মাথা ঘুরে উঠলো ওর, চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলো না। চাঁদের আবশা আলোয় আজমত মাস্টারকে চিনতে পারলো ও। সেই চড় মেরেছে ওকে, সাথে অপরিচিত আরও দু’জন লোক। একজন বললÑ ইস্ বদ্দা, এইখানে না, হোটেলেত লিয়া চলো। বান্থেরা টের পাইলে…।
আজমত- ইভা গম হইর। চল, তার আগে ওয়াইন লাগের। চল।
একহাতে এরফানকে শক্ত করে ধরে, পাহাড়ের উপরই উল্টো দিকে চলতে লাগলো ওরা। আজমত মাস্টার চলছে আগে আগে, পথ দেখিয়ে। কিছুদূর যাবার পর নীচে নামার একটা পথ। সে পথে ওরা নেমে আসতেই সম্মুখে পড়লো অনেকগুলো মলিবাঁশের তৈরি ঘরবাড়ি। প্রতিটি বাড়ি বাঁশ দিয়ে তৈরি এবং দোতলা। এখানে ঘরগুলোতে বিদ্যুত সংযোগ রয়েছে। তবে সব ঘরেই অল্প পাওয়ারের বাল্ভ জ্বলছে। হয়তো সন্ধ্যারাত বলেই আলো কমিয়ে রেখেছে সবাই। এরই একটি ঘরে প্রবেশ করল ওরা। অপরিচিতদের একজন ডাকলো- ও মাসি ক’ডে গৈল।
দোতলা থেকে মেয়েলি মিষ্টি কণ্ঠের উত্তর শোনা গেল- ইভা কোন, মাওওই ঘরোত নাই, কী লাগের?
অপরিচিত লোকটিই আবার কী সব ভাষায় কথা বলল, যা এরফানের কাছে কিচির মিচির শব্দ বলে মনে হলো। আজমত বলল- ওয়া, ইয়ে গ্লাস আর সোডাও দেয় য্যান।
দোতলা থেকে একটি মেয়ে নীচে নেমে এলো। ছেলেদের মতোই লুঙ্গি আর শার্ট পরনে। আধো আলো-অন্ধোকারে মেয়েটিকে অপূর্ব সুন্দরী কোনো পরী বলে মনে হল এরফানের। ওর মধ্যে ভয় চলে এল- ইস এই শয়তানগুলো যদি মেয়েটিকে ধরে ফেলে। যদি মেয়েটির ক্ষতি করে।
এরফানের মনের কথা টের পেয়েই বুঝি মেয়েটি ওর খোঁপা থেকে একটা চিকচিকে ধারাল চাকু বের করে হাতে নিল। সঙ্গে সঙ্গে খোঁপা খুলে লম্বা চুল গড়িয়ে হাটুতে এসে ঠেকলো। দ্রুত হাতে মেয়েটি আবার অদ্ভুত কায়দায় চাকুটা দিয়ে তার খোঁপা বেধে ফেলল। এরফান দেখলো মেয়েটির হাতের চাকু দেখে অপরিচিত দু’জন বেশ ভীত হয়ে পড়েছে। ওদের আগের হাবভাবেও বেশ পরিবর্তন চলে এল। কিন্তু আজমতকে দেখে কিছু বোঝা গেল না।
মেয়েটি চারটে গ্ল¬াসে কী সব পানিয় মিশিয়ে ওদের সামনে রেখে গেল। সাথে একটি বড়ো জাগ। প্রত্যেকে একটি করে গ্ল¬াস হাতে তুলে নেয়ার পর আজমত এরফানকেও একটা নিতে বলল। উদ্ভট বোটকা পঁচা গন্ধে ইতিমধ্যেই এরফান নাক চেপে ধরেছে। রক্তচোখে আজমত ধমকে উঠতেই এরফান দ্রুত গ্ল¬াসটা তুলে নিল। এতে সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। আর হাসির শব্দে মেয়েটি দোতলা থেকে উকি দিয়ে দেখতে লাগল কী ঘটছে। বিষয়টা অন্যরা কেউ টের পেল না। মেয়েটির নামার পথে এরফান সামনা সামনি বসে থাকায় শুধু ওর সাথেই চোখাচুখি হল মেয়েটির। এরফানের চোখের ভিতরটা হয়ত ও পড়ে ফেলে। তাই ইশারায় মেয়েটি ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ওকে চুপ থাকতে বলল।
এদিকে এরফান খাচ্ছে না দেখে আজমত কিচির মিচির ভাষায় অপরিচিতদের কি যেন বলল। এই অপরিচিতদের একজনের নাম আলমগীর অন্যজন সন্দীপ বড়–য়া। এই সন্দীপ বড়–য়া এরফানের প্যান্ট খোলার চেষ্টা করেছিল। এখন আজমতের কথা শুনে নিজের শার্টের নীচে কোমড় থেকে মরচে ধরা একটা চাকু বের করল। চাকুটা এরফানের গলায় ধরে বলল- খা, খেতে তোকে হবেই। খা।
এই সময় আবার ক্যাচকোচ শব্দে দোতলা থেকে মেয়েটি নীচে নেমে এল। ওদের সাথে কিচির মিচির ভাষায় কী সব কথা বলল। ওরাও কিচিরমিচির শব্দ তুলে উত্তর দিল। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে আমার চিবুক ধরে যেন নতুন বউকে ধরছে এমন ভাব করল। ইশারায় এরফানকে ওর সাথে যেতে বলল। আজমত ও অপরিচিত লোক দুটোও এরফানকে ইশারা করে মেয়েটির সাথে যেতে বলল।
এরফান অনেকটা ভিত-মাতালের মতোই মেয়েটির পিছনে পিছনে পুনরায় পাহাড়ে উঠে এলো। এবার মেয়েটি পরিস্কার শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে উঠলো- ওরা তোমাকে কোথা থেকে ধরে এনেছে।
এরফান অবাক চোখে মেয়েটিকে দেখলো- তুমি বাংলা জানো?
মেয়েটি উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করলো- কেন বাংলাদেশ কী শুধু তোমাদের একার সম্পদ? আমরা রাখাইনরাা কী বাংলাদেশের মানুষ না। এখানে একটা বার্মিজ মার্কেট আছে, দিনের বেলা আমাদের ছেলে মেয়েরা সেখানে কাজ করে। তোমাদের অনেকের চেয়ে অনেক ভালো শুদ্ধু বাংলা বলে তারা। ইংরাজীও বলে। সে বাদ দাও, তোমার কথা বল, তোমাকে কোথায় পেল ওরা।
এরফান বলল- আগে আমাকে তোমার নামটা বল।
মেয়েটি বলল- নাইরি। এরফান বুঝতে না পেরে আবার জানতে চাইলো। মেয়েটি আবারো বলল- নাইরী।
না বুঝে এরফান বলল- ঠিক আছে আমি তোমাকে না-ই-দি বলে ডাকছি।
এতে মেয়েটি শরীর ঝাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। এরফান ধীরে ধীরে ওর বাড়ি ছেড়ে আসা এবং ঘটিভাঙ্গা দ্বীপে অবস্থান, রোজা না রাখা, বিচার, শহরে আসা সীনেমা দেখা ইত্যাদি সব খুলে বলল।
মেয়েটি বলল- তাহলে তোমার কাছে এখন একহাজার টাকা আছে?
এরফান দ্রুত ওর প্যান্টের পকেট হাতিয়ে টাকাটা বের করল। গুনে দেখল ঠিক আছে।
মেয়েটি বলল তারাতারি আমার সাথে পা চালাও। বাস ধরতে হবে। লাস্ট বাসটা ধরতে পারলে আমি তোমাকে চিটাগাং পর্যন্ত পৌছে দেব। এ পর্যন্ত আমার ভাড়াটা অবশ্য তোমাকে দিতে হবে। তবে তোমার খাবারটা আমি দেব। মেয়েটির পিছু নিয়ে এরফান একটা বাসে চেপে বসল। এটি যাবে রামু-ঈদগাহ নামক স্থানে। পাশাপাশি দুটো সিটে ওরা বসেছে। এবার না-ই-দি বলতে শুরু করল- ওরা ঐ সময় আমাদের রাখাইন ভাষায় কথা বলেছে। ওরা যা বলছিল তার অর্থ হলো- এটাকে মদ গিলিয়ে বেহুশ না করলে খুব ডিস্টার্ব করবে। দেখলিনা গায়ে হাত দিতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।
ওরা তোমাকে মেয়েদের মতো ব্যাবহার করতে চেয়েছিল। ঐ যে আলমগীর নামের লোকটা এখানের খুব ধনি লোক, হিরামণ নামে একটি বড় হোটেলের মালিক ও। তোমাকে ঐ হোটেলেই রাতে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আর একবার ওদের খপ্পরে পড়লে তোমার উপাধি হতো লালপোয়া।
লালপোয়া? সেটা আবার কি?
ইস্! আস্তে বলো। বলেই হেসে উঠলো না-ই-দি। বললÑ পরে বড় হলে বুঝবে। এবার একটা কথা বলতোÑ তুমি আমাকে ঐ ঘরে দেখা মাত্র খুব ভয় পেয়েছিলে তাই না?
হ্যাঃ কারণ ওরা কতটা খারাপ তার পরিচয় জেনে গেছি তো তাই, ভয় পেয়েছিলাম, যদি তোমার কোনো ক্ষতি? অনেকটা স্বগোক্তির মতোই কথাটা বলল এরফান।
মেয়েটি হেসে উঠল আবার। নাহ, তুমি সত্যি খুব ভালো ও অবুঝ। ওরা মেয়ে লোভী না, ওদের লোভ তোমার মতো সুন্দর ছেলেদের প্রতি। এ অঞ্চলে এ ধরণের পুরুষের সংখ্যাই বেশি।
কিন্তু এই যে তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে এলে, পরে যদি ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করে।
না, তা পারবে না। আমাদের রাখাইন মেয়েদের পোষাক-আশাক, সাজ-সজ্জা প্রায় সবারই একরকম। খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য না করলে আলাদা করে মুখ চেনার উপায় নেই। ওরাতো আমাকে দেখেছে রাতের বেলা। দিনে চিনতেই পারবে না।
না-ই-দির কথা শুনে এরফানের বুকের ভিতর থেকে বেশ বড় একটা বোঝা নেমে গেল।
এরফানকে নিয়ে না-ই-দি যখন রামুতে নামল তখন রাত এগারটা। এখানের এই গ্রামে তখন মাঝরাত প্রায়। দু’একটি কুকুর ছাড়া রাস্তায় কোনো মানুষ চোখে পড়ল না এরফানের। অন্ধকার রাস্তায় অনেকটা গর্বিত ভঙ্গিতে এরফানের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে শুরু করল না-ই-দি। যেন নিজের আপন ছোট ভাইটি, হোঁচট খেয়ে পরে যেতে পারে এ ভয়ে সে তটস্থ। রাস্তা ছাড়িয়ে পায়ে চলা পথে কিছুটা পথ যেতেই একটি পুরাতন দালান ঘর। না-ই-দি আসবে, কারো জানার কথা নয়, কিন্তু বেশ বৃদ্ধ একলোক দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূর থেকেই তিনি জানতে চাইলেন- কে? নায়ওরি?
না-ই-দি- বান্তে বলেই একছুটে তার কাছে গেল এবং পায়ে হাত দিয়ে ধুলো নিলেন- এরফান এটা দেখে ভাবলো- এই একটা জায়গায় বুঝি সবাই বাঙ্গালী। না-ই-দি ও বান্তের মধ্যে অনেক সময় নিজেদের ভাষায় কি সব আলোচনা হলো, আলোচনার মাঝে বারবার এরফানকে দেখছিলেন বান্তে। এটা লক্ষ্য করে এরফান বুঝেছিল- যে আলোচনা তাকে নিয়েই। এতে ও বেশ লজ্জাও পেল। এই অন্ধকারে ওর লজ্জা পাওয়াটাও চোখ এড়ালো না না-ই-দির। বান্তের হাতের ইশারায় দেখানো একটি ছোট্ট দালান ঘরে এরফানকে পৌছে দিতে এসে তাই না-ই-দি বলল- শোন, এতো অল্পতে লজ্জা পেলে, ঘর ছেড়ে বের হলে কেন? ঐ যে বয়স্ক লোকটিকে দেখলে উনি আমাদের ধর্মিয় গুরু, আবার আমার বাবাও। আমি হচ্ছি ওনার তিন নম্বর স্ত্রীর তিন নম্বর ও শেষ সন্তান। তাই উনি আমাকে ভীষণ ভালো বাসেন। আমার আসার কথা কেউ জানে না, অথচ উনি ঠিক-ই জানেন। এটা তুমি টেলিপ্যাথি ভাবতে পারো, তবে আমি জানি ওনার আধ্যাত্ম একটা শক্তি আছে। সেটা-এতটাই প্রখর যে উনি এখানে বসে বসেই অনেক কিছু বলতে ও করতে পারেন। বিশেষ করে আমার জন্য উনি সব সময় জাগ্রত। আমি যে অপরিচিত তোমাকে নিয়ে এলাম, উনি তা আগেই জানতেন। তোমার কথাও উনি বললেন, বললেন তুমি খুব ভালো ও ধার্মিক ছেলে। সামনে তোমার অনেক বিপদ আছে, তুমি ঘরে ফিরে যাবে, তবে অনেক দেরি আছে তার। বাবা অবশ্য তোমাকে ঘরে ফিরে যাবার জন্য বলছেন। তোমার বাবা এখনো রেগে আছেন, কিন্তু তোমার মা …।
প্লি¬জ না-ই-দি স্টপ। মায়ের কথা শুনতে রাজি নয় এরফান। মা’কে মনে পড়লেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়।
না-ই-দি কিছুক্ষণ নিরব এরফানকে দেখল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে চলে গেলেন ঘর ছেড়ে। আর এরফান মাত্র সাজিয়ে দেয়া বিছানায় বসে গুমরে কেঁদে উঠলোÑ মা আমায় ক্ষমা করো।
নাইদির পরের কথাটা আর এরফানে শোনা হলো না। যদি শোনা হত, তাহলে কি হত বলা যায় না। তবে এরফান নির্ঘাত ছুটে যেত তার বাড়িতে।
খুব সকালে এরফানের চেয়েও বয়সে ছোট এক কিশোর নাস্তা নিয়ে এল। নাইদি এলো না। সকাল গড়িয়ে দুপুর পার হল, নাইদির দেখা নেই। অথচ এরফান কোন পথে, কিভাবে, কোথায় যাবে তা ও জানেনা। এরফান যখন নাইদির অপেক্ষায় ব্যাকুল সময় কাটাচ্ছে, ঠিক তখন পাশেই পাহাড়ি টিলার মন্দির ঘরের উঠোনে নাইদিকে বকাঝকা করায় ব্যস্ত তার মা। এরফানের জন্যই সকাল থেকেই নাইওরি বাবা-মায়ের কাছে বকার উপরে আছে। বকার একটাই কারণ, শহরের ওয়াইন ঘরে হামলা চালিয়ে আজমত ও আলমগীররা তাদের ঘরটি ভেঙ্গে দিয়েছে। রাতে রাখাইনপারায় এই নিয়ে বেশ গন্ডোগোল হলেও নাইওরি বা এরফানের বিষয়ে কোনো কথা ওঠেনি। তবে ঘটনাটা নাইওরির জন্যই হয়েছে এটা বুঝেছেন শুধু নাইওরির বাবা-মা। এরফানের ডাকা এই নাই দি সদ্য যুবতী মেয়ে। যেমন সুন্দরী, তেমনি বুদ্ধিমতি। তারওপর এখানের রাখাইন সর্দারের মেয়ে হওয়ার কারণে এলাকায় তার প্রভাব অনেক। এই মূহুর্তে তিনজন মায়ের বকা সহ্য করেও সে ভাবছে কিভাবে এরফানকে নিরাপদে কোথাও রেখে আসা যায়। তার এই ভাবনা কেউ ধরতে না পারলেও বাবা ঠিকই বুঝেছেন। মায়েদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাবা তাকে নিয়ে গেলেন মন্দিরের পিছনে। সেখানে একটি পাথরে বসে বাবা তাকে অনেক বিষয়ে বললেন। সবশেষে বললেন, এরফানকে তুমি পথ দেখাতে পার, তার ভাগ্য বদলাতে পার না। সে চেষ্টা না করে তুমি স্বাভাবিক নিয়মে যেটুকু করার তা-ই কর।
এরফানের সাথে এরপর নাইদির দেখা হয় সন্ধ্যার একটু আগে। হঠাৎ করেই ঘরে ঢুকে নাইদি বলতে থাকেন – কি সারাদিন ঘরে বসে আছ। বের হও, বলে নিজেই এরফানের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসেন পাহাড়ের উপর মন্দিরটার কাছে। এখান থেকে অনেক দূরে রাস্তা দেখা যায়, একটা ছোট নদীতে নৌকার ভেসে চলা তারও দূরে ঘন জঙ্গল। নাইদি বলে- ঐ যে দূরে জঙ্গল দেখা যায়, ওটা পার হয়ে গেলেই নাফনদী। ঐ দিকটায় বার্মারাজ্য। নাফনদী ধরে কিছুদূর এগোলে বার্মার ম-া বা আকিয়াব পরবে। তুমিতো বাড়ি ফিরে যাবে না, তাই না?
এরফানের কঠিন উত্তর- না।
আমরা আজ থেকে তিনদিন পর আকিয়াব যাব। বাবা আর আমি। বাবা বললেন তোমাকে সাথে নিতে। আকিয়াব বার্মিজরাজ্য হলেও ওখানে মুসলমানদের বসবাস অনেক। ওখানে বাবার বন্ধুরা তোমার একটা ভালো ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। তুমি কি যাবে আমাদের সাথে।
কিশোর উর্তিণ্য এরফান কোনো জবাব খুঁজে পেলনা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে নাইদির চোখে চেয়ে থাকল। নাইদিও গভীর মমতায় এরফানকে জড়িয়ে নিল তার বুকে। সেও কাঁদছিল আর রাখাইন ভাষায় বিরবির করে কিছু বলছিল। পরে এরফান জেনেছে- নাইদি তাকে ভাই বানিয়ে তার কাছেই রাখতে চেয়েছিল। বান্তে বাবা এতে রাজী না হওয়ায় নাইদি বিয়ে করতে চেয়েছিলেন এরফানকে। আর এই ইচ্ছাটার প্রকাশ ঘটিয়ে নাইদি সারাজীবনের জন্য তার বাবা ও আত্মীয়দের কাছে নিজের মুখ দেখানোর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরফলে নাইদির আর সামাজিকভাবে বিয়ে হওয়াটা সম্ভব ছিল না। কারণ, রাখাইন আইনে মেয়ে যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করতে হবে। নাইদি পছন্দ করেছিল তার চেয়ে বয়সে ছোট মুসলমান এক ছেলেকে। যা সমাজ- গোত্র মেনে নিতনা। এরফানকে আকিয়াবে একজন মৎস ব্যবসায়ীর কাছে পৌছে দিয়ে নাইদি ও তার বাবা যখন চলে যাচ্ছিল, তখন গোপনে নাইদি এরফানের হাতে গুজে দেয় একটা চিরকুট। বলে যেদিন এটা বুঝবে, সেদিন ঘরে ফিরে যাবে তুমি।
বার্মিজ ভাষায় লেখা নাইদির ঐ চিঠি আজও আগলে রেখেছে এরফান। তখন ঐ কিশোর বয়সে এরফান যা বোঝেনি, আজ তা পরিস্কার বুঝতে পারে ও। জানে ঐ চিঠিতে নাইদি লিখে গেছেন তার শেষ ইচ্ছা, অনেক না বলা কথা। মৎস ব্যবসায়ী আব্দুর রউউফ এরফানকে পৌঁছে দিলেন ভারতের দক্ষিণারাজ্যে ফুয়াদদের বাড়িতে। অভিজাত মুসলিম পরিবারে আশ্রয় পেল এরফান। শুধু জানলো না ওর নাইদির আত্মত্যাগের কথা, ফেরার পথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পরে চলে গেল সে পৃথিবী ছেড়ে। আর বান্তে বাবা শুধু মৃদু হাসলেন। যেন এসবই তার আগে থেকে জানাছিল।
সত্যিই ঐ চিঠি যেদিন প্রথম পড়তে পারলো এরফান, সেদিন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। চিঠি পরেই এরফান ছুটে গিয়েছিল নাইদির গ্রামে। সেখানে তখন নাইদির পরিবারের একজন সদস্য বুড়ো মা-ই শুধু বেঁচে ছিলেন। তার কাছেই এরফান প্রথম জানতো পারলো নাইদির আত্মহত্যার সংবাদ। সেখান থেকে নাইদির বুড়ো মাকে সাথে নিয়ে ফিরে আসে নিজের বাড়িতে।

চার
জুম্মার নামাজ শেষ হতে না হতেই আহঞ্জী বাড়িতে জড়ো হতে শুরু করলেন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যরা। কাচারী ঘরে তাদের বসতে দিয়ে আপ্পায়নের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হলেন এরফানের বাবা নিজেই। তাকে সাহায্য করছেন কাচারী ঘরের আশ্রিত সুনীল। এ মূহূর্তে সুনীলের বউ, ছেলে মেয়েদের নিয়ে ভিতর বাড়িতে অবস্থান করছে। হঠাৎ করে এরফান কেন নিজে যেয়ে জেলাধীন সব উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ এমপিকেও দাওয়াত করে এলো এ নিয়ে নিজেদের মধ্যেই নানান জল্পনা কল্পনা শুরু করেছেন তারা। এরফান নিজেও যখন একজন উপজেলা চেয়ারম্যান তাই তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করে উপায় ছিলনা। তারচেয়েও বড় কথা এরফানের জনপ্রিয়তা আশেপাশের উপজেলাতেও সমানে বেড়ে চলেছে। ধনিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান হিযযত আলী তো নিজের এলাকার মানুষের মুখে কথায় কথায় এরফান চেয়ারম্যান এটা করতে পেরেছে, ওটা করতে পেরেছে এই প্রশংসা শুনতে শুনতে রীতিমত এরফানকে মারার ফন্দি এটে ফেলেছেন। যে কারণে এ নিমন্ত্রণ রক্ষা তার জন্য জরুরী। এদিকে এরফানের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাম্বিত হলেও নিজের ডক্টরেট করা মেয়ের আচরণে এরফানের প্রতি মুগ্ধতা দেখে এমপি সাহেব না এসে পারলেন না। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে সকলে গোল হয়ে বসলেন। মিটিং শুরু হলো। ক্ষমতা বলে স্থানীয় এমপি সাহেবই এখানে এখন পঞ্চায়েত প্রধান। সরকার চেয়ারম্যানদের ক্ষমতায়নে এমপিদের যে অধিকার দিয়েছেন তারই ফলশ্রুতিতে এমপি সাহেব পঞ্চায়েত প্রধান তো হয়েছেন কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানরা এতে মোটেও খুশি হননি। প্রথম প্রথম এমপি সাহেবের কাজে বাধা প্রদান করলেও এখন মুখবুঝে সহ্য করে নিয়েছেন। তবে সুযোগ পেলেই সাপে নেউলে সম্পর্ক ফণা তুলে ওঠে। যার প্রমাণ দেখা যায় তাদের আচরণে। আশেপাশের ইউনিয়ন- উপজেলার মোট ১৭জন চেয়ারম্যান এবং একজন মাত্র সংসদীয় প্রতিনিধিকে নিয়ে এখানের এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এখনো টিকে আছে। তবে তা নাম মাত্র। চেয়ারম্যানদের অনেকেই বিরক্তিতে নাক কুচকোচ্ছেন। শুধু এরফান চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন বলেই তারা এসেছে, পঞ্চায়েতে নয় এটা বুঝিয়ে দিতে কেউ কেউ একই কথা বলছেন বারবার- জ্বী এরফান সাহেব বলেন, আমাদের কেন এভাবে নিমন্ত্রণ পাঠালেন। পঞ্চায়েত প্রধানের আসনে বসা এমপি সাহেব-ই এরফানের প্রধান টার্গেট। এখানে উপস্থিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে দু’জন মাত্র বয়সে প্রবীণ, অন্যরা সবাই এরফানের বয়জৈষ্ঠ তবে প্রবীণ নয়। একমাত্র এমপি সাহেবই বয়সের দিক দিয়ে সকলের বড় এবং রাজনীতিতেও অভিজ্ঞ। অথচ তাকে অবজ্ঞা করছে সবাই, বিষয়টা এরফানের ভালো লাগেনি। সে গলা খাকারী দিয়ে শুরু করল- আজ রাতে সকলে তারাবী পড়বেন, কাল রোজা। পবিত্র রমজান মাসের শুরু। এরকম একটা সময়ে আপনাদের যে কারণে ডেকেছি তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা সবাই মুসলমান। আর মুসলমানদের জন্য রমজান মাস-মানেই আত্মার শুদ্ধতা ও দৈহিক সংযমের মাস।
এরফান মিয়া তুমি আসল কথা কও, তোমার কাছে ধর্ম জ্ঞান নিতে আসে নাই কেউ। ব্যঙ্গ করে উঠলেন প্রবীণ উপজেলা চেয়ারম্যান হিযযত আলী।
এরফান- জ্বী আসল কথা বলতে গেলে চাচা এই কথাগুলোর দরকার আছে। আমরা রমজান মাস আসলেই খুব পরহেজগার আর ধার্মিক হয়ে যাই। কিন্তু এই রমজানের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে আমরা নাফরমানিতে মেতে উঠি, সেটা কি আপনারা জানেন? আমার মনে হয়েছে আপনারা জানলেও সেটা ভুলে গেছেন। তাই আপনাদেরকে ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো মনে করিয়ে দিতেই আমি আগে রমজান বা রোজার বিষয়ে আগে কিছু বলবো। আপনারা আমার বয়সে বড়, আমিই একমাত্র এখানে সবচেয়ে ছোট। তাই আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনারা অনেকেই শুনেছেন, গতদিন আমি গ্রামে ঘোষণা দিয়েছি যে- আগামী ৫দিনের মধ্যে নাপিত বাড়ির পুড়ে যাওয়া ঘর তারাই মেরামত করে দেবেন যারা আগুন জেলেছে।’
এটা শুনে-ই এমপি সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার ঘরে আমি এ নিয়ে আলোচনা করতে চাই নাই। তাই আজকের এই আয়োজন। আপনাদের অনেকে এ নিয়ে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন, আপনারা শুনতে চাইলে আমি নাম ধরে কে কি বলেছেন তা বলতে পারবো। এ কথায় মুরুব্বিদের অনেকেই গুটিয়ে গেলেন। কেউ কেউ গলা খাকারী দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর ঈঙ্গিত দিলেন।
এরফান বলে চলছে- আমি আমার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতেই আপনাদের নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি আমাদের চেয়ারম্যানদের মধ্যে ঐক্যতা প্রয়োজন এবং আপনারা আমার বয়সে বড়, আপনাদের পরামর্শ ও সহযোগীতা ছাড়া আমি একা কিছুই করতে পারবো না। আমি যে ঘোষণা দিয়েছি তা পালন করতে হলেও আপনাদের সাহায্য ও সম্মতি দুটোই আমার প্রয়োজন। নিজের এলাকার উন্নয়নে, এলাকার মানুষের ভালোর জন্য্ আমার নেয়া সিদ্ধান্তে যদি কোনো ত্রুটি থাকে আপনারা আমাকে ধরিয়ে দেবেন। আমি আবারও আজ এই পঞ্চায়েতের সামনে একই ঘোষণা দিচ্ছি। আর বাকি ৪ দিন, এর মধ্যে সুনীল কাকুর ঘর মেরামত না হলে যে এ কাজটি করেছে তার ঘরও একইভাবে পুড়ে যাবার কথা আগাম আপনাদের জানিয়ে রাখছি। পরে কেউ যেন আমাকে দোষ না দেন সেটাও আপনাদের জানিয়ে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। আমি রমজানের প্রসঙ্গ এনেছি কারণ, আপনারা সবাই ধর্মভীরু। ধর্মকে ভালোবাসেন। আপনারা বিশ্বাস করেন যে- অপরের ক্ষতি করে কখনো ধর্ম পালন হয়না, রোজার মাসে আমাদের প্রধান শিক্ষাই হচ্ছে এই ধর্মের সম্ভ্রম কীভাবে রক্ষা করতে হবে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ করা।
এমন সময় বাইরে থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে আসে- কীভাবে রক্ষা করতে হবে বলো বলো, দেখি তুমি রমজানের কতটা জান? সবাই তাকিয়ে দেখে জেলাসদরের প্রধান ইমাম সাইখুল আশরাফ হুজুরের আগমন। কোনো নিমন্ত্রণ ছাড়াই চলে এসেছেন তিনি। সঙ্গে তার বিশাল বাহিনী। সবাই আল¬াহু আকবর ধ্বনিতে কাচারী ঘরের বহিরাঙ্গণ কাঁপিয়ে তুলছে। তাদের চিৎকারে ছেলে বুড়োরা বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এসেছে কিছু একটা দূর্ঘটনার আশংকায়।
এই সাইখুল আশরাফ হুজুর-এর দলটি প্রথম থেকেই এরফান-এর উপর খুব খেপে আছে। তার অন্যতম কারণ এ জেলায় বসবাসরত খ্রিস্টান পল্লীর প্রায় সকলেই এরফানকে খুব মান্য করেন এবং তাদের যেকোনো উৎসব-পার্বণে এরফানকে তারা নিমন্ত্রণ করেন। যেটা নাকি ধর্মিয় দৃষ্টিকোণ থেকে মহাপাপ। সাইখুল আশরাফ হুজুরের লোকেরা এ বিষয়টিকে সবখানে খুব বিশ্রীভাবে উপস্থাপন করেন। তারাই এরফানের নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে তাকে ইহুদী-নাছারাদের চেলা ঘোষণা দিয়ে আহঞ্জি বাড়ির মসজিদে জুম্মা পড়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারী করিয়েছেন। এতেও তারা খান্ত না হয়ে ইমাম সমিতিকে এরফানকে মুরতাদ ঘোষণার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ইমাম সমিতির সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের ইমাম। তিনি উচ্চ শিক্ষিত ও ধর্মিয় চিন্তা-চেতনায় সম্মৃদ্ধ একজন সৎ মানুষ। তিনি এরফানের সব কাজকেই সমর্থন করায় সাইখুল আশরাফ হুজুর এখন তার বিরুদ্ধেও উঠে পরে লেগেছেন।

এই দ্বন্ধের সুত্রপাত হয়েছিল এরফান গ্রামে আসার কিছুদিন পর। জমি সংক্রান্ত কাজে গ্রাম থেকে শহরে যাবার পথে খ্রিস্টান পল্ল¬ীর সামনে একটা জটলা দেখে এগিয়ে যায় ও। দেখে একজোড়া ছেলে-মেয়েকে ঘীরে দাড়িয়ে আছে পাশাপাশি দুটি গ্রামের বাসিন্দারা, সকলের হাতে লাঠি-সোটা। সবাই খুব উত্তেজিত। অবস্থা এমন যে, মুসলমান আর খ্রিস্টানের মধ্য যেকোনো মূহূর্তে মারামারি শুরু হয়ে যাবে। এরফানকে চেনেন এমন কেউ কেউ এরফানকে সরে যেতেও বললেন। কিন্তু এরফান বিষয়টা কি তা না জেনে সরে যেতে রাজী নয়। পরে দু’পক্ষের দুজন এসে এরফানকে সব জানালো। তাদের থেকে এরফান জানতে পারলো যে, সিকদার বাড়ির অসিরুদ্দি সিকদারের ছেলে আনিস কলেজে পড়তে যেয়ে খ্রিস্টান পল্লীর অনু সরকারের মেয়ে রোজীকে ভালবেসে ফেলেছে। এ নিয়ে অনেকদিন ধরেই গন্ডগোল চলচিল। অসিরুদ্দি চায় মেয়ে মুসলমান হলে তাদের বিয়েতে সে আপত্তি করবে না। অন্যদিকে অনু সরকার চান ছেলে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করুক। তাহলে সে বাধা দেবেনা। এ নিয়ে দু’পরিবারে এমনকি ধর্মিয় নেতাদের মধ্যেও দ্বন্ধ শুরু হয়ে গেছে। উপায় না দেখে ছেলে মেয়ে দু’জন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এখন গ্রামবাসী তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। এরফান ছেলে মেয়ে দু’জনকেই নিজের সাথে নিয়ে গ্রামে ফিরে এল। ওদের কথাবার্তা শুনে ও জানতে পারলো যে, মেয়েটি আনিসকে এতোই ভালোবাসে যে সে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে রাজী, আবার ছেলেটিও মেয়েটির জন্য সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
এরফানের হস্তক্ষেপে আপাতত যুদ্ধের সম্ভবনা বন্ধ হলেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো গ্রাম থেকে শহরেও। ছুটে এলেন মাওলানা সাইখুল আশরাফ হুজুর ও তার বাহিনী, ছুটে এলেন খ্রিস্টান সমাজের কেন্দ্রিয় নেতা ফাদার আলফ্রেড গঞ্জালেস ও তার দল।
এই কাচারী ঘরেই সেদিন এরফান রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। গ্রামবাসী জড়ো হয়ে সেদিন প্রথম এরফানের ভাষণ শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। উপস্থিত ধর্মিয় নেতাদের কাছে এরফান প্রশ্ন করেছিলÑ আমাকে আপনারা এই উত্তর দিন যে, পৃথিবীতে ধর্ম আগে এসেছে না মানুষ আগে? কেন ধর্ম পরে এল? ধর্ম আসার কারণ কি ছিল?
মানুষের মাঝে হানাহানি, অন্যায়-অবিচার বন্ধের জন্য যদি ধর্ম সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে ধর্মের কাজ তো ভালবাসা সৃষ্টি করা। একে অপরের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টির জন্য যদি পৃথিবীর সব ধর্ম সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে এই ছেলে- মেয়ে দুটির অপরাধ কোথায়? কেন তাদের নিজ নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে বলছেন আপনারা? আপনারা কি আল¬াহ বা আমাদের প্রভুর সেই কথাটি ভুলে গেছেন? এটা আমাদের কোরাণ শরীফে যেমন আছে তেমনি খ্রিস্টানদের বাইবেল-এ উল্লে¬খ আছে Ñ ‘কারো মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বাধ্য কর না। একমাত্র মন থেকে ডাকলেই আমি সাড়া দেই।’
তাহলে আমরা কেন ওদের মনের ওপর জোড় খাটাবো। এই ছেলে-মেয়ে দুটির বিয়ে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করাবো। আপনারা চাইলে আপনাদের দু’ধর্ম বিধান অনুযায়ীই ওদের বিয়ে হবে এবং ওরা যার যার ধর্ম পালন করে সংসার জীবন যাপন করবে। যদি কখনো ওদের একে-অপরের মন নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে মেনে নিতে চায়, ওরা তা করবে আমরা বাদা দেব না।
এ সময় সাইখুল আশরাফ হুজুর বললেনÑ কিন্তু ওদের সন্তানরা তখন কোন ধর্মে দীক্ষা নেবে?
এরফান- ওদের সন্তানরা বড় ও বুঝদার না হওয়া পর্যন্ত উভয় ধর্মেই দীক্ষা পাবে। তারপর তাদের যেটা ভাল মনে হবে সেটা তারা বেছে নেবে।
এরফানের এ ঘোষণায় ভরা মজলিশের সামনে ফাদার আলফ্রেড গঞ্জালেস এরফানকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন- ভাই, তুমি আজ যে দৃষ্টান্ত তৈরি করলে তা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা আজ থেকে আর কখনো কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার পথে ধর্ম নিয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবোনা, এই মজলিশে আমি প্রতিজ্ঞা করে গেলাম। তুমি যেভাবে ভালো মনে করো ওদের বিবাহ দাও।
ফাদার আলফ্রেড গঞ্জালেস মেনে নিলেও তখন খ্রিস্টানদের অনেকে বিষয়টি মানতে পারেন নি। আবার গ্রামবাসী সাধারণ মানুষ এ বিচারে অত্যন্ত খুশি হলেও সাইখুল আশরাফ ও সমমনা মুসলমানরা এটা নিয়ে অনেক ক্ষোভ প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন নি। কিন্তু তারা এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে যখন আরো বড়ো আলেমদের সাহায্য চাইলেন এবং সেই আলেমরা সব শুনে উল্টো এরফানেরই প্রশংসা করতে শুরু করলেন, তখন তারা চুপ হয়ে গেলেন। এরফান অনেকটা গ্রামবাসীর সাহায্য নিয়ে প্রথমে খ্রিস্টান ধর্মিয় নিয়মে এবং পরে ইসলাম ধর্মের নিতি অুনযায়ী আনিস সিকদার ও রোজী সরকারের বিবাহ সম্পন্ন করে দিল। সেই থেকে খ্রিস্টান সমাজের বেশিরভাগ অংশের মানুষেরা, এমনকি তাদের চার্চের প্রধান পর্যন্ত এরফানকে ভালবাসেন। নির্বাচনে হঠাৎ দাঁড়িয়ে এরফানের জিতে যাওয়াটায় এই ভালবাসাই ছিল প্রধান হাতিয়ার।

পাঁচ
এ মূহুর্তে কাচারী ঘরের সামনে তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শন ও কোনো পূর্ব সংবাদ না দিয়ে হঠাৎ আগমনকে এরফান একেবারেই উপেক্ষা করল। এমনভাব দেথাল যে সে আসবে তা ও আগেই জানতো। তাই হুজুরকে সালাম জানিয়ে স্বসম্মানে বসার আমন্ত্রণ জানাতে জানাতে ও বললÑ হুজুর আসতে বেশ দেরি করে ফেললেন, সভা যে প্রায় শেষের পথে। এরফানের উপর তারা যে প্রচ- ক্ষেপে আছেন সেটা বুঝিয়ে দিতেই সাইখুল আশরাফ হুজুর এরফানের সালামের কোনো জবাব না দিয়েই একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। বললেন- থামলে কেন মিয়া তুমি কী জান, কতটা জান তা আমাদেরও জানতে হবে তো। কও। কও দেহি রোজা কি কও?
জ্বী হুজুর! আমি যদি কোনো ভুল বলি আপনি ধরিয়ে দেবেন। বলেই এরফান শুরু করল। রমজানে আমরা রোজা কেন রাখি? কেন নবীজী মুসলমানদের জন্য রোজা রাখা ফরজ বলে গেছেন? কারণ, রোজা রাখলে আমরা উপবাস থাকি। এতে শরীরের অনেক তেজ কমে যায়। শরীর মনের উপর প্রভাব ফেলে আমাদের দিয়ে অনেক পাপ কাজ করিয়ে নেয়। ক্ষুদার্ত শরীরে লোভ, লালসা, কাম, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদী প্রবণতা সহজে আসেনা। এটা আমাদের হানাহানি থেকে দূরে রাখে। একটানা একমাস এই সংযম যে পালন করে সে আত্মার শুদ্ধতা লাভ করতে পারে, যদি তার সংযম পালন সঠিক হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তা হয় না। আমরা উপবাস থাকি ঠিকই, কিন্তু রোজার সম্মান দিই না। আমাদের রোজা হয় না। কারণ ইফতার ও শিহরী বেলায় বসে এতোই খাই সারাদিন এ খাবার যোগারের চিন্তায় বেলা চলে যায়। আমাদের রিপুগুলো লোভ-লালসা ইত্যাদী কু-প্রবণতা মুক্ত হতে পারে না। রোজা রেখে কেউ যদি একটা মিথ্যা কথা বলেন তাহলে তার রোজা ভেঙ্গে যায়। কী হুজুর আমি ঠিক বলছিতো? এরফান হুজুরের কাছে জানতে চওয়ায় হুজুর গর্বিত ভঙ্গিতে বলেন- একদম ভাঙ্গে না মাকরু হয়ে যায়। তাহলে এবার আপনি-ই বলুন হুজুর- ইসলামে সবার আগে কী আছে? এরফানের হঠাৎ এ প্রশ্নে সাইখুল আশরাফ হুজুর ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে গেলেন- তিনি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন- সবার আগে সেবার কথা বলা আছে।
সেবার কথাই যদি থাকে, সেই সেবা নিশ্চয়ই পশু-প্রাণীর না।
হুজুর ক্ষেপে উঠলেন- পশু-প্রাণীর হতে যাবে কেন মানুষের সেবার কথাই বলা আছে।
তাহলে হুজুর এটাও দয়া করে বলে দিন যে সেখানে কোন মানুষের সেবার কথা বলা হয়েছে? উপস্থিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে পিনপতন নিঃস্তব্দতা। সকলে এই আলোচনায় বেশ মজা পাচ্ছেন তা তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে আছে।
অনেকটা ক্রদ্ধ স্বরেই হুজুর বললেন- বিপদগ্রস্থ ও অসহায় মানুষের সেবা প্রথমে।
তাহলে হুজুর আপনিই বলুন- এই যে সুনীল কাকুর ঘর পুড়িয়ে দিল। এই অসহায় মানুষটার পাশে দাঁড়ানো কি অপরাধ?
হুজুর এবার গম্ভীর হাসি দিলেন- এইতো তোমরা ছোকরারা দু’পাতা পড়ে শিখে এসেছো। সুনীল তো বেদীন, কাফের। কাফেরের সেবার কথা ইসলামে বলে নাই।
কিন্তু হুজুর আপনিই বলেছেন- মানুষের সেবার কথা ইসলাম বলেছে। সুনীল কাকা আগে মানুষ না কাফের?
এ প্রশ্নে আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন সাইখুল হুজুর। তিনি কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না।
এরফান বলে যেতে লাগল- আগামীকাল থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। এই রমজান মাসের শিক্ষাই হচ্ছে উত্তম শিক্ষা। যারা সুনীল কাকুর ঘর পুড়িয়েছেন তারা মুসলমান হলে ৪ দিনের মধ্যেই তার ঘর আবার দাঁড় করিয়ে দেবেন। আর যদি অন্য ধর্মের হয় তাহলে ২দিন মাত্র সময় পাবেন। আজ আমাদের শ্রদ্ধেয় হুজুরের সম্মুখে এবং মাননীয় এমপি সাহেবের সম্মুখে আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি অন্যথায় তাদের ঘর আমি পুড়িয়ে দেব।
এরফানের এ ঘোষণায় কাচারী ঘরে মৃদু গুঞ্জন উঠলো। এমপি সাহেব উঠে দাঁড়ালেন- পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে আমিও এরফান চেয়ারম্যানের সাথে আছি। কারণ আজ সুনীলের ঘর পুড়েছে, কাল ওরা হয়তো আমার ঘরটাই পুড়িয়ে দেবে। তাই আমিও এরফানের সাথে একমত। কিন্তু ৪ দিনের মধ্যে এটা না হলে এরফান কী করে তাদের সনাক্ত করবে এটাই আমার প্রশ্ন।
অপর একজন উপজেলা চেয়ারম্যান মনির হোসেন বলে উঠলেন- এরফান তুমি যেভাবে বলছো, তাতে মনে হচ্ছে তুমি তাদের জানো। তাহলে তুমি কেন তাদের নাম বলছো না?
এরফান মৃদু হেসে বলল- তাদের নাম আমি জানলেও বলতাম না কারণ, তারা সমাজের চোখে খারাপ হতে চায় না বলেই রাতের আধারে ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। সুনীল কাকাও তাদের জানে তাই তারা ঘুমন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে। তাদের সাথে সুনীল কাকার নিজ ধর্মের লোকও জড়িত। তানা হলে গরু ঘরে আগে আগুন জ্বলতো না, জ্বলতো সুনীল কাকার বসত ঘরে।
এরফানের এ ধরণের বক্তব্যের মাঝেই যেমনি হঠাৎ এসেছিলেন সাইখুল আশরাফ হুজুর, তেমনি কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন নিরবে।
সভা শেষ হলো। সবাই বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর বাবা জানতে চাইলেন- তুই কি পাগল হয়েছিস? এভাবে সবাইকে খেপিয়ে কি সুনীল-এর ঘর তৈরি করতে পারবি?
এরফান মৃদু হেসে বলল- চিন্তা করনা বাবা। আজ রাতেই দেখবে সুনীল কাকু তার ঘর তৈরির কাজ শুরু করে দিচ্ছে। এবার চল খুব খিদে পেয়েছে।

(চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

Sharing is caring!

About the author

ডিসেম্বর ৭১! কৃত্তনখোলার জলে সাঁতার কেটে বেড়ে ওঠা জীবন। ইছামতির তীরঘেষা ভালবাসা ছুঁয়ে যায় গঙ্গার আহ্বানে। সেই টানে কলকাতার বিরাটিতে তিনটি বছর। এদিকে পিতা প্রয়াত আলাউদ্দিন আহমেদ-এর উৎকণ্ঠা আর মা জিন্নাত আরা বেগম-এর চোখের জল, গঙ্গার সম্মোহনী কাটিয়ে তাই ফিরে আসা ঘরে। কিন্তু কৈশরী প্রেম আবার তাড়া করে, তের বছর বয়সে তের বার হারিয়ে যাওয়ার রেকর্ডে যেন বিদ্রোহী কবি নজরুলের অনুসরণ। জীবনানন্দ আর সুকান্তে প্রভাবিত যৌবন আটকে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পদার্পন মাত্রই। এখানে আধুনিক হবার চেষ্টায় বড় তারাতারি বদলে যায় জীবন। প্রতিবাদে দেবী আর নিগার নামের দুটি কাব্য সংকলন প্রশ্ন তোলে বিবেকবানের মনে। তার কবিতায়, উচ্চারণ শুদ্ধতা আর কবিত্বের আধুনিকায়নের দাবী তুলে তুলে নেন দীক্ষার ভার প্রয়াত নরেণ বিশ্বাস স্যার। স্যারের পরামর্শে প্রথম আলাপ কবি আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ নুরুল হুদা এবং তৎকালিন ভাষাতত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাজীব হুমায়ুন ডেকে পাঠান তাকে। অভিনেতা রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূর, সাংকৃতজন আলী যাকের আর সারা যাকের-এর উৎসাহ উদ্দিপনায় শুরু হয় নতুন পথ চলা। ঢাকা সুবচন, থিয়েটার ইউনিট হয়ে মাযহারুল হক পিন্টুর সাথে নাট্যাভিনয় ইউনিভার্সেল থিয়েটারে। শংকর শাওজাল হাত ধরে শিখান মঞ্চনাটবের রিপোটিংটা। তারই সূত্র ধরে তৈরি হয় দৈনিক ভোরের কাগজের প্রথম মঞ্চপাতা। একইসমেয় দর্শন চাষা সরদার ফজলুল করিম- হাত ধরে নিযে চলেন জীবনদত্তের পাঠশালায়। বলেন- মানুষ হও দাদু ভাই, প্রকৃত মানুষ। সরদার ফজলুল করিমের এ উক্তি ছুঁয়ে যায় হৃদয়। সত্যিকারের মানুষ হবার চেষ্টায় তাই জাতীয় দৈনিক রুপালী, বাংলার বাণী, জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, মুক্তকণ্ঠের প্রদায়ক হয়ে এবং অবশেষে ভোরেরকাগজের প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান ৬৫টি জেলায়। ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ২০০২ সালে প্রথম চ্যানেল আই-্র সংবাদ বিভাগে স্থির হন বটে, তবে অস্থির চিত্ত এরপর ঘনবদল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, আমাদের সময়, মানবজমিন ও দৈনিক যায়যায়দিন হয়ে এখন আবার বেকার। প্রথম আলো ও চ্যানেল আই আর অভিনেত্রী, নির্দেশক সারা যাকের এর প্রশ্রয়ে ও স্নেহ ছায়ায় আজও বিচরণ তার। একইসাথে চলছে সাহিত্য বাজার নামের পত্রিকা সম্পাদনার কাজ।